বহুদূর এগিয়ে গেছে রোবটপ্রযুক্তি। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রে যেমনটি দেখা যায়, বাস্তবে তেমনটি ঘটার সময় হয়তো ঘনিয়ে এসেছে। অন্তত রোবট গবেষকদের কর্মতৎপরতায় তেমনটিই মনে হচ্ছে। বহু ধরনের রোবট ইতোমধ্যেই উদ্ভাবিত হয়েছে এবং প্রায় প্রতিদিনই নানা রোবটের কথা জানা যাচ্ছে। এখন সর্বশেষ যে রোবটের কথা গবেষকরা বলছেন, সেটি হচ্ছে এমন রোবট যা মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারবে। অর্থাৎ মানুষ কোনো খবরে খুশি হলো, নাকি কষ্ট পেলো তা মানুষের মুখভঙ্গি মনিটরের মাধ্যমে রোবট বলে দিতে পারবে। একই সাথে সে বুঝতে পারবে তার নিজের কাজ গ্রহণযোগ্য, নাকি যথাযথ হচ্ছে না। এ কাজটি করতে গিয়ে সে ব্যবহার করবে একাধিক ক্যামেরা। গবেষকরা জানিয়েছেন, এই রোবটের নকশা তারা ইতোমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন।
রোবটপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন এমন গবেষকরা মনে করেন, ভবিষ্যতে হয়তো এমন রোবট এসে যাবে যারা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা না করে নিজেদের মতো করেই কাজ করে যাবে। একসময় হয়তো তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলে যাবে সারাবিশ্ব। তবে সেদিন আসতে এখনো নিশ্চয়ই ঢের বাকি।
বিজ্ঞানীরা এখন যে কাজটি করছেন সেটি হলো রোবটের প্রোগ্রামিং তৈরি করা। যাতে করে বোঝা যায় যে কখন তারা কোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হলো। এটা করা গেলে দীর্ঘ মেয়াদে রোবট এবং মানুষের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার বিষয়টি সহজ হবে। আর তাই আজকের দিনে মানুষের সাথে মানুষের যে সহজ মেলামেশা, রোবটের সাথেও তেমন স্বাভাবিক মেলামেশা সম্ভব হবে। রোবটকে তখন কেবল যন্ত্র বলে মনে হবে না।
জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির রোবট গবেষক অ্যারন বোবাইক বলেছেন, আমরা রোবটকে মানুষের পৃথিবীতে মিশিয়ে দিতে চাই। যাতে করে রোবটরা মানুষের সাথে মিলে কাজ করে যেতে পারে এবং মানুষও যাতে তাদেরকে আপন করে নেয়, যেমনটি ঘটছে আজকের মানুষের বেলায়।
নতুন গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির রোবট বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেয়া থমাসের ল্যাবরেটরির রোবট সায়মনকে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে করে মানুষ এবং রোবটের মিথস্ক্রিয়া সবই উদ্ঘাটন করা যায়।
বোবাইক বলেছেন, সায়মন একটি হিউম্যানয়েড টরসো রোবট। আকৃতি ছোটই। দেহের নিচের অংশের তুলনায় মাথাটা বেশ বড়। সায়মন তার কাজ চলা অবস্থায় সাফল্যের সাথে কারো দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয় কি-না গবেষকরা সেটাই দেখতে চাইছেন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বোবাইক বলেন, মানুষ সব সময়ই নানা ধরনের কাজ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে সেলফোনে কথা বলা, নানা ধরনের খেলাধুলা ইত্যাদি। সায়মন মানুষের ওই সব কাজের মধ্যেই হাত নেড়ে বা অন্য কোনো উপায়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে কি-না সেটাই দেখা হবে। কমপিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে মনিটর করা হবে যে, রোবটটির পক্ষে সত্যি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভব হলো, নাকি সম্ভব নয়।
বোবাইক বলেন, সায়মন হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের আগে কোনো ব্যক্তির দিকে বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে এবং হাত নাড়ার পর তাকিয়ে থাকে ৩ সেকেন্ড। এ সময় মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখে যে, মুখভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসে কি-না বা তার দৃষ্টি আকর্ষণে মানুষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় কি-না। মানুষ পাল্টা হাত নেড়ে কিংবা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
নিজের ক্যামেরা ব্যবহার করে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে সায়মন সঠিকভাবে বলে দিতে পেরেছে যে, সে কারো দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম, নাকি সক্ষম হয়নি।
টেকনিউজডেইলিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বোবাইক বলেছেন, বয়স্কদের কাজে সহায়তা করতে কিংবা পণ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারীদের কাজে সহায়তার ক্ষেত্রে রোবট এবং মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ আবশ্যক। এটা করা গেলেই দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি হয় এবং কাজে সমন্বয় হয়, উৎপাদন বাড়ে।
