লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি বিপ্লব
ক্ষুদ্রের দিকে বৈপ্লবিক অভিযাত্রা
এখন ক্ষুদ্রের দিকে অভিযাত্রার একটি সন্ধিক্ষণ পেরচ্ছি আমরা। আর এ অভিযাত্রায় মানবজাতির প্রযুক্তিগত স্বপ্নপূরণের প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। মোবাইল ফোনভিত্তিক কমপিউটিংয়ের সাফল্যের সূত্র ধরে বলছি এ কথা। আগামীর কমপিউটিং যে প্রায় পুরোপুরিই হ্যান্ডহেল্ড ডিভাইসনির্ভর হবে, সেটা নিশ্চিতই হয়ে গেছে। কমপিউটারের কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি যারা নির্মাণ করে তারাই এখন শামিল হয়েছে ক্ষুদ্র ডিভাইসের অগ্রযাত্রায়। মাইক্রোসফটের নোকিয়া অধিগ্রহণ তো প্রায় এক মাসের পুরনো খবর। এই গত ২০ সেপ্টেম্বর থেকে মাইক্রোসফটের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল বাজারজাত করা শুরু করেছে নতুন স্মার্টফোন আইফোন ফাইভ এস ও ফাইভ সি। গত মাসের ২০ তারিখে ১১টি দেশের বাজারে এ নতুন দুই মডেলের আইফোন ছেড়েছে অ্যাপল। অ্যালুমিনিয়াম কেসিংয়ের এ ফাইভ এস ফোনগুলোতে রয়েছে এ সেভেন প্রসেসর। এর মাধ্যমে নতুন সংস্করণের আইওএস সেভেন অপারেটিং সিস্টেমও প্রচলন করল অ্যাপল। স্মার্টফোনের মাধ্যমে পুরোপুরি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবিধা যাতে ব্যবহারকারীরা পায়, সেজন্য এযাবৎকালে গবেষণালদ্ধ সর্বশেষ প্রযুক্তি রয়েছে এ ফোনগুলোতে। যেমন আছে থ্রিজি নেটওয়ার্কে ১০ ঘণ্টা টকটাইম সুবিধা। ১৬ গিগাবাইট তথ্য ধারনক্ষমতা আছে ফাইভ এসের আর ৩২ গিগাবাইট ধারনক্ষমতা আছে ফাইভ সি’র।
আপাতত ১১টি দেশে বিক্রি শুরু হলেও এ বছরের মধ্যেই বিশ্বের ১০০টি দেশে বিক্রি হতে দেখা যাবে এ স্মার্টফোনগুলো। ইতোমধ্যে ৫০ লাখ ইউনিট ফোন বিক্রি হয়ে গেছে বলেও ধারণা করছেন কেউ কেউ। এ ধরনের ফোন বা স্মার্ট ডিভাইসের প্রতি মানুষের আগ্রহ এ কারণে যে, এগুলো শুধু থ্রিজি ব্যবহারোপযোগীই নয়, উদীয়মান ফোরজির সাথে ও চলতে সক্ষম।
এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের গল্প। এর প্রতিদ্বন্দ্বীরাও কিন্তু বিশ্ববাজারে সমান সক্রিয়। এতদিন মাইক্রোসফট ক্ষুদ্র ও বহনযোগ্য স্মার্ট ডিভাইসের জন্য নানা ধরনের প্রযুক্তি সরবরাহ করে এসেছে। এরাই যখন নোকিয়ার মতো বড় মোবাইল ফোন কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছে, তখন বুঝতে হবে এরা নিজেরাই নতুন ডিভাইসের অন্যতম বাজার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে চাচ্ছে। তবে কি মাইক্রোসফট যাদেরকে এতদিন সহযোগী হিসেবে গণ্য করে এসেছে তাদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে? বিচিত্র নয় ব্যাপারটা।
পরিবর্তনশীলতার প্রথম যে ঝুঁকিটা অ্যাপল নিয়েছে, সেই ঝুঁকি অন্যরাও নেবে এবং আরও নানা ধরনের ডিভাইস নিয়ে নতুন পরিচয়ে বাজারে দেখা দেবে পুরনো প্রতিষ্ঠান। যেমন এতদিন এনভিডিয়ার পরিচিত ছিল জিপিইউ চিপ নির্মাতা (গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট) হিসেবে তারা এবার আনছে নতুন ট্যাবলেট ডিভাইস। অ্যান্ড্রয়িডনির্ভর এ ট্যাবলেটের নাম দেয়া হয়েছে ‘টেগরা নোট’। ১০ ঘণ্টা ব্যাটারি ব্যাকআপ দিতে সক্ষম ওই ট্যাবলেটের দামও কম- মাত্র ১৯৯ ডলার। ১৬ জিবি অভ্যন্তরীণ মেমরি ছাড়াই বাড়তি একটি মাইক্রো এসডি স্লট রয়েছে এতে।
