লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
আবদুল্লাহ আল আমীন
মোট লেখা:২
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
থ্রীডি ম্যাক্স
বিস্ময়ের বছরই হবে ২০১৪
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর ২০১৩ আওয়ামী লীগ প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন। যদিও দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না এবং পুরো বিষয়টি শেষাবধি শুধু হয়তো নিয়ম রক্ষার নির্বাচনেই পরিণত হয়েছে, তথাপি ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ তার দেশ পরিচালনার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সামনের পাঁচ বছরের জন্য নতুন কী আপডেট দিল, সেই বিষয়ে অন্তত অ্যাকাডেমিক আগ্রহ থাকতেই পারে। ইশতেহার নিয়ে আমাদের আলোচনাটি সে কারণেই প্রধানত অ্যাকাডেমিক। আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তির মানুষ, তাদের জন্য আওয়ামী লীগের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক ভাবনা-চিন্তা যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি করে। এর অন্যতম কারণ, এ রাজনৈতিক দলটি দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের জন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে আমরা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখেছি। সেজন্যই এবারের ইশতেহারটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে এর যেসব ধারায় তথ্য প্রযুক্তি বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে পড়েছি। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য অনুচ্ছেদে এ বিষয়গুলো রয়েছে। তবে এ কথাটি শুরুতেই বলে রাখা ভালো, ২০০৮ সালের ইশতেহারে বিষয়টি যতটা গুরুত্ব বহন করেছিল, মনে হচ্ছে এবার তেমনটি নেই। কিছুটা দায়সারাভাবের প্রতিফলন সহজেই চোখে পড়ে। বস্তুত একটি প্যারাতেই প্রসঙ্গটি এসেছে। নির্বাচনের গুরুত্ব কম বলে এমনটি হলো কি না, সেটি নিয়ে আমার শঙ্কা রয়েছে। যাই হোক, আলোচনার শুরুতেই আমরা ইশতেহারের কিছু কিছু অংশ দেখে নিতে পারি, যেখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৯.৩-এ রয়েছে : ‘শির মানোন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। এ জন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হা্রস, প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি ও শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, সব পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ও মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর ব্যবহার সম্প্রসারিত করা হবে।...।’ এ অনুচ্ছেদ অনুসারে আমরা শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের একটি অঙ্গীকারের কথা জানতে পারছি। আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল ক্লাস রুম ও কমপিউটার ল্যাব গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি অব্যাহত রাখার কথাই এতে বলা হয়েছে।
৯.৪ অনুচ্ছেদে রয়েছে : ‘জনসংখ্যায় শিশু-কিশোরের প্রাধান্য বিবেচনায় এ কাজটি বেশি গুরুত্ব দাবি করে। ইতোমধ্যে কিছু উন্নয়ন সহযোগীর সাথে মিলে আমরা মানবসম্পদ উন্নয়নে একটি সার্বিক কৌশল গ্রহণ করেছি। এ কৌশলের অংশ হিসেবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এবং ব্যক্তিমালিকানা খাত ও সরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় এবং সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় করা হবে। শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত বা কারিকুলামও চাহিদা অনুযায়ী বাসত্মবানুগ করা হবে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা এবং বিভিন্ন পেশায় ও প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ ঢেলে সাজানোর যে কাজ শুরু হয়েছে তা সুচারু ভাবে সম্পন্ন করা এবং সারাদেশে এর প্রচলন নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া প্রত্যেক উপজেলায় বাস্তবায়নাধীন টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। বৃত্তিমলূক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারের লক্ষে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় ভোকেশনাল ট্রেনিং কোর্স প্রবর্তনের কর্মপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারণ করা হবে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে মডেল বিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। মূল ধারার সাথে সঙ্গতি রেখে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষে কমপিউটার ও অনার্স কোর্স চালুসহ যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে।’
এ অনুচ্ছেদেও প্রযুক্তি, বৃত্তিমূলক ও কমপিউটার শিক্ষাকে সম্প্রসারণের অঙ্গীকার রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এ খাতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার অব্যাহত যাত্রার প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে শিক্ষায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার যেসব কার্যক্রম এরই মাঝে শুরু করা হয়েছে, সেগুলোর কথা কেনো ইশতেহারে নেই, সেটি আমার বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষার ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, সেগুলোর কথা এখানে বলা উচিত ছিল। তবে আমরা লক্ষ করেছি, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধ্যায়ে এ সম্পর্কে ভিন্নভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। তবুও ডিজিটাল কনটেন্ট প্রসঙ্গটি আসেনি। এতে এটি প্রতীয়মান হয়, বিষয়টি খুব গুরম্নত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়নি।
বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি নামে যে অনুচ্ছেদটি, সেটি ১০ নাম্বারের। ১০.১ অনুচ্ছেদে রয়েছে গবেষণা ও আবিষ্কারের বিষয়াদি।
