পার্সোনাল কমপিউটারের যাত্রার শুরু থেকে আজ অবধি আমরা সবাই কমপ্যাক্ট ডিস্কের মতো কোনো এক্সটার্নাল স্টোরেজ ডিভাইসে অথবা কমপিউটারের হার্ডড্রাইভে তথ্য জমা রাখতে অভ্যস্ত। অনেক সময় আমাদেরকে এমন কিছু অ্যাপ্লিকেশন চালাতে হয়, যার জন্য অনেক প্রসেসিং পাওয়ার দরকার হয়। আর আমাদের কমপিউটারে ওই পরিমাণ প্রসেসিং পাওয়ার না থাকলে, হয় নতুন একটি কমপিউটার কিনতে হয়, অথবা বর্তমান কমপিউটারটিকে আপগ্রেড করতে হয়। ক্লাউড কমপিউটিংয়ের মাধ্যমে স্টোরেজ কিংবা প্রসেসিং পাওয়ারের এ দায়িত্ব কোনো স্বতন্ত্র কমপিউটারের ওপর না পড়ে নেটওয়ার্কের ওপর পড়ে।
আজকাল অনেক কোম্পানিই ক্লাউড কমপিউটিং সার্ভিস চালু করেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে গুগল। ‘গুগল ডকস্’ নামের অধীনে এ কোম্পানিটি বেশ কিছু ওয়েবভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন ছেড়েছে। প্রচলিত শীর্ষস্থানীয় কিছু ডেস্কটপ সফটওয়্যারের মতো এ অ্যাপ্লিকেশনগুলো জটিল না হওয়ায় এগুলো ডেস্কটপের চেয়ে বেশি সুবিধা দিয়ে থাকবে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এ অ্যাপ্লিকেশনগুলো নির্দিষ্ট কোনো কমপিউটারের সাথে আবদ্ধ নয়। এ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কোনো মেশিনে সফটওয়্যার ডাউনলোড এবং ইনস্টল করার দরকার হয় না। ইন্টারনেট সংযুক্ত যেকোনো কমপিউটার গুগল ডকস্ অ্যাকসেস করতে পারে। যেহেতু প্রত্যেক ইউজার ক্লাউড সিস্টেমে তথ্য সেভ করে, সেহেতু একই ফাইল যেকোনো জায়গা থেকে সে অ্যাকসেস করতে পারে। ডকুমেন্টের কোন সংস্করণটি সর্বশেষ, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। গুগল ক্লাউডে এটি সব সময় সেভ করা থাকবে। আরেকটি সুবিধা হলো, একই সময়ে একাধিক ইউজার একই ফাইল এডিট করতে পারবে। একে বলা হয় অনলাইন কোলাবোরেশন এবং এ পদ্ধতিতে ওয়েবে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার গতি বাড়ে।
গুগল ডকস্ কী কী করতে পারে?
মূলত গুগল ডকস্ হলো এক সেট অনলাইন প্রোডাক্টিভিটি সফটওয়্যার। অর্থাৎ এটি হলো কিছু অ্যাপ্লিকেশনের সমষ্টি যা সাধারণত কর্পোরেট পরিবেশে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন ফাইল, যেমন- ডকুমেন্ট, স্প্রেডশিট, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি সহজে তৈরিতে সাহায্য করে।
গুগলের ওয়ার্ড প্রসেসিং প্রোগ্রামটি ‘রাইটলি’ নামের একটি প্রোডাক্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ‘রাইটলি’ ছিল ‘আপস্টারটেল’ নামের একটি কোম্পানির তৈরি, ২০০৬ সালে গুগল আপস্টারটেলের স্বত্ব কিনে নেয় এবং রাইটলিকে গুগল ব্র্যান্ডের একটি পণ্য হিসেবে পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইউজার অনলাইনে বসে ডকুমেন্ট তৈরি ও এডিট করতে পারবে। একই সাথে একাধিক ইউজার যেকোনো ডকুমেন্টে অ্যাকসেস করতে পারবে।
ওয়ার্ড প্রসেসিং প্রোগ্রামের মতো গুগলের স্প্রেডশিটও অন্য কোম্পানির প্রজেক্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ‘এক্সেলটুওয়েব’ নামের একটি কোম্পানি ‘টুওয়েব’ নামের একটি কোলাবোরেশন অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপ করে এবং গুগল ‘এক্সেলটুওয়েব’-এর স্বত্ব কিনে নিয়ে ওই টিমটিকে একটি স্প্রেডশিট অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপের জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্স দেয়। বেশিরভাগ স্প্রেডশিট প্রোগ্রামের মতো গুগলের এই স্প্রেডশিটও ইউজারকে টেবিল, চার্ট এবং গ্রাফ তৈরি করতে দেয়। সর্টিং, ফিল্টারিং এবং ফর্মুলা ক্যালকুলেশনের মতো ডেস্কটপ স্প্রেডশিট প্রোগ্রামের বেশিরভাগ ফাংশন আছে এতে।
