লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র:
দেশ ও প্রযুক্তি
ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রাধিকার সরকার শিক্ষা ও ভূমি
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি যখন ঘোষিত হয় তখন এর প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা, প্রেক্ষিত ইত্যাদি নিয়ে কোনো লিখিত বা অলিখিত দলিল ছিল না। সম্ভবত সে কারণেই এ বিষয় নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্কও ছিল না। থাকার সুযোগও ছিল না। হয়তো এখনও নেই। তবে চ্যালেঞ্জ ছিলো। বস্ত্তত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সর্বশেষ দলিলে একেবারে শেষ মুহূর্তে বিষয়টি সংযোজন করায় এবং দলের সভানেত্রী সেই প্র স্তাবনা ঘোষণা করেন বলে এটি নিয়ে দলের মাঝে আলোচনা-সমালোচনা করার কোনো সুযোগ ছিল না।
এই প্রসঙ্গটি অ্যাজেন্ডা হিসেবে নেবারও কোনো সুযোগ ছিল। ৬ ডিসেম্বর ২০০৮ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এটি লেখার পর একেবারে শুরুতে দুয়েকজন আইটি বিশেষজ্ঞ ডিজিটাল বাংলাদেশ না বলে ই-বাংলাদেশ বলা যায় কি না, তেমন প্র স্তাব রেখেছিলেন। কিন্তু যেহেতু এটি পার্টির কোনো ফোরামে আলোচিত হয়নি এবং বিশেষত নূহ উল আলম লেনিন এটি বদলানোর কথা ভাবেননি, সেহেতু এটি যখন ঘোষিত হয়েছে, তখন ডিজিটাল বাংলাদেশ কথাটিই থেকে গেছে। সেটি নিয়ে পরে আর কোনো আলোচনাও হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলোতে কেউ কেউ এমন প্রসঙ্গ এনেছেন যে ভারত তো ডিজিটাল ভারত বলে না, এমনকি আমেরিকাও ডিজিটাল আমেরিকা বলে না, তাহলে আমরা কেনো বলি। নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের পর কেউ কেউ এটি নিয়ে মিডিয়াতে সমালোচনাও করেছেন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে যাবার ফলে আওয়ামী লীগ এটি মনে করতে থাকে যে, দেশের নতুন প্রজন্ম ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল বলেই দলের এতবড় সাফল্য এসেছিলো। সম্ভবত এটি খুবই সত্য কথা। এই একটি স্লোগান ১ কোটি ১০ লাখ নতুন ভোটারের কাছে এবং অপেক্ষাকৃত নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে যথেষ্ট আবেদন সৃষ্টি করে, এ বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যদিও নির্বাচনের আগেতো বটেই, পরেও ডিজিটাল বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি। তবে আমি যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা এমনকি প্রথমবারের মতো ২০০৭ সালেই বলেছিলাম তখন খুব স্পষ্টভাবেই এর প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা ও অনিবার্যতার কথা বলেছি। বিষয়টি আমি বি স্তারিত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নামের নিবন্ধে আলোচনাও করেছি। আমার ডিজিটাল বাংলাদেশ বই-এর প্রথম অধ্যায়ে এই অভিধার স্বপ্নটি আমি ব্যাখ্যাও করেছি।
যাহোক, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ কিভাবে সম্পর্কিত সেটি নির্ধারণ করার বিষয়টি খুবই গুরুত্ব বহন করে। এজন্য আওয়ামী লীগের মূল ধারার রাজনীতির সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাকে সম্পৃক্ত করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল ভিত্তি সেটি। আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা ধারণার সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাকে যুক্ত করা। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সফল হয়েছি। বিগত দুই বছরে আমরা অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘একুশ শতকের সোনার বাংলা’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছি।
অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটিকে ঐতিহাসিকভাবেই বর্ণনা করা যায়। যদি এক কথায় বলতে হয় তবে অবশ্যই এই কথা বলতে হবে, সারা দুনিয়া কৃষি-শিল্প যুগ অতিক্রম করে ডিজিটাল যুগে পা দিয়েছে। দুনিয়াটাই ডিজিটাল পক্ষানেটে রূপান্তরিত হচ্ছে। আমরা দ্রুত ধাবিত হচ্ছি একটি ডিজিটাল সমাজের দিকে, যার পরিণতিতে একদিন সারা দুনিয়ায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। সারা দুনিয়ার উন্নত দেশগুলো ২০১৫ সালের মাঝে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের রূপরেখা তাদের সমাজকাঠামোতে দেখতে চায়। কিন্তু আমরা সেই স্বপ্নটা এত স্বল্প সময়ে দেখতে পারবো কিনা সেটি নিশ্চিত নই।
আমরা তাই উন্নত দুনিয়ার ডেটলাইনের পরেও আরও ছয় বছর বেশি সময় নিয়ে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়মত্মীতে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার রূপরেখা হাতে নিয়েছি। এর ফলে আমাদের হাতে একটি বেশ লম্বা সময় পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই লম্বা সময় কি আমরা এমনিতেই কাটিয়ে দেবো?
