লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ২
প্রযুক্তিতে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ২০১৩
ধাবমান সময় চলছে সময়ের নিয়মে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে নানা স্মৃতি। এসব স্মৃতির কোনোটি আশা জাগানিয়া, কোনোটি আবার থমকে দেয় দুর্ভাবনায়। এমনই আশা-নিরাশার নানা ঘটনায় বিদায় নিল ২০১৩। বছরটিতে নাগরিক জীবনে মোটা দাগে ছাপ ফেলে গেছে প্রযুক্তি। থ্রিজির উন্মাদনা নিয়ে শুরু হয় বছর। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদায় বেলায় প্রযুক্তি খাতের প্রতিস্তরেই বেজে ওঠে মন্দা-মাতম।
তারপরও ক্যালেন্ডারের পাতাজুড়ে ছিল প্রযুক্তি নিয়ে নানা আয়োজন, নানা ঘটনা। বছরের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির খেরোখাতায় আশা-ভঙ্গের তালিকাই যেনো দীর্ঘ হয়ে ওঠে অবশেষে। অবশ্য ব্যক্তি উদ্যোগে এই সময়ে প্রযুক্তি খাতে আমাদের অর্জনের নানা উপাখ্যান রচিত হয়েছে বিদায়ী বছরেই।
প্রযুক্তিতে আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
প্রাপ্তির তালিকায় প্রথমেই রয়েছে মুক্তপেশাজীবীদের নানা অর্জন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নানা ধরনের ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে ব্যক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বেশ কিছু অর্জন ও উদ্যোগ উজ্জ্বল করেছে দেশের মুখ। কমপিউটার প্রোগ্রামে বিস্ময় বালক ‘রূপকথা’র গোল্ডেন বুক অব ওয়ার্ল্ড লাভ ও গিনেস অভিযাত্রা বছরজুড়ে ছিল আলোচিত সংবাদের তালিকায়। এ বছরেই আমরা পেয়েছি প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’। অ্যান্ড্রয়িড ফোন থেকে ঢাকা মহানগরীর পুলিশি সেবার দরজা খুলে দিয়েছেন বুয়েটিয়ান মো. তারিক মাহমুদ ও মনসুর হোসেন তন্ময়। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী ওয়েব শিক্ষক ডটকমের জন্য ‘কমিউনিটি গ্র্যান্ড’ পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের কৃতী সমত্মান রাগীব হাসান। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রযুক্তিতে অনবদ্য অবদান রেখে গেস্নাবাল ওমেন ইনভেন্টরস অ্যান্ড ইনোভেটরস নেটওয়ার্কের (গুইন) সম্মাননা লাভ করেছেন লুনা শামসুদ্দোহা।
বিদায়ী বছরেই এশিয়া ও প্রশামত্ম মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রযুক্তিবিষয়ক সংগঠন অ্যাসোসিও’র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেশের প্রযুক্তি খাতের পরিচিত মুখ আবদুল্লাহ এইচ কাফি। বাংলা লেখার জনপ্রিয় সফটওয়্যার ‘বিজয়’-এর রজতজয়ন্তিতে আইটি খাতে অবদান রাখায় অ্যাসোসিও’র পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয় মোস্তফা জববারকে। ইনফরমেশন সোসাইটি ইনোভেশন ফান্ড (আইএসআইএফ) এশিয়া ২০১৩ সম্মাননা লাভ করে ‘আমার দেশ আমার গ্রাম’।
এর বাইরে বছরজুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন প্রোগ্রামার ও ডেভেলপারেরা। এসএমএসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ সুবিধার ইউনিভার্সেল স্মার্ট মিটার উদ্ভাবন করেন কুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মাসুম বিলস্নাহ ও লাবীব এবং যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জিএম সুলতান মাহমুদ রানা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ‘ডিজিটাল ওয়াচার’ (ওডিভিআইপি-অবস্ট্যাকল ডিটেক্টর ফর ভিজ্যুয়ালি ইনপেয়ার) উদ্ভাবন করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল। স্মার্টফোনের অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ‘কোর্স মেট’ দল। বিশ্বের অন্যতম সেরা আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান ফ্রিল্যান্সার ডটকমে ‘কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট এবং সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন’ প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সেরা হিসেবে নির্বাচিত হলো বাংলাদেশের ডেভসটিম। এ বছরে মাইক্রোসফটের লার্নিং পার্টনার হিসেবে মনোনীত হয়েছে একটি স্কুল ও একজন শিক্ষক। বছরের শেষের দিকে আইসিটি মন্ত্রণালয় কর্তৃক দেশব্যাপী মোবাইল অ্যাপস নির্মাণের উদ্যোগও আশার আলো সঞ্চার করেছে। উদ্ভাবনী প্রযুক্তি প্রকল্পে এটুআইয়ের সহায়তাও ছিল ইতিবাচক। নজর কেড়েছ সেলফোন অপারেটর রবির উদ্যোগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবপতাকা রচনা আর বিভাগীয় পর্যায়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর লন্ডনের মাটিতে ই-বাণিজ্য মেলার আয়োজন।
