• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম খাতে টিকফার প্রভাব
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: ইমদাদুল হক
মোট লেখা:৬২
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৩ - ডিসেম্বর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
টেলিকম-বিপ্লব
তথ্যসূত্র:
রির্পোট
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম খাতে টিকফার প্রভাব
টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা। ‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment Framework Agreements, সংক্ষেপে ঞওঋঅ। প্রমিত বাংলায় যার তর্জমা ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। আপাতদৃষ্টিতে চুক্তি শিরোনামের প্রতিটি শব্দই আশা জাগানিয়া। কিন্তু তারপরও এই খোলসের ভেতরের নানা বিষয় নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। বিতর্কের কারণ বিশেস্নষণে দেখা গেছে, টিকফা ১৯৮৬ সালে এরশাদ আমলে আমেরিকার সাথে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির একটি বর্ধিত রূপ। এখানে আগের চুক্তির ধারাগুলো কঠোরভাবে পালনের বাধ্যবাধকতা যুক্ত হয়েছে। তাই পর্যবেক্ষকেরা বলছেন- বাণিজ্য সুবিধা, পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, কৌশলগত স্বার্থ ইত্যাদি নানান মিষ্টি প্রলেপ দিয়েছে বাংলাদেশকে টিফার বিষাক্ত ক্যাপসুল।

টিকফা চুক্তির বৈধতা
এক যুগ ধরে চলমান তির্যক মমত্মব্যের মধ্য দিয়েই গত ২৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টায় আমেরিকায় বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্ট (টিকফা) স্বাক্ষরিত হয়। এরপর নতুন করে শুরম্ন হয় বিতর্ক। চুক্তির বিষয়বস্ত্ত থেকে অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে- চুক্তিটি ওষুধ শিল্প, পোশাক শিল্প এবং কৃষি শিল্পের পরই তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম খাতে আঁচর কাটবে। রাষ্ট্রপতি এবং সংসদে পেশ না করে শুধু মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে নির্বাচনী আমেজে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এমন চুক্তির বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীরা। চুক্তির শর্ত, ধারা-উপধারা এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ না পাওয়ায় অনেকটা ধূম্রজালের মধ্যে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। ধূম্রজাল সরাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের নির্বাহী অফিসের বাণিজ্যবিষয়ক প্রতিনিধি ‘অফিস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেট অ্যান্ড ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ’-এর ওয়েব ভিজিট করেও হতাশ হতে হয়েছে। এখানে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তিন পাতার একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তিপত্রের পিডিএফ ডকুমেন্ট রয়েছে। ডকুমেন্টটিতে বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুব আহমেদ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অফিস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেট অ্যান্ড ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের ডেপুটি ইউএসটিআর ওয়েলডি কাটলার সই করেছেন। তবে এখানেও চুক্তির বিসত্মারিত উল্লেখ নেই।

ফলে টিকফা চুক্তি বিষয়ে এখনও ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি মোস্তফা জববার বলেন, আমি চুক্তির পুরো বিষয়টি অবহিত নই। তবে যতটুকু জানি চুক্তিতে দৃশ্যমান কোনো প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের স্থানীয় প্রযুক্তির প্যাটেন্ট থেকে আমরা সুবিধা পাব। আমেরিকার সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কারণে আগেই এখানে বিনিয়োগ সুযোগ ছিল। এবার আঞ্চলিক কোম্পানিগুলোর ওপর তাদের নজর পড়বে।

অপরদিকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি শামীম আহসান বলেন, বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। তবে যতটুকু বুঝেছি দেশে আমেরিকার বিনিয়োগ বাড়বে।

কী এই টিকফা

টিফা/টিকফা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যেটুকু হয়েছে তা সম্ভব হয়েছে টিফা চুক্তির একটা স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাট যুক্তরাষ্ট্র অনুসরণ করে, যা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওয়েবসাইট থেকে সহজেই দেখা যায়। এ ছাড়া যেহেতু সর্বশেষ খসড়াটি প্রকাশিত হয়নি, তাই বাংলাদেশের সাথে প্রস্তাবিত টিফা চুক্তির ২০০৫ সালে bilaterals.org ওয়েবসাইটে ফাঁস হওয়া খসড়া ধরেই এখানে আলোচনা করা হচ্ছে। অবশ্য সাম্প্রতিক খসড়ার নাম কিংবা ভেতরের শব্দ-বাক্য চয়ন ইত্যাদি যা-ই হোক, তাতে টিফা/টিইসিএফ সংক্রান্ত আমাদের আলোচনায় তাতে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র টিফার একটা সাধারণ ফরম্যাট বজায় রাখে, যে ফরম্যাটের মূল ধারাগুলো এ পর্যন্ত যে ৬১টি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র টিফা স্বাক্ষর করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে মোটামুটি একই ধরনের। আর আমাদের আলোচনাও মূলত ওই সাধারণ বা কমন ধারাগুলোকেই কেন্দ্র করে।

টিফা চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে গত ১২ বছর আগে থেকে। এ চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সংবলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন টিকফা তথা TICFA ev Trade and Investment Co-operamework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