বোবাইক বলেন, মানুষের আচরণ আসলে জটিল একটি বিষয়। সে কখন কী ধরনের আচরণ করবে তা আগে থেকে ধারণা করা প্রায় অসম্ভব। তাই রোবটকে দিয়ে মানুষের আচরণ মনিটর একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তার সহকর্মী গবেষকরা সে কাজটিই করে যাচ্ছেন। তারা ইতোমধ্যেই সায়মনের দৃষ্টি আকর্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রথমবার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম না হলে সায়মন কী করবে সেটাই এখন দেখা হচ্ছে। এমনও হতে পারে যে, প্রথম দফায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে সায়মন হয়তো আবার হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এভাবে কতবার সে কাজটি করবে গবেষণার এখনকার বিষয় সেটিই।
এ কাজটি করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় গবেষকদের পড়তে হচ্ছে সেটি হলো সায়মনের মোশন বা চলার গতি প্রকৃত মানুষের মতো নয়। মানুষ সাধারণত যে গতিতে চলাচল করে, সায়মনের গতি তার চেয়ে অনেক বেশি ধীর। তাই রোবট এবং মানুষের আচরণগত পরিবর্তন মনিটর করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। সায়মন যদি মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে তাহলে তাদের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া নির্ণয় করা সহজ হবে। বোবাইক এবং তার সহকর্মীরা এ বিষয়ে তাদের গবেষণা ফল সম্প্রতি উপস্থাপন করেছেন সুইজারল্যান্ডের লওসানে হিউম্যান রোবট ইন্টারেকশন কনফারেন্সে।
এদিকে ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তৈরি করেছেন শিশু রোবট, যে কি-না চলাচল করে ক্রলিং করে বা পিছলে। এ কাজে গবেষকরা ব্যবহার করেছেন বিশেষ ধরনের কমপিউটার প্রোগ্রাম। এ রোবট কোনো বস্ত্ত খুঁজে বের করতে এবং ক্রলিং করে বস্ত্তর কাছে যেতে সক্ষম হচ্ছে। যেসব রোবট দিয়ে যথাযথ কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না, সেসব রোবটের স্থান দখল করবে এসব আধুনিক রোবট।
গবেষকরা বলছেন, যেসব রোবট নিজেদের দেহের রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম তারা দ্রুত হাঁটতে শেখে এবং চলাচলের গতিতে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
কমপিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং এই গবেষণার প্রধান গবেষক জশুয়া বোনগার্ড বলেছেন, তারা জানতে পেরেছেন আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে এমন রোবট উৎপাদন খুব সহজ। তিনি এবং তার সহকর্মীরা ভার্চুয়াল রোবট তৈরির পাশাপাশি একটি সত্যিকারের রোবটও তৈরি করেছেন। এই রোবট পা ছাড়া সাপের মতো অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে একটি চারপেয়ে বা চতুষ্পদ প্রাণীতে পরিণত হতে পারে।
তিনি বলেন, আপনি যদি সাপ হন তাহলে আপনার পক্ষে শেখা সহজ হবে যে পা ছাড়া কীভাবে হাঁটতে হয়। ফলে হাঁটতে গিয়ে আপনি পড়ে যাবেন না। সাপ যখন একবার শিখে যায় যে কীভাবে হাঁটতে হয় তখন সে মস্তিষ্কের সঙ্কেত ব্যবহার করেই হাঁটার কাজটি করে।
এই রোবট তৈরির আগে বোনগার্ড এবং তার সহকর্মীরা তৈরি করেছেন একাধিক সিমুলেটেড রোবট। এদের প্রত্যেককে দেয়া হয়েছে ভার্চুয়াল মস্তিষ্ক এবং দেহ। বোনগার্ড বলেন, রোবটগুলোর মস্তিষ্ক খুবই সাধারণ। যেখানে মানুষের মস্তিষ্কে ১০ হাজার কোটি নিউরন বা স্নায়ুকোষ থাকে, সেখানে ওই সব রোবটের রয়েছে মাত্র কয়েক ডজন নিউরন। ভার্চুয়াল রোবটের দেহ এবং আজকের দিনের বাস্তব রোবটের দেহের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ভার্চুয়াল রোবট তার ভার্চুয়াল বিশ্বে দেহ পরিবর্তন করে চলাচল করতে পারে।
বোনগার্ড বলেন, কিছু রোবট তার লক্ষ্যের দিকে ছুটতে শুরু করার সময় সাপের মতো করে পিছলে চললেও সেটি লক্ষ্যে পৌঁছার আগেই তাদের চারটি পা গজায় এবং ছুটতে থাকে অনেকটা কুকুর বা ঘোড়ার মতো করে। এমন ৫ হাজার সিমুলেশনের পর গবেষক দল খুঁজে পায় যথাযথ রোবটটি। বিষয়টিকে কেবল তাত্ত্বিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে তারা লেগো মাইন্ডস্ট্রম কিট ব্যবহার করে তৈরি করেন একটি বাস্তব রোবট। এর রয়েছে চারটি পা এবং এটি পেট দিয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে পারে। ফলে যখন যে ধরনের চলাচল দরকার এই রোবট সেটি যথাযথভাবেই করতে পারে। প্রসেডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com