কিন্তু নিয়মিত কমপিউটার মেলা যেমন হয়নি, তেমনি নানা সমালোচনার পরও অনুষ্ঠিত হয়নি ডিজিটাল টাস্কফোর্সের মিটিং। হালনাগাদ হয়নি সরকারি ওয়েবসাইটগুলো। নির্মাণাধীন অবস্থার উত্তরণ ঘটেনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ওয়েব পোর্টালের। উড়াল দিয়েও মুখ থুবড়ে পড়ে দেশী ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ প্রকল্প ‘দোয়েল’। বছরজুড়ে সমস্বরে উচ্চারিত হলেও চলতি বছর আলোর মুখ দেখেনি হাইটেক পার্ক। টেকনোলজি পার্ক, তাও আটকে আছে চোরাবালিতে। প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়নি বিদায়ী বছরেও। বিতর্কের মুখে পড়েছে অনলাইন নীতিমালা এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধনী। মর্তলোকের মতো ভার্চুয়াল জগতেও নজরদারি বাড়েছে, একই সাথে বেড়েছে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি। একই কারণে বিকাশ হয়ে উঠেছে প্রতারণার হাতিয়ার। আইটি ফরেনসিক ল্যাবের অভাবে বেড়েছে প্রাযুক্তিক প্রতারণা আর হয়রানি। ওলেক্সের মতো বিদেশী কোম্পানির আগমনে ই-বাণিজ্যের স্থানীয় বাজার নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন দেশী উদ্যোক্তারা। বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি দিন দিন গৌণ হয়ে উঠছে নিয়মিত বিজ্ঞান সপ্তাহ। মানসম্মত ল্যাবের অভাবে গবেষণা কাজও শুরু করা দায় হয়ে পড়েছে। আইসিটি খাত নিয়ে নেই পরিসংখ্যান। প্রকাশ করা হয়নি কোনো গবেষণা প্রতিবেদনও। অন্যদিকে রাজনৈতিক লাইসেন্স দান, আইজিডব্লিউ অপারেটরগুলোর অপারেশন ব্লক করা, থ্রিজির নিলাম, অবৈধ ভিওআইপি বেড়ে যাওয়ায় বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল টেলিযোগাযোগ খাত। এম মধ্য দিয়েও মোবাইলে আর্থিক সেবা বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বিপুল প্রসার হয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ কোটি।
টেলিকম খাত
টেলিযোগাযোগ খাতে চলতি বছর সবচেয়ে আলোচিত ছিল থ্রিজি লাইসেন্সের নিলাম। ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নিলামে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল লাইসেন্স নেয়। থ্রিজি লাইসেন্স থেকে সরকারের আয় হয় ৪ হাজার ৮১ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নিলাম ছিল এটি। থ্রিজির বাণিজ্যিক অভিযাত্রার পরই চারটি অপারেটরই গ্রাহকদের জন্য থ্রিজি ইন্টারনেট সেবা দেয়া শুরু করে। ভয়েস কলের পাশাপাশি উচ্চগতির ইন্টারনেট, ভিডিও কল, মোবাইলে টিভি দেখার মতো সব সেবার সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে মানুষ। আর এ যাত্রায় লাইসেন্স না পেয়ে খুবই খারাপ সময় পার করে দেশের একমাত্র সিডিএমএ অপারেটর সিটিসেল।
থ্রিজি ছাড়া বছরজুড়ে চরম বিশৃঙ্খলার জন্য টেলিযোগাযোগ খাতে আলোচিত ছিল ২০১৩ সাল। আমত্মর্জাতিক কল অবৈধভাবে টার্মিনেশন হওয়ায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায় সরকার। এটা রোধ করতেই ১ হাজার ৪টি প্রতিষ্ঠানকে ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার (ভিএসপি) লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। তবে ভিওআইপি পরিচালনার জন্য ৮৬৫টি লাইসেন্স দেয়ার পরই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির সুপারিশ ছিল মাত্র ২৫৭টি লাইসেন্সের। রাজনৈতিক বিবেচনায় এত সংখ্যক লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। সম্প্রতি নতুন করে ভিএসপির আরও ১৩৯টি লাইসেন্স দিতে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া বহু বিতর্কিত একটি ওয়াইম্যাক্স লাইসেন্সও দিয়েছে সরকার। ওয়াইম্যাক্স নীতিমালায় নতুন করে আর কোনো লাইসেন্স দেয়ার বিধান না থাকলেও নীতিমালা সংশোধন করে ‘ওলো’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়ে বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালে বিটিআরসি।
পাশাপাশি বকেয়া পরিশোধ না করায় ১০টি আইজিডব্লিউর (আন্তর্জাতিক গেটওয়ে) অপারেশন বস্নক করে দেয় বিটিআরসি। এর মধ্যে দুটি অপারেটরের লাইসেন্স বাতিলের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় বিটিআরসি। ৯টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া বিটিআরসির। ৯টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকারের প্রভাবশালীরা। বকেয়া পড়েছে আইসিএক্স প্রতিষ্ঠানের টাকাও। চলতি বছরই ৬টি মোবাইল ফোন অপারেটরে অবৈধ ভিওআইপি জন্য অভিযান চালায় বিটিআরসি। সংস্থাটি অপারেটরগুলোর ৫০ হাজারের বেশি সিমও জব্দ করে। উত্তরা থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জামসহ ৩৭ বিদেশীকে গ্রেফতার করে র্যােব।
