বিশ্বভ্রমণ শেষে এখন মহাকাশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন ধনকুবেররা। আর এই সুযোগটিই লুফে নিতে এগিয়ে আসছে বোয়িংয়ের মতো বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠান। গত সেপ্টেম্বরেই বোয়িং ঘোষণা দিয়েছে, তারা মহাকাশ প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। অর্থাৎ বাণিজ্যিকভিত্তিতে মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ করে দেবে। তাদের বিশ্বাস, ভবিষ্যৎ পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে মহাকাশে। এটাকে বলা হচ্ছে স্পেস ট্যুরিজম। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে ২০১৫ সাল নাগাদ বোয়িংয়ের প্রথম ‘স্পেস ট্যাক্সি’ পর্যটক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে রওনা হবে মহাকাশের পথে। এই স্পেস ট্যাক্সি যে আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার হওয়া পরিবহনের মতো ভিড়ে ঠাসা হবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এতে বহন করা যাবে ৭ জন আরোহী, যাদের মধ্যে থাকবেন অন্তত ৩ জন পেশাজীবী নভোচারী।
ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্রানসন সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করেন, মহাকাশই হবে পরবর্তী রণক্ষেত্র। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ভার্জিন গ্যালাকটিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যারা ২০১২ সাল নাগাদ পরীক্ষামূলকভাবে বিশ্বের বায়ুমন্ডল ভেদ করে বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এ রকম পরিকল্পনা রয়েছে আরো বহু প্রতিষ্ঠানের। তাই এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, আগামী এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর আশপাশের মহাকাশ হয়ে উঠবে পর্যটকে ভারাক্রান্ত। যদিও ইতোমধ্যেই মহাকাশের ওই সব এলাকা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে- মানুষ নয়, যন্ত্রপাতির বর্জ্যে। ওই সব বর্জ্যের পরিমাণ এতই বেশি যে, ঈদে ঘরেফেরা মানুষ নিয়ে যাত্রা করা ট্রেনকেও ফাঁকা মনে হবে। তাই ই-ওয়াস্ট বা ই-বর্জ্যের পাশাপাশি এখন ভাবতে হবে অরবিটাল ডেব্রিশ বা মহাকাশ বর্জ্য নিয়ে।
কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো কেউ এখন পর্যন্ত ওই সব বর্জ্য অপসারণের উদ্যোগ নেয়নি। বর্জ্যের কারণে যে কেবল মহাকাশ পর্যটকরা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন তাই নয়, এটা মহাকাশে ভ্রাম্যমাণ স্যাটেলাইটগুলোর জন্যও বয়ে আনতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়। আমাদের বায়ুমন্ডলের চারদিকে অন্তত ৫ লাখ বস্ত্ত অত্যন্ত দ্রুত ভেসে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে অতীতে পরিচালিত বিভিন্ন মহাকাশ মিশন ও স্যাটেলাইটের নাট-বল্টু, ধাতব ভাঙ্গা টুকরা, প্লাস্টিক ইত্যাদি। এগুলো সবই এক ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। এই সব নাট-বল্টু ও অন্যান্য বর্জ্য ঘণ্টায় ৪০ হাজারেরও বেশি গতিতে মহাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। এত গতিতে চলমান কোনো বস্ত্ত যদি মহাকাশযান বা কোনো স্যাটেলাইটে আঘাত করে তাহলে কি ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। দুর্ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়। বড় ধরনের বিপর্যয় অবশ্য এখনো লক্ষ্য করা যায়নি। তবুও বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতের স্বার্থেই ভাবতে হচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাকে।
গত ফেব্রুয়ারিতেই এমন এক মহাবিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছিল। মেয়াদোত্তীর্ণ একটি চাইনিজ রকেটের সাথে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির একটি মহাকাশযান এনভিসেট অল্পের জন্য সংঘাত এড়াতে সম্ভব হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির দেয়া ট্র্যাকিং তথ্যে দেখা যায় মাত্র ১৬০ ফুট দূর দিয়ে বস্ত্ত দুটি একে অপরকে অতিক্রম করেছে। ইউরোপের মহাকাশযানের ওজন ছিল ৮ টন এবং পুরনো চাইনিজ রকেটের ওজন অন্তত ৩ দশমিক ৮ টন। বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করা যায়, দুটি বুলেট ট্রেন একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার একেবারে শেষ মুহূর্তে সংঘাত এড়াতে সম হয়। শেষ পর্যন্ত সংঘাত হলে ঘটে যেত মহাবিপর্যয়। টনকে টন ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়তো আমাদের বায়ুমন্ডলের উপরিভাগে। আর এই সংঘাতের চেন রিঅ্যাকশন ঘটতো অন্যান্য অঞ্চলেও। একেবারে শেষ পর্যায়ে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা তাদের মহাকাশযানটি সামান্য সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। আর এ কারণেই রক্ষা পাওয়া যায় সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে।
