লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
ভাস্কর ভট্টাচার্য
মোট লেখা:২
লেখা সম্পর্কিত
ভিন্নভাবে সক্ষম যুবদের জীবনযাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তির অবদান
বিখ্যাত আমেরিকান লেখক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বিজ্ঞানী কার্ল অ্যাডওয়ার্ড সাগান বলেছেন- ‘We’re arranged a civilization in where most crucial elements profoundly depend on science and techonology.’ অর্থাৎ ‘আমরা এমন একটি সভ্যতা আয়োজন করতে চলেছি, যার অধিকাংশ অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর খুবই নির্ভরশীল।’
যেকোনো নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের চাবিকাঠি। যার ব্যবহারে কোনো না কোনোভাবে মানবকল্যাণ সাধিত হচ্ছে। তাই আধুনিক সভ্যতা মানে প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা। হোক সে প্রযুক্তি কৃষিপ্রযুক্তি, শিক্ষাপ্রযুক্তি, যোগাযোগপ্রযুক্তি, চিকিৎসাপ্রযুক্তি বা তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি। এখানে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ব্যবহারোপযোগী তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধী যুবাদের আইসিটি দক্ষতা বাড়ানো ও সফল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয় ‘Empowering Youth with Disabilities through market driven ICT skills.’ নামের প্রশিক্ষণ। বিশ্বব্যাংক, মাইক্রোসফট-শ্রীলঙ্কা ও সার্ভোদায়া ফিউসনের আয়োজিত ‘Youth Solutions! Technology for Skills and Employment, ২০১৩’ শীর্ষক বৈশ্বিক ও মর্যাদাপূর্ণ এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা, যার ফলশ্রম্নতিতে ওই প্রশিক্ষণের আয়োজন করে তারা। সম্প্রতি অত্যন্ত সফলতা ও দক্ষতার সাথে ছয় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের পরিচালনা ও সমাপ্তি ঘোষণা করে সংস্থাটি। এই প্রশিক্ষণটি সেপ্টেম্বর ২০১৩ এবং মার্চ ২০১৪ দুটি ব্যাচে অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে ৪০ জন প্রতিবন্ধী যুবাকে আইসিটির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বর্তমানে এই ৪০ জন প্রতিবন্ধী যুবা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কমপিউটার চালনা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও ই-মেইল করতে পারছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে আইসিটির জগতে চলছে তাদের অবাধ বিচরণ। তারা সফলতার সাথে ফেসবুকের মতো বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে এবং অনলাইন জব সার্চের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ৪০ জন যুবার মধ্য থেকে ১০ জন চাকরিরত আছেন।
প্রশিক্ষণার্থীদের সাত সদস্যের পরিবারে চার বোনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে কর্মসংস্থানের সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন। কিন্তু তাদের কথা শুনলে এখন গর্ব ও বিস্ময়ে বুকটা ভরে ওঠে। এই পরিবারের তিনজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বোনই (উম্মে তাসলিমা, উম্মে হাবিবা ও উম্মে তানজিলা চৌধুরী) ওই প্রতিষ্ঠানের একই ট্রেনিং শেষে পটিয়া শশাঙ্কমালা প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ গোবিন্দারখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোহসেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সফলভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শিক্ষকতা করছেন। তাদের স্পষ্ট ধারণা, আইসিটি সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ না পেলে তাদের এই লক্ষি্য পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হতো।