বছরের শেষ দিকে উচ্চগতির ইন্টারনেট নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে অপারেটর-বিটিআরসি। সেলফোনে বাণিজ্যিকভাবে তৃতীয় প্রজন্মের সংযোগ সেবা চালুর দুই মাসের মাথায় রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিফোন সংস্থা, তিনটি ওয়াইম্যাক্স সেবা অপারেটর ও অপর একটি আইআইজি অপারেটরকে চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবার লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্তে দেখা দিয়েছে বিনিয়োগ ঝুঁকি। বাজার হারানোর আশঙ্কা নিয়েই নতুন বছরে পা রাখে সেলফোন অপারেটরেরা। অবশ্য দেশে ইন্টারনেট আরও সহজলভ্য করতে নতুন বছরে বাংলা লায়ন, কিউবি, বাংলাদেশ ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (বিআইইএল), ম্যাংগো ও রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ কোম্পানি বিটিসিএল-কে ২৪৬ কোটি টাকায় থ্রিজির চেয়েও দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রযুক্তি ‘লং টার্ম ইভ্যালুয়েশন’ (এলটিই) লাইসেন্স দেয়ার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে বলে দাবি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির। অবশ্য এর মধ্যে ওলো ব্র্যান্ড নাম থেকে বাংলাদেশ ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (বিআইইএল) নামে নিবন্ধিত হয়ে ব্যবসায় শুরম্ন করা প্রতিষ্ঠানটির বিরম্নদ্ধে রাজনৈতিক মদদের বিতর্ক এখন ওপেন সিক্রেট। থ্রিজি লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল এয়ারটেলের বিরুদ্ধে। বছরের শেষভাগে মোবাইল ফোনে আর্থিক লেনদেনের সীমা বেঁধে দেয়ার দু’দিনের মধ্যে পিছু হটে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। আগামী ২০ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অনুষ্ঠেয় আইটিইউর সম্মেলন চলাকালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) কাউন্সিলর নির্বাচনে আবারও অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে ৬শ’ টাকা পর্যন্ত টেলিফোন বিল সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আবার নিয়ম ভেঙে ‘১৯৭১’ শর্টকোডটি বরাদ্দ দেয়া হয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনকে (সিআরআই)। অবশ্য বছরজুড়ে বিভিন্ন শর্টকোড ব্যবহার করে কিংবা নম্বর মাস্কিং করে ভুয়া বার্তা ও লোভনীয় অফার পাঠিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার ঘটনাও বাড়ে বিদায়ী বছর।
অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু ও কর্মচারীদের অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গ্রামীণফোন ছিল বিতর্কের শীর্ষে। এ বছরই বাংলাদেশে প্রথম কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হিসেবে জিপিপিসি নির্বাচন হয় মে মাসে। নভেম্বরে নিজেদের অধিকার রক্ষার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ থেকে শামিত্মপূর্ণ আন্দোলন করায় চলতি বছরের ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ পায় জিপিইইউ। একই সময়ে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে দেশের প্রথম কর্মচারী ইউনিয়ন হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি পায় গ্রামীণফোন বাংলাদেশ লিমিটেডের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সংগঠন ‘গ্রামীণফোন লিমিটেড শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন বাংলাদেশ’। চার বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৮ ডিসেম্বর রবি থেকে অবসরে যান এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাইকেল ক্যুনার। গিনেস বুকে দেশের নাম লেখাতে মোট ২৭ হাজার ১১৭ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবপতাকা রচনা করে রবি।