এখন সময় এসেছে এসব ঝুঁকি থেকে আমাদের স্যাটেলাইট এবং মহাকাশযান ও তাতে অবস্থানকারীদের রক্ষা করার। ঝুঁকি যদি থেকেই যায়, তাহলে মহাকাশ পর্যটনের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হবে না এবং স্যাটেলাইটগুলো থেকে যাবে সর্বক্ষণিক ঝুঁকির মধ্যে। এ অবস্থার উত্তরণে প্রথমে যে বিষয়টি করার কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা তা হচ্ছে- ঘুরে বেড়ানো বস্ত্ত শনাক্ত করা এবং বস্ত্তর গতি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এর পর সেটিকে ধ্বংস করা। এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই আদি যুগে।
নাসা ইতোমধ্যেই চালু করেছে অরবিটাল ডেব্রিশ প্রোগ্রাম। এর লক্ষ্য হচ্ছে মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ বস্ত্ত সন্ধান করা এবং সেগুলো ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা। এখনই এ প্রকল্পের আওতায় বস্ত্ত ধ্বংস করা শুরু হচ্ছে না। এখন কেবল বস্ত্ত শনাক্তকরণ, তার গতিবেগ নির্ণয় এবং ঝুঁকি এড়ানোর উপায় নিয়ে কাজটি চলছে।
কিভাবে মহাকাশের বর্জ্য অপসারণ করা যায় তা নিয়ে বহু ধারণা রয়েছে। তবে এখনই এসব বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব নয়। রকেট ডিজাইনার জিম হলোপিটার পরামর্শ দিয়েছেন, রকেটের মাধ্যমে বর্জ্যের ওপর পানি নিক্ষেপ করে তাদেরকে বায়ুমন্ডলের নিচের দিকে নামিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া যেতে পারে। অনেকে মনে করছেন লেসার ব্যবহার করে কাজটি করা যেতে পারে।
বিষয়টি যত সহজ মনে হচ্ছে বাস্তবে তা নয়। কারণ এমন বহু বর্জ্য রয়েছে যার আকার অত্যন্ত ছোট এবং চিহ্নিত করা সহজ নয়। এদের কিছুতে ধারণ করাও প্রায় অসম্ভব। তাহলে এদের ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়? যদিও বড় আকারের বর্জ্য খুঁজে পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ এবং এগুলো ধ্বংস করাও অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। এগুলোকে মহাকাশে রেখেই ধ্বংস করা হবে। ভবিষ্যতে যাতে এসব বর্জ্যের সংখ্যা আর না বাড়ে সে জন্য এখনই নীতিমালা করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মহাকাশে কোনো স্যাটেলাইট পাঠানোর আগে নিশ্চিত করতে হবে, তারা ওই স্যাটেলাইটের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সেটি ধ্বংস করে দেবে।
মোট কথা, আমাদের ভবিষ্যতের স্বার্থেই মহাকাশকে করতে হবে জঞ্জালমুক্ত। নইলে মহাকাশে ভেসে বেড়ানো হাজার হাজার স্যাটেলাইট যেমন বিপর্যয়ের শিকার হবে, তেমনি মহাকাশ পর্যটনের যে অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। সব কাজ করতে ব্যবহার করতে হবে নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তির যে অগ্রগতি চলছে তাতে এ আশা করাই যায়, আগামী দিনগুলোতে প্রযুক্তিই আমাদের পৌঁছে দেবে অভীষ্ট লক্ষ্যে। বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করে কমপিউটারের মাধ্যমে মহাকাশে ভেসে বেড়ানো বস্ত্ত শনাক্তকরণ এবং সেটি ধ্বংসের যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে। বিজ্ঞানীরা সেই বিষয়টি নিয়েই কাজ করছেন।
তারা বলছেন, মহাকাশের বর্জ্য অপসারণের জন্য মহাকাশে যাবার প্রয়োজন হবে না। পৃথিবীতে বসেই বিশেষ কমপিউটার সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটি অনায়াসে করা যাবে। আর এটি করতে পারলেই ঝুঁকিমুক্ত হবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ স্যাটেলাইট এবং মহাকাশ পর্যটন। ধনকুবের পর্যটকরা সহজেই বিশ্বের বায়ুমন্ডলে ঘুরে দেখতে পারবেন বিশ্বের আদ্যপান্ত।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com