আমি মনে করি, সময়টা সুদীর্ঘ হলেও একে খুবই পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা দরকার। নইলে সময়টা কেটে যাবে অথচ কাজটা হবে না। ভালো কথা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে আইসিটি নীতিমালা প্রণীত হয়েছে তাতে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনাগুলো রয়েছে।
২০১০ সালে যখন সেই নীতিমালার পর্যালোচনা হচ্ছে তখন আবার বাছাই হচ্ছে কোন কাজটা কখন হবে। আমি সেই কর্মপরিকল্পনার দিকে না গিয়ে অন্তত এই সরকারের মেয়াদকাল ২০১৩ সাল পর্যন্ত কিছু অগ্রাধিকারের কথা বলতে চাই। কথায় বলে সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেবো কোথায়? এই প্রবাদের মানে দাঁড়ায়, আমাদের সব কাজই করা দরকার, কিন্তু কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা করব। এই বিষয়ে আমার স্পষ্ট বক্তব্য; আমরা যে যেখানে থেকে যতটা কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছি বা যতটা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি বা যতটা কাজ করা সম্ভব বলে মনে করছি, আমাদেরকে সেইসব কাজতো করতেই হবে।
আমার নিজের কাছে যে বিষয়টি খুবই জরুরি এবং বিশেষত আওয়ামী লীগের কাছেও যা খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার মতো বিষয় সেটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তার এই শাসন মেয়াদে ডিজিটাল বাংলাদেশের কোন কোন বিষয় দৃশ্যমান করতে পারবে বা কোন কোন বিষয় নিয়ে তাদের সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট হওয়া উচিত।
২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে শুধু একটি বাক্য লিখে দেশের নতুন প্রজন্মকে যেভাবে আকৃষ্ট করা গিয়েছিল সেভাবেই কি অস্পষ্ট ধারণা বা ছোটখাটো কোন কাজ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতি ২০১৪ সালের ভোটারকে আকৃষ্ট করা যাবে? এই প্রশ্নের জবাব সম্ভবত ‘না’।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, সেটি শুধু নির্বাচনে জেতার জন্য প্রস্ত্তত করা হয়। একটি গিমিক দেয়া বা এক ধরনের চমক লাগানোই এইসব ইশতেহারের প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে। কিন্তু আমি মনে করি, সেইসব যদি অতীতে ঘটেও থাকে তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আর যাই হোক আওয়ামী লীগকে মানুষ গিমিক বা চমক থেকে দূরে দেখতে চাইবে।
২০১০ সালের শেষপ্রান্তে বসে আমি এই কথাটি বলতে পারি, বিগত সময়ে নতুন সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার বাস্তবায়নে অবশ্যই অনেক কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যদি আর কোনো ব্যত্যয় না ঘটে এবং এই গতিতেও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ অব্যাহত থাকে তবে মেয়াদ শেষে মানুষের কাছে বেশ কিছু বিষয় দৃশ্যমান করা যাবে।
এরই মাঝে সরকার তার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে যুক্ত অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন সেল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কৌশলপত্র তৈরি করা হচ্ছে। কয়েকজন পরামর্শক এই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। অনেকের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং অনেকেই তাদের মূল্যবান মতামত দিচ্ছেন। আমি ঠিক জানি না, তারা কোথায় কিভাবে তাদের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করছেন।