বাংলালিংকের উদ্যোগে শুরু হয় উইকিপিডিয়া জিরো প্রকল্প। এছাড়া ৩ অক্টোবর প্রথমবারের মতো থ্রিজি প্যাকেজ অনুমোদন পায় গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক। ২২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলালিংক থ্রিজি। ২৮ অক্টোবর ৩.৫জির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে রবি। ৯ নভেম্বর ২৫৬ কেবিপিএস স্পিডে ওয়াই-ফাইয়ের অনুমোদন নেয় বাংলালিংক। ১২ নভেম্বর প্রথম অনলাইন ফটোগ্রাফি স্কুল চালু করে রবি। ১৯ নভেম্বর গাজীপুরে শুরু হয় স্কুলভিত্তিক রবির ইন্টারনেট মেলা। ৩০ নভেম্বর আরও ছয় মাস পরীক্ষামূলক থ্রিজি সেবা দেয়ার অনুমোদন পায় টেলিটক।
হার্ডওয়্যার খাত
থ্রিজি চালুর পর থেকে বিদায়ী বছরে দেশে স্মার্টফোনের পাশাপাশি ট্যাবলেট পিসি বা ট্যাবের বিক্রি বাড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিক্রি কমে স্থবির হয়ে যায় হার্ডওয়্যার খাত।
অর্থবছরের প্রথম চার মাসে কমপিউটার ও কমপিউটার যন্ত্রাংশ আমদানির হার পড়ে যায় ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন্স বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) কমপিউটার ও কমপিউটার যন্ত্রাংশ আমদানির পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৮৭ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। গত বছর একই সময়ে এই অংশ ছিল ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার ডালার। বছরজুড়েই দেশের হার্ডওয়্যার পণ্যের বাজারে ছিল হাহাকার। পণ্যের (কমপিউটার, ল্যাপটপসহ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ) বিক্রি কমে যায় ৮৫ শতাংশ। মাসে ১৮০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
মন্দাবস্থার কারণে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির (বিসিএস) আয়োজনে দুটি আঞ্চলিক মেলা ছাড়া আর কোনো মেলা হয়নি। হয়নি সারাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি সচেতনতা কর্মসূচি পালন। বিসিএস কমপিউটার সিটির (আইডিবি ভবন) বার্ষিক মেলাও হয়নি। এছাড়া বিসিএসের আয়োজনে মার্চ ও নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশে কমপিউটার মেলা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। এ দুটি মেলাই দেশের সবচেয়ে বড় কমপিউটার মেলা। এ বছরের আলোচিত ল্যাপটপ মেলাও হয়নি। ব্যবসায়ে দীর্ঘদিন ধরে মন্দাবস্থা বিরাজ করায় অনেক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
অবশ্য মোবাইল ফোন ও মোবাইল ফোন যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-অক্টোবরে মোবাইল ফোন থেকে এসেছে ১৩ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এই পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর গত দুই অর্থবছরের এই খাতে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৮ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার ও ২৮ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। মোবাইল ফোনের মতো মোবাইল ফোন যন্ত্রাংশ আমদানিতেও একই ধারা লক্ষ করা গেছে। বছরের প্রথম চার মাসে এই খাতে আমদানি হয়েছে ১ কোটি ১০ হাজার ডলার। গত বছর এটি ছিল ৮৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার। আর পরপর দুটি অর্থবছরে এই খাতে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩ কোটি ৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার ও ২ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার ডলারের সমপরিমাণ।
সফটওয়্যার খাত
দেশীয় সফটওয়্যারের বাজার ছোট হলেও গত বছরে ১০ কোটি ডলারের সফটওয়্যার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে দেশ। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) আয়োজনে দেশে প্রতিবছর আন্তর্জাতিকমানের সফটওয়্যার মেলা অনুষ্ঠিত হলেও চলতি বছর দুই দফা তারিখ পিছিয়েও শেষ পর্যন্ত মেলার আয়োজন বাতিল করে বেসিস কর্তৃপক্ষ।
তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সফটওয়্যার রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৬৭ লাখ মার্কিন ডলার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মাসভিত্তিক রফতানি আয়ের অক্টোবর পর্যন্ত রফতানির তথ্য বলছে, চার মাসে সফটওয়্যার থেকে আয় বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ সময়ে ৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে ১ কোটি ডলারের বেশি। চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের মোট আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। গত ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে আয় দাঁড়িয়েছিল ১০ কোটি ১৬ লাখ ডলার। ওই বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৮ কোটি ডলার। আর তাই বেসিসের লক্ষ্য ২০১৮ সালের মধ্যে সফটওয়্যার খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করা।
