লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
সালেহ উদ্দীন মাহ্মুদ
মোট লেখা:৪
লেখা সম্পর্কিত
ইন্টারনেট আসক্তি নিরূপণ ও দূরীকরণ
ইদানীং আমরা বিভিন্ন ধরনের আসক্তির কথা শুনে আসছি। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মাদকাসক্ত। কিন্তু এর পাশাপাশি আরেক বিষয়ে আসক্তিতে আমাদের তরুণ সমাজকে নিমজ্জিত হতে দেখা যাচ্ছে ব্যাপকভাবে, যা ইন্টারনেট বা কমপিউটার আসক্তি হিসেবে পরিচিতি পায়। হতে পারে এ আসক্তি মাদকাসক্তির মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং মানসম্মান হানিকর নয়, তবু তা এক ধরনের আসক্তি।
এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, আসক্তি বলতে কী বুঝি? সহজ কথায় আসক্তি বলতে বুঝায় যেকোনো বস্ত্ত বা বিষয়ের প্রতি প্রচন্ডভাবে দীর্ঘস্থায়ী আসক্তিকে। হতে পারে তা মাদক বা অন্য কোনো ড্রাগ বা ইন্টারনেট ও কমপিউটারসংশ্লিষ্ট বিষয়ে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আসক্তি হলো চিকিৎসাযোগ্য দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ব্যাধি। যারা কোনো কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়েন, তখন তারা তাদের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। হতে পারে তা অ্যালকোহল বা অন্য কোনো ড্রাগ। কিংবা হতে পারে তা বৈধ সামাজিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। অন্যভাবে বলা যায়, আসক্তি হলো কোনো বস্ত্তর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া, যেমন মাদকাসক্ত বা আচরণগত আসক্তি, জুয়া খেলা বা কমপিউটার বা ইন্টারনেট নিয়ে মেতে থাকা।
এ কথা সত্য, কমপিউটার ও ইন্টারনেট আসক্তিতে আমাদের তরুণ সমাজ এখন যেভাবে নিমজ্জিত হতে শুরু করছে, যা আমাদের দেশের সচেতন অনেক অভিভাবককে কিছুটা ভাবিত করেছে। আবার অনেক অভিভাবক নিজেদেরকে সাত্বত্মনা দেন এই বলে যে, তাদের সন্তান খারাপ সঙ্গে নেই, ইন্টারনেটে ব্যতিব্যস্ত থাকছে, যা মন্দের ভালো। তবে যাই হোক, কমপিউটার ও ইন্টারনেটে আসক্ত হওয়া এখন এক মারাত্মক সমস্যায় পরিগণিত হয়েছে।
ইন্টারনেট বা কমপিউটারের ব্যাপক ব্যবহারকে মনস্তত্ত্ববিদদের অনেকেই আসক্তি হিসেবে মানতে চাইবেন না। অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত মনোচিকিৎসক গবেষক এ নিয়ে কাজ করছেন। ইন্টারনেট আসক্তের অফিসিয়াল স্ট্যাটাস কী, তা কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। কেননা কম-বেশি সবাই জানেন, ইন্টারনেট আসক্তদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
অ্যালকোহল, কোকেন প্রভৃতি মাদকদ্রব্য যেভাবে মানুষের ব্রেন বা মস্তিষ্ককে বদলে দেয় বা প্রভাবিত করে, অনুরূপ এক লিঙ্ক এই প্রথম আবিষ্কৃত হয় যে ইন্টারনেট আসক্ত মানুষের ব্রেনকে বদলে দেয় বা প্রভাবিত করে। কৈশোর বয়সে যারা অনেক সময় কাটান ইন্টারনেটে, তাদের মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা উন্মোচন করার জন্য এমআরআই (MRI) স্ক্যানার ব্যবহার করেন গবেষকেরা। ব্যবহারকারীর সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবন পর্যবেক্ষণ করেন। গবেষকেরা বলেন, এতে তারা খুঁজে পেতে পারেন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অন্যান্য আচরণগত সমস্যা, যার মাধ্যমে চিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
ইন্টারনেট আসক্তি শনাক্তকরণ ও সমাধান
ইন্টারনেট আসক্তির সমস্যা শনাক্ত করতে নিচের কয়েকটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে :
০১. অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি সময় কমপিউটারের সাথে সময় কাটানো :
ইন্টানেট বা কমপিউটারের আসক্তের প্রথম লক্ষণ হলো- অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সময় কাটানো, হতে পারে তা পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সাথে। অনলাইনে অনেক বেশি সময় কাটানোর কারণে যদি আপনার তেমন কোনো বন্ধু না থাকে, তাহলে আপনার উচিত হবে ব্রাউজার ও প্রফেশনাল কাজের জন্য অ্যাপয়েনমেন্ট বুক বন্ধ করা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় ফোনবুকের পেপার ভার্সন ব্যবহার।
০২. নিজের সীমা মেনে চলা :