হয়তো সেজন্যই আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানটি দিয়ে আমরা যা বোঝাতে চাই, তার সব বিষয় কি আমরা ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ দৃশ্যমান করতে পারব। আমার মতে, এর জবাবও ‘না’। আমাদের এত বেশি সম্পদ নেই যে সব কাজ একসাথে করা যাবে। আমি সেজন্য সবার আগে তিনটি বড় মাপের অগ্রাধিকারকে চিহ্নিত করতে চাই।
এই তিনটি অগ্রাধিকার হলো
০১. ডিজিটাল সরকার,
০২. ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা এবং
০৩. ডিজিটাল ভূমিব্যবস্থা।
তবে এই তিনটি খাতেরও সব কাজই এখন করা যাবে সেটিও না। যদিও এই তিনটি খাতকে ডিজিটাল করা গেলে আমাদের স্বপ্নের অনেকটাই পূরণ হবে তবুও এর মধ্য থেকে কিছু কিছু কাজকে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
ডিজিটাল সরকারের কথাই ধরা যাক। ডিজিটাল সরকারের পুরো কাজটা আমরা মাত্র তিন বছরে সম্পন্ন করতে পারব, এটি নয়। তবে এই সময়ে সরকারের তথ্য ডিজিটাল হতে পারে। সরকার কাজ করার ফাইল পদ্ধতি বদলাতে পারে। এই সময়েই সরকার তার নিজের কাজ করার ডিজিটাল পদ্ধতি থেকেই জনগণকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা দিতে পারে।
এই তিন বছরে সরকারকে শিক্ষার খোল নলচে বদলাতে হবে। একদিকে শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত হতে হবে ডিজিটাল দুনিয়ার, অন্যদিকে ক্লাসরুমে কমপিউটার যেতে হবে। কমপিউটার শিক্ষিত জাতির পাশাপাশি ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে শিক্ষা দেবার দৃঢ় অঙ্গীকার সরকারকে নিতে হবে। এই সময়ে আমরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কমপিউটারাইজড করতে পারব না। ওদের সবার জন্য কমপিউটার ল্যাব গড়ে তোলাই প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এই সময়ে আমরা শিক্ষার কনটেন্টকে ডিজিটাল করতে পারব। সরকারের উচিত সরকারি বা বেসরকারি বা পিপিপি মডেলে শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত ডিজিটাল করা।
এই সময়ের একটি বড় অঙ্গীকার হওয়া উচিত ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল করা। এজন্য ভূমি রেকর্ডকে স্ক্যান করে ডিজিটাল উপাত্তে রূপান্তর করা যায়। যদি আমরা মনে করি ব্রিটিশ আমল থেকে বিদ্যমান সব উপাত্তকেই ডিজিটাল করা হবে তবে হয়তো কঠিন হয়ে যাবে। আমরা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পরের সব উপাত্তকে ডিজিটাল করতে পারি। ভূমির জরিপ ডিজিটাল হতে পারে। ভূমির মানচিত্র, মৌজা, পরচা, খতিয়ান ইত্যাদি ডিজিটাল হতে পারে। ভূমির নিবন্ধন ও মালিকানা ডিজিটাল হতে পারে। তবে ভূমির একটি বড় সমস্যার নাম হলো ভূমি ব্যবস্থাপনা তিনটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা। এর সমাধান হিসেবে ভূমির নিয়ন্ত্রণের তিনটি মন্ত্রণালয়কে একটি জায়গায় এনে তাকে ডিজিটাল করা যায়।
আমার জানা মতে, সরকার শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। তবে শিক্ষার কনটেন্ট তৈরি করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগের খবর আমি জানি না। ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজ করার বিষয়েও সরকারের উদ্যোগ লক্ষ করার মতো। তবে সরকারকে ডিজিটাল করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগের খবরও আমরা এখনও পাচ্ছি না।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com