১০.২ অনুচ্ছেদ : বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা এবং পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন ও হালনাগাদ করা হবে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরে আইটি শিক্ষার প্রসারের লক্ষে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার এবং ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারিত করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন দ্রুততর করা হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও কমপিউটার শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার করা হবে। সফটওয়্যার শিল্পের প্রসার, আইটি সার্ভিসের বিকাশ, দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনকুবেটর ও কমপিউটার ভিলেজ স্থাপনের কার্যক্রম শু্রু হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন এসব কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। একই সাথে আউটসোর্সিং ও সফটওয়্যার রফতানি ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
১০.৩ অনুচ্ছেদ : দেশজুড়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা, যেমন থ্রিজি চালু হয়েছে। ফোরজিও চালু করা হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা হবে। এছাড়া অনুচ্ছেদ ১১-তে টেলিমেডিসিন প্রচলনের কথা বলা হয়েছে।
২০০৮ সালে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আরও অনেক কথা বলা হয়েছিল। সরকারের করণীয় বিষয়গুলো বস্ত্তত অনেক বেশি স্পষ্ট ছিল। এবার সেই ধারাটি অব্যাহত নেই। মাত্র দুটি উপ-অনুচ্ছেদে তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিষয় বর্ণিত হওয়ার কথা নয়। সরকারের বহমান কার্যক্রমগুলোর কিছুটা বিবরণ ইশতেহারে থাকতে পারত। যাই হোক, ইশতেহারে খুব সংক্ষেপে যেসব প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবই দৈনন্দিন কাজের কথা। হাইটেক পার্ক করা, সফটওয়্যার রফতানিতে সহায়তা করা, থ্রিজির পর ফোরজি চালু করা- এসব একটি সরকারের রুটিন কাজ। ক্ষমতায় থাকলে এসব রুটিন কাজ সরকারকে করতেই হবে। বরং সরকারের কোন কোন কাজ যে করা হয়ে গেছে সেটি ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়নি। আওয়ামী লীগের জানা উচিত ছিল, ইতোমধ্যেই সরকার ফোরজির লাইসেন্স দিয়েছে এবং এটি চালু করা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
২০০৮ সালে যেহেতু আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বলেছিল এবং বিগত পাঁচ বছর ধরে সেই কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, সেহেতু এটি অব্যাহত থাকবে-এ কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধন্যবাদ যে, এ কথাটি বলা হয়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে যে প্রশ্নটির উত্তর সারাদেশের মানুষ খুঁজেছে, সেটি হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে দলটি সাধারণ মানুষের সামনে কী বোঝাতে চেয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কিছু নির্বাচনী বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ এ ধারণা হয়তো করতে পারছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে দ্রুত সেবা পাওয়া এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতে পারা। কিন্তু সরকারের মন্ত্রী-নেতারা ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে দারিদ্র্য-দুর্নীতিমুক্ত- বৈষম্যহীন যে দেশটির কথা বলেছেন, যাকে বঙ্গবন্ধুর একুশ শতকের সোনার বাংলা বলা হয়েছে, তার প্রতিফলন পুরো ইশতেহারে হওয়া উচিত ছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান দিয়ে আমরা যেসব পরিবর্তনের কথা বলতে চেয়েছি, সেটিও ইশতেহারে উল্লেখ থাকা আবশ্যক ছিল। ডিজিটাল শিক্ষা, ডিজিটাল সরকার, ডিজিটাল জীবনধারা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য ইশতেহারে নেই।
তবে ইশতেহারে একটি অনেক বড় অঙ্গীকার রয়েছে। সেই অঙ্গীকারটি হলো ‘বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা হবে।’ আমি ঠিক জানি না, এ অঙ্গীকারটি করার সময় প্রকৃত প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ কোন প্রত্যয়টি গভীরভাব ব্যক্ত করেছে। পুরো ইশতেহারের কোথাও এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা নেই। ইশতেহারের মেজাজেও এর কোনো প্রতিফলন নেই। আমি নিজে বিষয়টি নিয়ে সেই ২০০৩ সাল থেকেই কথা বলছি। কারও কারও মনে থাকতে পারে, সেই সময় জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি সমাজ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান যোগ দিয়েছিলেন এবং তারা ২০০৬ সালের মাঝে বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে এসেছিলেন। জাতিসংঘ যেখানে ২০১৫ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কথা বলেছিল, সেখানে খালেদা জিয়া ২০০৬ সালেই সেই সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু জেনেভা থেকে ফিরে তিনি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এ শব্দটিই বোধহয় দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেননি। আওয়ামী লীগের ইশতেহার দেখে আমার একই ধরনের শঙ্কা জেগেছে। আওয়ামী লীগ কি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের রূপরেখা জেনে সেটি গড়ে তোলার কথা বলেছে? দলের নেতা-কর্মীসহ নীতিনির্ধারকেরা কি আদৌ জানেন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ কাকে বলে? আমি যখন ২০০৭ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা লিখি, তখন থেকেই বলে আসছি মানবজাতির বর্তমান লক্ষ হচ্ছে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজে উত্তরণ। ডিজিটাল যুগের একটি আকাঙক্ষা হচ্ছে এটি। এজন্য সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় ডিজিটাল রূপান্তর জরুরি। আমরা যখন ডিজিটাল রূপান্তরটি সম্পন্ন করতে পারব, তখন একে জ্ঞানভিত্তিক সমাজেও রূপান্তর করা সম্ভব হবে। সেই সময়ে ডিজিটাল যুগ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ কি তার সংজ্ঞাও আমি উদ্ধৃত করেছি।
যে বিষয়টি আমি প্রত্যাশা করব সেটি হলো, আওয়ামী লীগ শুধু একটি বাক্য বলে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটিকে যেমন উজ্জ্বল করেছে, তেমনি জ্ঞানভিত্তিক সমাজকে ঘিরে ৬টি শব্দ উচ্চারণ করে তার গুরুত্বটা যেনো রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে।
আমাকে যদি বলা হয়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে নতুন কী দিয়েছে আওয়ামী লীগ, তবে আমি শুধু জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার অঙ্গীকারের কথাটাই বলতে পারব ।
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com