লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
সাবরিনা নুজহাত
মোট লেখা:৬
লেখা সম্পর্কিত
কাজের কাজি চশমা
কথায় আছে ‘চোখ যে মনের আয়না’। কথাটি একজন সাধারণ মানুষের জন্য যথাযথ হলেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর জন্য কতটা বেদনাদায়ক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বল্প দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা চশমার সাহায্যে দেখা ও চলাফেরার সুযোগ পেলেও যারা পুরোপুরি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তাদের এ ক্ষেত্রে কোনো উপায় থাকে না। তাই বলে বসে থাকেননি গবেষক, বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকেরা। প্রতিনিয়ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সহায়তায় নানা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরাও থেমে নেই। এরই ধারাবাহিতায় প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে বিশেষ চশমা। ইন্টারনেট অবলম্বনে এমনই দুটি চশমা নিয়ে এ লেখার অবতারণা।
কথা বলবে চশমা
প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন উদ্ভাবনে এগিয়ে চলেছে দেশের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ ক্ষেত্রে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট অন্যতম। এবার কুয়েটের দুই শিক্ষার্থী নাজমুল ও মোস্তফা তৈরি করেছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ এ চশমা। এ চশমার মাধ্যমে শোনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই পাওয়া যাবে। তাদের কাজের তত্ত্বাবধান করেন কুয়েটের কমপিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শেখ সাদি।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি বিশেষ চশমা সম্পর্কে দুই শিক্ষার্থী জানান, এ চশমা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের প্রতিকূলতাকে দূর করতে সহায়তা দেবে। লাঠি দিয়ে ঠকঠক করে পথ খুঁজে হাঁটার বদলে এখন ছোট্ট এ চশমাই বলে দেবে পথের ঠিকানা, সামনের পথ সম্পর্কে সচেতন করবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের। চারপাশের সব বস্ত্ত চিহ্নিত করে পথ বলে দেবে ঠিকমতো। পথ চলার আগে শুধু একটি বোতাম টিপে চশমাটি চালু করে দিলেই হবে। সামনে-ডানে-বাঁয়ে কোনো বাধা পেলেই সশব্দে সতর্ক করে দেবে ব্যবহারকারীকে। সামনের জন্য ফ্রন্ট, ডানের জন্য রাইট, বাঁয়ের জন্য লেফট উচ্চারণ করে বস্ত্তর সঠিক অবস্থানটি জানিয়ে দেবে সে। ব্যবহারকারী থেকে বস্ত্তর দূরত্বভেদে উচ্চারণের তীব্রতাও হবে ভিন্ন। যা থেকে ব্যবহারকারী বস্ত্তর দূরত্ব সম্পর্কে একটি পূর্ণ ধারণা পাবেন। ছোট এ যন্ত্রটি দিয়ে প্রায় তিন মিটার দূরত্ব পর্যমত্ম কোনো বস্ত্তর অবস্থান শতকরা ৯৮ ভাগ নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম। দিনে-রাতে, এমনকি কুয়াশার মধ্যেও যন্ত্রটি ব্যবহার করা সম্ভব বলে জানান উদ্ভাবকেরা।
যন্ত্রটিতে দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আল্ট্রাসনিক সেন্সর, ডাটা প্রসেসিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে পিআইসি সিরিজের মাইক্রোকন্ট্রোলার এবং আউটপুট ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ এয়ারফোন। যন্ত্রটি চলবে মোবাইল ব্যাটারিতে, যা একবার চার্জ দিলে টানা ৩০ ঘণ্টা ব্যবহার করা যাবে। এমনকি চার্জ শেষ হয়ে গেলেও বিশেষ ক্যাবল ইন্টারফেসের মাধ্যমে এটিকে মোবাইলের সাথে সংযুক্ত করে সচল রাখা যাবে বাড়তি কয়েক ঘণ্টা।
উদ্ভাবকেরা জানান, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বানানো হলেও সামান্য কিছু পরিবর্তন করে যন্ত্রটিকে ব্যবহার করা যাবে আরও অনেক ক্ষেত্রে। নিরাপত্তার কাজে ব্যবহার করে কক্ষে অবাঞ্ছিত ব্যক্তির প্রবেশ শনাক্ত করতে পারবে এ চশমা। এ ছাড়া গাড়ি চুরি রোধেও এটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। যেকোনো ধরনের রোবটিক প্লাটফর্মেও এটি ব্যবহার করা যাবে। এর মাধ্যমে দূরত্ব পরিমাপ করা যেমন সম্ভব, তেমনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও এটি পরে পানিতে সাঁতার কাটতে পারবেন বলে জানালেন উদ্ভাবকেরা।
