লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
ওয়াশিকুর রহমান শাহিন
মোট লেখা:৩
লেখা সম্পর্কিত
ডিএনএ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং : মানব সম্পর্কে নতুন মাত্রা
ডিএনএ শব্দটির সাথে প্রায় সবারই কমবেশি পরিচয় রয়েছে। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সাইটের কথাও জানি এবং ব্যবহার করছি। কিন্তু এই দুটির সমন্বয়ে গঠিত ডিএনএ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের বিষয়ে ধারণা নেই বললেই চলে। ভবিষ্যতে ডিএনএ এবং সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সংমিশ্রণ ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমানে ফেসবুকের সাথে নির্দিষ্ট বিষয় কিংবা ঘটনার কারণে একত্রিত হয়ে একটি দল গঠন করে যোগাযোগ স্থাপন করে চলেছি। ঠিক তেমনিভাবে এই সামাজিক ডিএনএ নেটওয়ার্ক সাইটের মাধ্যমে আপনি এবং আপনার সাথে যারা যুক্ত রয়েছেন, তাদের সবার বিস্তারিত বংশানুগতি সম্বন্ধীয় তথ্য জানা সম্ভব হবে এবং তাদের সাথে আপনার সম্পর্কের বিষয়টিও নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।
সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্কের সহজ ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বখ্যাত ওয়্যার্ড (Wired) ম্যাগাজিনের সম্পাদক ডেভিড রাওয়ান। তিনি লিখেছেন, আমি আমার ইনবক্সে প্রায় ত্রিশোর্ধ্ব এক অবার্ন (Auburn-Reddish brown) চুলের অধিকারিণী আমেরিকান মহিলার ছবিসহ একটি মেসেজ পেলাম। তার নাম অ্যালিসন। সে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, কারণ আমার ডিএনএ প্রোফাইলে ষষ্ঠ সেগমেন্ট তার সাথে .৬২ শতাংশ মিলে গেছে এবং আমরা দূর সম্পর্কের চাচাত বা মামাত ভাইবোন হতে পারি। এ ধরনের একটি মেসেজ পেলে আমরা যেকেউ অবাক হব বা আমরা নিজেরা এ ধরনের একটি মেসেজ দিয়ে অন্য কাউকে অবাক করে দিতে পারি। এটি অনেকটা ফেসবুকের ‘পিপল ইউ নো’ ধরনের ঘটনা। হ্যাঁ, ডিএনএ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এই অবাক ব্যাপারটিই ঘটাতে যাচ্ছে। ডেভিড রাওয়ানের বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্কিং কেমন হবে। ফেসবুক বা এ জাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর মাধ্যমে নতুন বন্ধু তৈরি করা যায়, আবার অনেক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো বন্ধু বা স্কুলজীবনের কোনো বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যায়। পরিচিত আত্মীয়-পরিজনকেও নিজের নেটওয়ার্কে আনা যায়। কিন্তু সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্ক আপনার অনেক হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়কেও খুঁজে বের করবে।
বর্তমানে আমাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় দাদা বা নানার বাবার নাম, তাহলে আমরা অনেকেই বলতে পারব না। যদি আরেকটু কঠিন করে জিজ্ঞেস করা হয়, দাদা বা নানার বাবার বাবার নাম কী? তাহলে ক’জন নামটি বলতে পারবেন সন্দেহ আছে। আর দাদা বা নানার বাবা কিংবা প্রপিতামহ বা প্রমাতামহের ভাইবোনের ঘরের ছেলেমেয়েদের তো চিনিই না। কিন্তু সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্ক সেটিই খুঁজে বের করবে। আপনি হয়ে যেতে পারেন বিখ্যাত কোনো লেখক-বিজ্ঞানী-সেলিব্রিটির আত্মীয়। হ্যাঁ, সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্ক এমনই একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করছে বা করবে।
সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্ক গঠনে যারা এগিয়ে