এ বিষয়ে বেসিস সভাপতি শামীম আহসান বলেন, সফটওয়্যার খাতে আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ই-কমার্সের বাজার বেড়েছে এ বছর। অনলাইনে কেনাটাকার একটি সংস্কৃতি এরই মধ্যে দেশে তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। দেশে কার্ডভিত্তিক লেনদেনও (ডেবিট ও ক্রেডিট) চলতি বছর আশানুরূপ হারে বেড়েছে বলে তিনি জানান। আউটসোর্সিংয়ে অভাবনীয় উন্নতি করেছে দেশ।
অনলাইন বিশ্বে বাংলাদেশ
বিদায়ী বছরে দেশজুড়ে ছিল অনলাইনের জয়জয়কার। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইউটিউব বন্ধ করে দেয়া হয় বাংলাদেশে। ইউটিউবে প্রকাশিত মার্কিন চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ প্রকাশের পর থেকে বিটিআরসি দেশে ইউটিউব বন্ধ করে দেয়। প্রায় চার মাস পর ২০১৩ সালের শুরম্নর দিকে পুনরায় দেশে চালু করা হয় ইউটিউব।
দেশের তরুণদের ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিচরণের স্বাক্ষর বহন করেছে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘আরব বসন্ত’ গড়ে ওঠায় ব্লগ ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন সক্রিয় থেকেছে, একইভাবে আমাদের দেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বস্নগ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জোর ভূমিকা রেখেছে। তবে এ বছর বিতর্কে জড়িয়েছে অনেক ব্লগারই।
তাই সারাবিশ্বে যখন অনলাইনে নজরদারির ঘটনার তীব্র সমালোচনা চলছে, তখন চলতি বছরে এসে বাংলাদেশেও অনলাইন নজরদারি শুরু হয়েছে। অনলাইনে সাম্প্রদায়িকতা বিনষ্টকারী, ধর্মীয় মূল্যবোধ আঘাতকারী কিংবা কোনো ধরনের উস্কানির সাথে সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করতে শুরু হয় এই নজরদারি। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষেও এই নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এদিকে এ বছরেই প্রথমবারের মতো ব্লগিংয়ের কারণে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে দেশে। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন প্রথম গ্রেফতার হয়। পরে আরও কয়েকজন বস্নগারকে গ্রেফতার করা হয় ব্লগিংয়ের মাধ্যমে উস্কানিমূলক কর্মকা--র অভিযোগে।
অবশ্য ব্লগিং আন্দোলনের পাশাপাশি ২০১৩ সালে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচরণ বেড়েছে। এ বছর ফেসবুকের আইডি অর্ধকোটি পার (প্রায় ৬০ লাখ) হলেও ফেক আইডির সংখ্যাও বেড়েছে এ সময়ে। ফেসবুক ও বস্নগে এ বছরও ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রকাশ, রাজনীতি ও রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয় এবং তা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদও হয় বিসত্মর। বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার আইসিটি (তথ্যপ্রযুক্তি) আইন সংশোধন করে শাস্তির বিধান বাড়ায়। গত ১৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তথ্য এবং যোগাযোগ ও প্রযুক্তি সংশোধনী আইন-২০১৩ অনুমোদন দেয়া হয়। পরদিন তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। তবে অধ্যাদেশটিতে রয়েছে জোর বিতর্ক।
তাই তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষদের মধ্যে বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর সংশোধনী। সংশোধনীতে মূল আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য করা হয়। ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো ধরনের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের ক্ষমতা লাভ করবে এসব অপরাধে অভিযুক্তদের। অপরাধগুলোকে অজামিনযোগ্যও করা হয়। এ আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধের শাস্তির মেয়াদও বাড়িয়ে ন্যূনতম ৭ বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর করা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোতে অপরাধের বিবরণেও অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট নয়। ফলে এ আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের। এ আইন সাইবার স্পেসে বাকস্বাধীনতাকে অনেকটাই খুন করবে বলে মন্তব্য তাদের ।
ফিডব্যাক : netdut@gmail.com