পাহাড় আর সমতলে ঐকতানের আবহ এনে দিয়েছে এই প্রশিক্ষণটি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তিন পার্বত্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যুবক সুকোমল ত্রিপুরা, ভবদত্ত চাকমা, রিন্টু তনচঙ্গা বহু প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এখানে এসেছেন এই প্রশিক্ষণ নিতে। তাদের মতে, এই ডিজিটাল শিক্ষা ছাড়া তাদের জীবনের পথচলা অতটা সহজ হতো না। তারা সে দিনটির অপেক্ষায় আছে, যেদিন তাদের এ প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তাদের একটা ভালো চাকরি হবে। কেননা ইতোমধ্যে মতবিনিময় সভা, প্রেস কনফারেন্সসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে এই প্রশিক্ষণের অর্জনের কথা মানুষ জেনে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থার মুখে পড়েন কণ্ঠশিল্পী আবদুল মালেক (দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী)। তিনি এই প্রশিক্ষণ শেষ করে এখন শরীয়তপুরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, এতে সঙ্গীতের ভুবনে তার পদচারণা আরও সমৃদ্ধ ও সাবলীল হয়েছে। তিনি এখন নিজে আয়ত্ত করেছেন স্বরলিপি পড়ার দক্ষতা, বিভিন্ন বৈচিত্র্যের ধ্বনি ও সুর সৃষ্টি, সুরের ঐকতান ঠিকঠাক করা, সঙ্গীত কম্পোজিশন করা এবং তা ব্যবহার করা ইত্যাদি। তিনি বলেন, এই ট্রেনিংটা শেষ করতে না পারলে শেষ পর্যন্ত চাকরিটাই আর হতো না।
এছাড়া রয়েছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী সুব্রত, ফার্মাসি থেকে পাস করা টগবগে এক যুবক। ট্রেনিং শেষ করে তিনি আশা করছেন তিনি অফিসিয়াল, আইটি বিষয়ক কাজগুলো করতে পারবেন তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তা দেখাতে চান।
সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী মো. আরিফুর রহমান প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বলেন, এই যুবদের চাকরির পর যে হাসিটুকু আমরা দেখেছি, তার কোনো মূল্য হয় না। এই ধরনের অনুভূতিকে কোনো কিছু দিয়ে মাপা সম্ভব নয়।
তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবিকাশ আর মানবসভ্যতার অগ্রগতি- এই দুটি বাক্য পরস্পরের পরিপূরক। সমাজ প্রগতির প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ সাধিত হয়েছে।
সুতরাং তথ্যপ্রযুক্তিকে যত বেশি আমরা মানবকল্যাণের কাজে লাগাতে সক্ষম হব, তত বেশি আমরা সমাজ প্রগতির চাকাকে সুসংগঠিত করতে পারব। একটি ল্যাপটপ ও স্কিন রিডিং সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ প্রতিবন্ধী যুব-যুবাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথকে নিশ্চিত করে দিয়েছে। তাদের জীবনযাত্রা আর কোনো ধরনের স্থবিরতার কবলে পড়ে এক জায়গায় দীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে থাকবে না। তথ্যপ্রযুক্তি তাদের জীবন-জীবিকার ক্ষক্ষত্রে এক আমূল পরিবর্তন করে চলেছে। ভিন্নভাবে সক্ষম যুবদের এই জীবনে তথ্যপ্রযুক্তি যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, তা দেশ ও কালের সীমাকে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে সার্বজনীন ও বৈশ্বিক মূল্যবোধের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশও বৈশ্বিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। দেশের সামাজিক ইতিবাচক উন্নয়নের ইতিহাসই একদিন বলে দেবে সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রশিক্ষণটি কোন মাত্রায় অবদান রেখে চলেছে। আজকের দিনে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক, প্রাসঙ্গিক যন্ত্রপাতি, কমপিউটার ও সফটওয়্যার, বিভিন্ন টুল ব্যবহার ভিন্নভাবে সক্ষম প্রতিবন্ধীদের জীবনকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী দাতা সংস্থা, কর্পোরেটসহ ও জাতীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রতিবন্ধীবান্ধব এই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে দেশের হাজার হাজার প্রতিবন্ধী তরুণ-যুবা কর্মক্ষম হয়ে মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে পারবে এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে সমন্বয় রেখে চলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে
লেখকদ্বয় : উন্নয়ন সংগঠক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিত্ব
ফিডব্যাক : vashkar79@hotmail.com; sadia72_ypsa@yahoo.com
ওয়েবসাইট : www.ypsa.org