Ancestry.com ও GeneTree.com অনেক দিন আগে থেকেই শুরু করেছে ডিএনএ দিয়ে পূর্বপুরুষ খোঁজার কাজ। একবার আপনার নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, আর ডিএনএ তাদের সিস্টেমে দিয়ে দিতে পারলেই শুরু করতে পারেন ডিএনএ ম্যাচ-মেকিং গেম। এনসেস্ট্রিতে আপনি ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করতে পারেন। GeneTree.com আরেকটি ওয়েবসাইট, যারা সারা বিশ্বে ডিএনএ ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফ্যামিলি ট্রি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠাতা লেভয় সোরেনসন মলিকিউলার জেনোলজি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখের বেশি ডিএনএ স্যাম্পলের ডাটাবেজ তৈরি করেছে।
এদিকে সার্চ জায়ান্ট গুগলও পিছিয়ে নেই। অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে গুগলের উদ্যোগ না হলেও গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনের স্ত্রী Ann Wojcicki প্রতিষ্ঠা করেছেন 23andme.com। এটি শুধু আপনার জেনেটিক আত্মীয়কেই খুঁজে বের করবে না, এটি বলতে চেষ্টা করবে আপনি কেন বাদামি চুল কিংবা স্বভাব কেনো এমন, আপনার কোনো ধরনের স্কিন ক্যান্সার না পারকিনসনসে ভোগার সম্ভাবনা আছে কি না? এদের মাধ্যমেও আপনি ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করতে পারবেন কিংবা সারা বিশ্ব থেকে আপনার জেনেটিক আত্মীয়দের খুঁজে বের করে সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞেরা আসলে যুদ্ধ, হানাহানি, বৈষম্যের এই সময়ে সোশ্যাল ডিএনএ নেটওয়ার্ক দিয়ে সারা বিশ্বকে একটি আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত করতে চাইছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই শুধু পারে সভ্যতাকে আরো একধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কখনই খারাপ নয়। এটা খারাপ শুধু তখনই হয়, যখন এটাকে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে।
এ ধরনের প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খরচের বিষয়টি। কিন্তু বিশেষজ্ঞেরা বলছেন আগের তুলনায় ডিএনএ টেস্ট করা অনেক সহজ এবং সাশ্রয়ী হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই এই খরচ আরও কমে আসবে। ফলে সর্বস্তরে এর ব্যবহার অনেক সহজ এবং কার্যকর করা যাবে। এই প্রেক্ষাপটে বিখ্যাত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং গবেষক ভিভেক ওয়াধা কিভাবে এর মাধ্যমে সাহায্য পাওয়া যাবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জানান, হিউম্যান জিনতত্ত্ব প্রকল্পের ফলে এখন যেমন রক্তের গ্রম্নপ বের করা খুব সহজ এবং সস্তা, তেমনি সহজ ও সস্তা হয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে হিউম্যান জিনোম সিকোয়েন্স বের করা। এখন আমরা যদি ফেসবুকের মতো কোনো সামাজিক নেটওয়ার্ক মাধ্যমকে ব্যবহার করে সবার ডিএনএগুলোকে এর মধ্যে যোগ করি, তাহলে আমরা যে আনন্দ উপভোগ করব তা ডিজনিল্যান্ডের আনন্দকেও হার মানিয়ে দেবে। এখনকার মতো তখনো অনেক আগ্রহী দল সৃষ্টি হবে, কিন্তু হবে জেনেটিক মিলকে (অথবা অমিল) সামনে রেখে। এ কারণে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা মোকাবেলা করা আরো সহজ হয়ে উঠবে। আর যেহেতু আমরা জানি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি ভালো। ডিএনএ ম্যাপ হাতে থাকায় যেকোনো বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া এখনকার চেয়ে অনেক সহজ হয়ে উঠবে।
তবে এই পদ্ধতি গ্রহণের ফলে যে পরিমাণ জেনেটিক তথ্য জমা হতে থাকবে তার মাধ্যমে সৃষ্টি হবে নানা ধরনের নতুন নৈতিক, আইনগত এবং সামাজিক সমস্যার। কিন্তু গবেষকেরা সেসব নেতিবাচক সমস্যার সমাধান বের করতে নিরলস কাজ করছেন। তারা এর উপকারিতা অশুভকে অতিক্রম করতে পারবে বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। সেই সাথে বায়োটেকনোজির অগ্রগতির জন্য পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে আমাদেরকে করে তুলবে আরো বেশি আগ্রহী।
কজ
ফিডব্যাক : rex_shaheen@yahoo.com