যন্ত্রটি তৈরি করতে মাত্র ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে বলে এর ক্রয়মূল্যও থাকবে হাতের নাগালেই। তবে বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারজাত করতে পারলে খরচ আরও কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানালেন নাজমুল ও মোস্তফা। ভবিষ্যতে এ প্রকল্পকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চান উদ্ভাবকেরা। খরচ কমিয়ে আরও নতুন নতুন সুবিধা সংযোজন এবং প্রযুক্তিবান্ধব করার পরিকল্পনাও আছে বলে জানান এরা। এরা বলেন, ভবিষ্যতে যন্ত্রটিতে থাকবে জিপিএস টেকনোলজি এবং একে স্মার্টফোনের সাথে সংযুক্ত করা হবে, যাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সহজে তাদের গমত্মব্যে পৌঁছতে পারেন। সেই সাথে থাকবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ওপর সার্বক্ষণিক অনলাইন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে সব নির্দেশনা দেয়া হবে বাংলা ভাষায়।
শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শেখ সাদি যন্ত্রটি সম্পর্কে বলেন, দেশের বাইরেও এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। তবে এত হালকা ও ব্যবহারবান্ধব করা যায়নি। ব্যবহারের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করলে প্রাথমিক অবস্থায় যন্ত্রটি বেশ ভালো সহায়তা দিয়েছে। তবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে একে আরও ব্যবহারোপযোগী করা সম্ভব।
তিনি জানান, ওজন কমানো, ব্যবহারোপযোগী বাণিজ্যিক আকার দেয়া, ইন্টারনেট সংযোজন ও জিপিএস সুবিধার মাধ্যমে যন্ত্রটিতে আরও ব্যাপকতা আনা সম্ভব। এতে খরচ কমিয়ে এবং উৎপাদন বাড়িয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর নতুন আশার দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব হবে বলে আশা করেন তিনি।
অধ্যাপক সাদি আরও জানান, নাজমুল হাসান তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে এবং মোস্তফা কামাল কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে পড়ছেন। দু’জনই তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। নাজমুলের আগ্রহ ইলেকট্রনিক্সের দিকে আর মোস্তফার আগ্রহ মেকানিক্যাল কাজে। এরা দু’জনই মূলত রোবটিক্স নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। এদিকে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে যন্ত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছেন নাজমুল ও মোস্তফা। প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা পেলে তারা তাদের উদ্ভাবন ক্ষেত্রকে আরও সম্প্রসারিত করতে পারবেন।
শোনার সহায়তার নুওয়েভ চশমা
গুগলের স্মার্ট চশমা গুগল গ্লাস তো কত কিছুই করতে পারে। কিন্তু এটিতে কানে শোনার ব্যাপারে তেমন জোর দেয়া হয়নি। সম্প্রতি ভার্জিনিয়ার একদল শিক্ষার্থী এমন এক ধরনের চশমার নমুনা প্রদর্শন করেছেন, যা মূলত শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদেরকে কানে শুনতে সহায়তা করবে। সণাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী চেলসি পন, লেন স্টিথ, নেইলি ট্যালবট এবং পিটার ইয়ু ‘নুওয়েভ গ্লাস’ নামে এ বিশেষ ধরনের চশমাটির একটি নমুনা তৈরি করেন। তারা এ বছরের শুরুতে প্রকৌশলীদের জন্য আয়োজিত ‘গেটিং ওয়্যারলেস : স্টুডেন্ট ডিজাইন চ্যালেঞ্জ’ নামে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর এটি প্রস্ত্তত করেন। একইভাবে নুওয়েভ টিমকে মাইকেল নামে একটি ১৬ বছর বয়সী কাল্পনিক চরিত্রের শ্রবণ-প্রতিবন্ধিতার সমস্যার সমাধান করতে দেয়া হয়, যার একটি সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
বিশেষ এ চশমাটিতে রয়েছে লাইট ইনডিকেটর, বহনযোগ্য ব্যাটারি, হিয়ারিং এইড ব্যবস্থার জন্য মাইক্রোফোন বোন কন্ডাকশন সিস্টেম ও চার্জিং প্যাড। চশমাটি ব্যবহারকারীর টেম্পোরাল বোনের কাছাকাছি অবস্থান করলে বোন কন্ডাকশন সিস্টেমের সাহায্যে এটি কম্পনের মাধ্যমে তার কানে শব্দ পৌঁছে দেবে। চশমাটি ব্লুটুথের ও একটি বিশেষ অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্যে স্মার্টফোন ডিভাইসের সাথে সংযুক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী তার স্মার্টফোনে আসা কল, মেসেজ কিংবা সামনের কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্টের সতর্ক বার্তাও শুনতে পাবেন। গুগল গ্লাস যেহেতু বিশেষভাবে শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি হয়নি, সে ক্ষেত্রে নুওয়েভ গ্লাস জনপ্রিয়তা পাবে বলে আশা করা যায় ।
ফিডব্যাক : techloverbd@gmail.com