গুগল ডকসের প্রেজেন্টেশন অ্যাপ্লিকেশনের গল্পটাও এতক্ষণের গল্পের মতো। টনিক সিস্টেম নামের একটি কোম্পানি জাভাভিত্তিক কিছু প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার স্যুট তৈরি করে এবং গুগল টনিককে কিনে নেয়। টনিকের ডেভেলপমেন্ট টিমটি গুগলে চলে যায় এবং এই সফটওয়্যার স্যুটকে গুগল ডকসের অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনের সাথে সমন্বিত করার কাজ করে। গুগলের এ অ্যাপ্লিকেশনটি দেখতে একটি সাধারণ ডেস্কটপ প্রেজেন্টেশন প্রোগ্রামের মতো। প্রেজেন্টেশন হলো অনেকগুলো স্লাইডের সমষ্টি। এখানে রয়েছে অনেকগুলো স্লাইড লে-আউট এবং প্রেজেন্টেশন থিম। গুগল ডকসের এ প্রেজেন্টেশন প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ইমেজ ও ভিডিও সাপোর্ট, অটোশপ এবং টেক্সট বক্সের মতো কিছু সাধারণ ফাংশন।
গুগল ডকসের বৈশিষ্ট্য এবং সীমাবদ্ধতা
গুগল ডকসের সিস্টেম রিকোয়ারমেন্ট খুবই সাধারণ। আপনাকে শুধু ওয়েব ব্রাউজার নিয়ে চিন্তা করতে হবে। গুগল ডক্স ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৬ বা তার ওপরের সংস্করণ, ফায়ার ফক্স ১.০৭ বা তার ওপরের সংস্করণ (কিন্তু ফায়ারফক্স ৩ নয়), গুগল ক্রোম এবং সাফারি ৩.১ বা তার ওপরের সংস্করণগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এ মুহূর্তে গুগল ডকস্ অন্যান্য ব্রাউজার সাপোর্ট করে না। উল্লেখ্য, গুগল ডকস্ ব্যবহারের জন্য আপনাকে অবশ্যই ব্রাউজারের জাভাস্ক্রিপ্ট এবং কুকি অ্যানাবল করতে হবে।
গুগল ডকস্ ব্যবহারের জন্য একটি গুগল অ্যাকাউন্ট দরকার হবে। গুগল অ্যাকাউন্ট ফ্রি। গুগল অ্যাকাউন্ট তৈরির জন্য একটি আসল ই-মেইল অ্যাড্রেস দরকার হবে এবং গুগলের ‘টার্মস অব সার্ভিস’-এ রাজি থাকতে হবে। যদি জি-মেইলে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে থাকে, তাহলে আর নতুন করে গুগল অ্যাকাউন্ট তৈরির দরকার নেই। জি-মেইল অ্যাকাউন্ট দিয়েই গুগল ডকস্ ব্যবহার করতে পারবেন। গুগল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গুগল ডকসের পাশাপাশি গুগলের আরও অনেক অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা যায়।
গুগল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা নতুন ডকুমেন্ট, স্প্রেডশিট কিংবা প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে পারেন অথবা যেকোনো ফাইল আপলোড করতে পারেন। গুগল ডকস্ কমা স্পোরেটেড ভ্যালু ফাইল (.সিএসভি), হাইপার টেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ (এইচটিএমএল), মাইক্রোসফট ওয়ার্ড (.ডিওসি), মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট (.পিপিটি বা .পিপিএস), মাইক্রোসফট এক্সসেল (.এক্সএলএস), ওপেন ডকুমেন্ট টেক্সট (.ওডিটি), ওপেন ডকুমেন্ট স্পেডশিট (.ওডিএস), রিচ টেক্সট ফরমেট (.আরটিএফ), স্টার অফিস ডকুমেন্ট (.এসএক্সডব্লিউ), টেক্সট ফাইল (.টিএক্সটি) ইত্যাদি ফাইল ফরমেটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
ব্যবহারকারীরা সরাসরি গুগল অ্যাকাউন্টের ই-মেইল অ্যাড্রেসে ই-মেইল করেও ডকুমেন্ট তৈরি করতে পারেন। গুগল ডকসে আপনার তৈরি করা যেকোনো ফাইল বা অ্যাকাউন্টে অন্যের পাঠানো ফাইল অ্যাকসেস করতে পারবেন। গুগল ডকসের অ্যাকাউন্ট হোল্ডাররা তাদের যেকোনো ফাইল এডিট ও ডিলিট করতে পারেন এবং অন্যান্য কোলাবোরেটর ও ভিউয়ারদের ইনভাইট করতে পারেন। কোলাবোরেটররা ফাইল এডিট ও এক্সপোর্ট করতে পারে। অ্যাকাউন্ট হোল্ডার কোলাবোরেটরকে অ্যাকসেস পারমিশন দেন এবং নির্ধারণ করে দেন যে সে কতটুকু অ্যাকসেস করতে পারবে।
গুগল ডকসের ব্যবহারকারীরা প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টের জন্য প্রচুর স্টোরেজ স্পেস পান। কিন্তু তারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রতিটি অ্যাকাউন্টের ৫০০ কিলোবাইটের সর্বোচ্চ ৫,০০০ ডকুমেন্ট, ১ মেগাবাইট করে সর্বোচ্চ ১,০০০ স্পেডশিট এবং ১০ মেগাবাইটের সর্বোচ্চ ৫,০০০ প্রেজেন্টেশন থাকতে পারে।
গুগল ডকস্ ব্যবহারের ঠিকানা : docs.google.com। গুগল অ্যাকাউন্ট না থাকলে আজই একটি গুগল অ্যাকাউন্ট তৈরি করে গুগল ডকসের সুবিধাগুলো দেখে নিতে পারেন এক নজরে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : rabbi1982@yahoo.com