ব্যক্তিজীবনের সাথে মেলাতে মেনে চলতে হয় এক সীমারেখা। এ বিষয়টি যখন ব্যর্থ হয়, তখন তা রূপ নেয় আসক্তের। এ বিষয়টিকে আরো সহজভাবে বলা যায় এভাবে- ধরুন, আপনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন এক ঘণ্টার বেশি সময় ইন্টারনেটে থাকবেন না বা গেম খেলবেন না। কিন্তু অনলাইন থেকে সরে আসলেন যখন, বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনটি যদি প্রায় হয়, তাহলে আপনি সমস্যায় পড়েছেন। এই আত্মপ্রবঞ্চনা হলো ইন্টারনেট আসক্তির স্পষ্ট লক্ষণ।
০৩. আপনার কমপিউটারের ব্যবহার নিয়ে অন্যদের মিথ্যা বলা :
দুই নম্বর ধাপটি আত্মপ্রবঞ্চনামূলক। আর এ ধাপটি হলো অন্যদেরকে মিথ্যা বলা। বিশেষ করে যারা কমপিউটার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চান বা নজর রাখলে মিথ্যা বলা। যদি বুঝতে পারেন সে মিথ্যা বলছে, তাহলে তার ওপর কঠোর দৃষ্টি রাখুন বা শাসন করুন।
০৪. কমপিউটার ও ইন্টারনেট ছাড়া জীবন অচলবোধ করা :
যদি আপনি মনে করেন, ইন্টারনেট ছাড়া কয়েক ঘণ্টার বেশি সময় থাকতে পারবেন না, তাহলে বুঝতে হবে আপনি ইন্টারনেট আসক্তিতে ভুগছেন। যদি আপনি অফলাইনে কাজ করতে পারেন তাহলে তা অন্য কাউকে দিয়ে অনলাইনে এক্সিকিউট করতে পারেন। ধরুন, আপনি একটি আর্টিকেল লিখলেন এবং কাগজে এবং অন্য কাউকে দিয়ে টাইপ করিয়ে পোস্ট করলেন। এভাবে নিজেকে ইন্টারনেট ও কমপিউটার আসক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন।
০৫. নির্ভরশীলতা :
যদি কোনো কারণে কমপিউটার অকেজো হয়ে পড়ে, তখন অনেক ব্যবহারকারী উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন এবং নতুন কমপিউটার কেনার জন্য বা মেরামত করার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এমন ঘটনাকেও কমপিউটারের প্রতি আসক্তি বলা যায়।
সমাধান
সমাধান আপনার নিজের হাতে। সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার পারিবারিক সাপোর্ট। যদি সমস্যা সমাধানে নিশ্চিত হতে না পারেন তাহলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। ইন্টারনেট ও কমপিউটার আসক্তজনের সমস্যা সমাধানের নিম্নলিখিত কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে :
০১. কমপিউটার ব্যবহার সীমিত করা :
কমপিউটার ব্যবহারে আপনার অভ্যাস পরিবর্তন করার কোনো নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। আপনাকেই নির্দিষ্ট করতে হবে কমপিউটার ব্যবহারের সীমারেখা। এখন থেকে কতক্ষণ কমপিউটার ব্যবহার করবেন? কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন? এসব বিষয় প্রথমে নির্দিষ্ট করুন। তারপর কাজে নেমে পড়ুন।
০২. বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের পাশে রাখুন :
ইন্টারনেট বা কমপিউটার ব্যবহারে আপনার পরিবারের সদস্যরা যাতে নজর রাখতে পারেন তা নিশ্চিত করুন এবং অনলাইনে কতক্ষণ থাকবেন তাও নিশ্চিত করুন। কমপিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সময় বেঁধে দিন এবং কোনো অজুহাতকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না।
০৩. পাসওয়ার্ড সেট করা :
কমপিউটার বা ইন্টারনেট আসক্তি থেকে পরিত্রাণের জন্য আপনার বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের সদস্যরা যদি সম্মতি দেন, তাহলে তাদেরকে আপনার কমপিউটারের পাসওয়ার্ড, ইউজার অ্যাকাউন্ট, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করতে দিন। এ কাজটি করতে হবে আত্মপ্রবঞ্চনার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। এরপরও যদি আপনি পাসওয়ার্ড ভাঙতে সক্ষম হন, তাহলে তা হবে নির্মম।
৪. আমোদ-প্রমোদের জন্য কমপিউটারের ব্যবহার পরিহার করুন :
কমপিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানসিক চাঞ্চল্য উদ্রেককারীর বিষয় এড়িয়ে যান। কমপিউটার ও ইন্টারনেটকে ব্যবহার করুন ব্যবসায়িক কাজে এবং ই-মেইল চালাচালির জন্য। কমপিউটার গেম আনইনস্টল করুন। সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক ওয়েবসাইট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখুন। ইন্টারনেটের বিনোদনকে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবজীবনের বিনোদনমূলক কার্যকলাপ দিয়ে প্রতিস্থাপন করুন।
০৫. অগ্রগতির প্রতি লক্ষ রাখুন :
ইন্টারনেট আসক্তি থেকে নিজেকে কতটুকু সরিয়ে আনতে পেরেছেন তা পরখ করার জন্য অনলাইনে থাকার জন্য বেঁধে দেয়া সময়ের সাথে ব্যবহার করার সময় তুলনা করে দেখুন। প্রথম দিকে সেট করা ১০ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ৮ ঘণ্টা ব্যবহার করুন। এরপর ধীরে ধীরে সময় আরো কমিয়ে আনুন।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : iamfusher@hotmail.com