চুক্তিতে প্রাধান্য

টিকফা একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। বিশ্ব বাণিজ্যের যেসব বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান এবং চুক্তিগুলো আছে বা ছিল, যেমন ডব্লিউটিও, জিএটিটি, নাফটা, উরুগুয়ে রাউন্ড, টোকিও রাউন্ড- সেগুলোর সবচেয়ে বেশি লাভ ঘরে তুলেছিল আমেরিকা। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব ৩০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু ২০০১ সালে ডব্লিউটিও-তে চীনের অন্তর্ভুক্তি সব ওলট-পালট করে দেয়। এরপর থেকেই মার্কিন বাণিজ্য ক্ষেত্রগুলো একে একে চীনের দখলে চলে যেতে থাকে। ২০০৩ সালে প্রথম আমেরিকার রফতানি আয়কে জার্মানি ছাড়িয়ে যায়। এর মূল কারণ চীনের কাছে আমেরিকার বাজার হারানো। তখন থেকেই বহুপক্ষীয় চুক্তির বিপরীতে আমেরিকা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে নিজের স্বার্থরক্ষার পথ বেছে নেয়। আমেরিকার সরকারি নথিতে টিকফা সম্পর্কে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে-‘Trade policy can be an innovative tool to help grow America’s economy and the world economy, while helping workers and firms here at home’। এরা সততার সাথে ঘোষণা করেছে, নিজের অর্থনীতির বিকাশের জন্যই এ চুক্তিটি করছে।

স্বভাবতই আমেরিকার ট্রেড পলিসির লক্ষ্য হিসেবে ঘোষিত পদক্ষেপগুলোই টিকফার মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। আমেরিকার ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে- ক. শুল্ক বাধা দূর করা, খ. বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুরক্ষা, গ. সরকারি ভর্তুকি বন্ধ করা, ঘ. সরকারি ক্রয়ে অংশ নেয়া, ঙ. পরিবেশ ও শ্রমের পরিবেশ উন্নত করা এবং চ. মেধাস্বত্ব কড়াকড়িভাবে আরোপ করা।

টিকফা চুক্তির খসড়ায় পণ্য ও পুঁজির চলাচলকে অবাধ করার কথা এবং সেই সূত্রে মুনাফার শর্তহীন স্থানান্তরের গ্যারান্টির কথা বলা হলেও শ্রমশক্তির অবাধ যাতায়াতের সুযোগের কথা কিছুই বলা হয়নি। অথচ শ্রমশক্তিই হলো আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান সম্পদ, যার রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বিপুল আপেক্ষিক সুবিধা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘খোলাবাজার’ নীতিটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে রাজি নয়। এরা তা প্রয়োগ করতে প্রস্ত্তত শুধু পুঁজি এবং পণ্য-সেবাপণ্যের ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্রে এদের রয়েছে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি আপেক্ষিক সুবিধা। অন্যদিকে টিকফাতে ‘শুল্কবহির্ভূত বাধা’ দূর করার শর্ত চাপানো হলেও ‘শুল্ক বাধা’ দূর করার কথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রফতানি করা তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের তা ১৯ শতাংশ।

বিনিয়োগের সুরক্ষার নামে মুনাফার শুল্কবিহীন স্থানান্তর, দেশীয় বিনিয়োগকারীর সমসুযোগ, বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকারি ক্রয়নীতিতে দেশীয় পণ্য ও দেশীয় উৎপাদক এতদিন যে প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার পেত, সেটা সমভাবে পাবে আমেরিকার পণ্য ও উৎপাদকেরা। বিশেষ করে কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করার চাপ সৃষ্টি করে টিকফা চুক্তির মাধ্যমে কৃষিতে জনবান্ধব রাষ্ট্রনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে।

দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা’র মূল বিষয়গুলোও ছিল অ-কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্তকরণ, কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, মেধাজাত সম্পত্তি অধিকার (ট্রিপস) এবং সার্ভিস বা পরিবেশ খাতে বিনিয়োগ উদারীকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের গুরুতর বিরোধ আছে।

বাদ যাবে না হার্ডওয়্যার খাতও

প্যাটেন্টের কারণে ক্লোন পিসি তৈরি থেকে শুরু করে দেশীয় ব্র্যান্ড আইসিটি পণ্যের বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে টিকফা চুক্তি। কেননা প্যাটেন্ট কোনো প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্ব দিয়ে দেয়। ফলে সে সেই মেধাস্বত্বের ভিত্তিতে সেই প্যাটেন্টের সাথে সম্পর্কিত যেকোনো বাণিজ্যে সে রয়্যালটি দাবি করতে পারে। যেমন ইন্টেলের প্রসেসর প্যাটেন্ট করা আছে আমেরিকার, তাই ক্লোন পিসি তৈরি করে নিজস্ব ব্র্যান্ড নেমে পণ্য বাজারে ছাড়তে হলে প্রথমেই উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়্যালটি দাবি করবে ইন্টেল। তখন দেশী ব্র্যান্ডের পিসির দাম বাড়ার কারণে ডেল, এইচপির মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পিসির দিকে ঝুঁকবে ক্রেতারা। বাংলাদেশ হারাবে নিজেদের বাজার

ফিডব্যাক : netdut@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস
অনুরূপ লেখা