এছাড়া ইন্টারনেটে এখন নবাগতদের নতুন স্মার্টপণ্যের বিশাল সমারোহ ঘটছে প্রতিনিয়ত। কারণ আর কিছুই নয়- বাজারের চাহিদা মেটানো। আসলে নতুন পণ্যের বাজার চাহিদা এখনও সঠিকভাবে নিরূপণ হয়নি। কারণ হয়তো এই, এ প্রযুক্তির উদ্বোধন হয়েছে মারাত্মক বিশ্বমন্দার মধ্যে, যখন বাজারে স্থিতিশীল অবস্থা ছিল না। অর্থাৎ ইচ্ছুক ব্যবহারকারীরা বাড়তি অর্থ ব্যয়ের সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এখন কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। মন্দা কেটে গেছে। মানুষ তাদের সার্বক্ষণিক কাজের উপকরণ হিসেবেই পেতে চাচ্ছে স্মার্ট ডিভাইসগুলোকে। অ্যাপল-মাইক্রোসফটের মতো বড় কোম্পানিগুলো তো বটেই, চীন ও তাইওয়ানের মাঝারি আকৃতির কোম্পানিগুলোও বুঝে গেছে, আগামীতে আর শখের পণ্য থাকবে না এ ডিভাইসগুলো।
দ্রম্নত কাজ, সার্বক্ষণিক নেটের আওতায় থাকা, যখন খুশি বিনোদন- এ তিন শর্ত মেনেই আগামীর জন্য স্মার্ট ডিভাইস তৈরি হচ্ছে। মানুষ এখন অনেকটা হুজুগে পড়ার মতোই কিনছে ডিভাইসগুলো। আর এ ক্ষেত্রে তাদের উপযোগিতার চাহিদা সীমাহীন। এ কারণেই আসলে বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে প্রাচীন নিয়মনীতির সাথে নতুন প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহারের বিরোধ বাধতে।
সম্প্রতি সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত প্রযুক্তি হচ্ছে ফেসবুক। জনপ্রিয়তা তো আছেই, আর এ ফেসবুকের সার্বক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার চাহিদা না থাকলে যে স্মার্ট ডিভাইসগুলো এত দ্রুত উন্নত হতো না- তাও বলাই বাহুল্য। অন্যভাবে স্মার্টনেস এলে তা হয়তো সময় নিত। কারণ ব্যবহারের চাহিদা এরকম হতো না নিশ্চয়ই। যোগাযোগের তো মাধ্যম একটা ছিলই- ইন্টারনেট। কিন্তু মেইল চালাচালি কিংবা মোবাইল ফোনের এসএমএস যতটা না পেরেছে, ফেসবুক তার অনেকগুণ বেশি পেরেছে। এর কারণ শুধু উপযোগিতা নয়- মজার ব্যাপার আছে ফেসুবক। আর সেটা হচ্ছে ফেসুবক অন্য যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে মানুষকে বেশি সৃজনশীল করে তুলতে পারে। সংখ্যার দিক দিয়ে যেমন বেশি মানুষকে টানে, তেমনি বহুমাত্রিক করে তোলে মানবিক সম্পর্কের বিষয়গুলোকে। মানবসভ্যতার অন্যতম নেতিবাচক বিষয় বিচ্ছিন্নতার বিপরীত ফেসবুক অনেকটা বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়ে এসেছে। দিনে দিনে এরও উন্নতি ঘটছে, সভ্যতর ব্যবহার পদ্ধতির উদ্ভাবন হচ্ছে। কিন্তু তারপরও লাগছে ঠোকাঠুকি। পুরনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতি ও পদ্ধতি, আইনের বাধ্যবাধকতা, কর্মসংস্কৃতি- অনেক কিছুর সাথেই নতুন সৃজনশীলতার সমন্বয় ঠিকমতো হয়নি। এজন্যই কয়দিন আগে ফেসবুকের শীর্ষ কর্মকর্তা মার্ক জুকারবার্গ দুষলেন মার্কিন প্রশাসনকে ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি করার জন্য। দুঃখ প্রকাশ করে এও তিনি বলেছেন, মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতির সুখ-দুঃখের ব্যাপারে নজরদারির মাধ্যমে খবরদারি করা উচিত নয় কারোরই।
অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রকেই দায়ী করেছেন এ বিষয়ে। আসলেই তো বিষয়টি অনভিপ্রেতই ছিল যে মানুষের ভার্চুয়াল জগতে হানা দেবে রাষ্ট্র! সাইবার স্পেস এমন একটা আবহ তৈরি করে দিয়েছে, যাতে করে বুকে পাষাণ বেঁধে থাকা মানুষও তার স্পর্শকাতর অনুভূতি জানাচ্ছে অন্যকে এবং আশা করছে বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়াও। এ বিশেষ সুবিধাটাই কিন্তু অন্যান্য অনলাইন যোগাযোগ পদ্ধতি থেকে ফেসবুককে আলাদা করেছে, আর একে সার্বক্ষণিক মাধ্যম করে তুলেছে। অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র যন্ত্রগুলোর স্মার্টনেস নিরূপণ হচ্ছে এর মাধ্যমেই।
দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও একটু বিস্ত্রিত করলে আমরা দেখতে পাই, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এ যাবতকালের যে অর্জন, তার সবকিছুকেই কিন্তু আমরা পেতে চাচ্ছি নতুন ক্ষুদ্র স্মার্ট ডিভাইসগুলোতে। এজন্যই এত ধরনের ফিচার, আর এত বেশি অ্যাপলের প্রয়োজন হচ্ছে। এমনকি হ্যান্ডহেল্ড ডিভাইসের মাধ্যমে কল্পনায় যা করার কথা মনে হয় সেগুলোকেও পারলে এখনই ভরে ফেলতে চায় সবাই। যে বিষয়গুলো নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে, সেগুলোকে অনেকের কাছেই অদ্ভুত মনে হতে পারে। আবার এমন কিছু বিষয় তৈরি হয়ে আছে, যেগুলোকে একটু বুদ্ধি খাটিয়েই ব্যবহার করা যায়। যেমন, আপনার স্মার্টফোনটিকে আপনি পিসি কন্ট্রোলের উপযোগী করে তুলতে পারেন রিমোট কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহার করে।
এর জন্য দুটো শর্ত মানতে হয়। পিসিকে হতে হয় ব্লুটুথ ও ওয়াইফাই এনাবল। এ সংযোগের মাধ্যমে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কমপিউটারের আইটিউন, পাওয়ার পয়েন্ট, মাউস উইন অ্যাম্প, সিডি প্লেয়ার এবং আরও অনেক ফিচার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মোবাইলের স্ক্রিনে পিসির হোম স্ক্রিনও দেখা যায়। ব্রাউজ এবং পিসির ফাইল নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অর্থাৎ ক্ষুদ্র মোবাইল ফোনটি যে আর শুধু কথা বলা, শোনা আর এসএমএস করার যন্ত্র নেই, এটা নিশ্চিত। এখন প্রশ্ন, আমরা আরও কতটা সুবিধা এর মাধ্যমে পেতে পারি এবং কত সৃজনশীল ও অর্থবহভাবে এটাকে ব্যবহার করতে পারি। এ যুগে গবেষণা ও উন্নয়নের যে কার্যক্রম চলছে তা মূলত এ বিষয়কে ভিত্তি করেই। কিছুটা দূর-ভবিষ্যতে ন্যানোটেকনোলজি হয়তো বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখাবে, কিন্তু আজকের দিনের ব্যবহারের ঐতিহ্যবাহী প্রযুক্তিই আরও কতটা নতুন সুবিধা দিতে সক্ষম, এখন সেটাই কৌতূহলী করে তুলেছে মানুষকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই দেখা যাচ্ছে তরম্নণ আইসিটি প্রকৌশলীরা নতুন ডিভাইস ও অ্যাপিস্নকেশন উন্নয়নে কিছু না কিছু অবদান রাখার চেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। এখন তাদের লক্ষ্য নতুন স্মার্ট ডিভাইস এবং থ্রিজি/ফোরজি ফরম্যাটকে কেমন করে অধিকতর অর্থনৈতিক কর্মকা-- এবং আরও সৃজনশীল করে তোলা যায়। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সংস্কৃতিগত যে বাধাগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু কেটে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত রায় দিয়েছে ফেসবুকে লাইক দেয়া বাকস্বাধীনতার অংশ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আধুনিক মনমানসিকতার লোকজন আসছেন। তারা এ সন্ধিক্ষণের সময়টাকে মেধা ও মনন দিয়ে পার করে দেবেন- এ বিশ্বাস আমাদের রাখতে হবে। এ আস্থাটি বুঝে নিয়েই প্রযুক্তিবিদদেরও এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের দেশের তরুণ আইসিটি গবেষকেরাও নিশ্চয়ই এ সময়ে কিছু অবদান রাখবেন। তাদের সামনে কিন্তু অনেক সুযোগের হাতছানি। এ কথা বলছি এ কারণে- আমাদের প্রয়োজন অনেক, চাহিদার ক্ষেত্রটা যেহেতু বড়, করণীয়ও সেহেতু অনেক আছে। এখন সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে।
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com