লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
হিটলার এ. হালিম
মোট লেখা:১৪
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ৩
২০১৪ সালের টেলিযোগাযোগ খাত
এলো নতুন একটি বছর ২০১৪। তবে এ বছরটি আগের অন্তত পাঁচটি বছরের তুলনায় হয়ে উঠতে পারে অনেক ঘটনাবহুল। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জগতে অনেক সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ববাসী আবাহন করেছে নতুন বছরটির। শুধু নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন বা ব্যবহারোপযোগিতা বাড়ার ব্যাপারটিই নয়, এ বছরটিতেই মানুষের ধারণাগত ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আসতে পারে ব্যাপক পরিবর্তন।
গত কয়েক বছর ধরে যে ধারাটি প্রধান ছিল, তা হচ্ছে মুঠোফোননির্ভর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার। ২০১৩ সালে এ বিষয়টি ব্যাপকতা লাভের সম্ভাবনা তৈরি করেছে অ্যান্ড্রয়িড ও আইওএসের মাধ্যমে। ২০১৪ সাল তাই হতে যাচ্ছে ওই সম্ভাবনার বাসত্মবায়ন ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার বছর। ক্ষুদ্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের যন্ত্রের ব্যাপক প্রসারের জন্য সামনে থাকা যত ধরনের বাধা, সবই অতিক্রম করার মহচ্ছটা আসলে শুরু হতে যাচ্ছে এ বছরটিতেই। টেক জায়ান্টরা প্রথমত যে কাজটা করতে বলেছে, তা হচ্ছে ভাষার ব্যবধান দূর করে আফ্রিকা ও এশিয়ার আরও বেশি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা এবং অ্যান্ড্রয়িড, আইওএস ছাড়াও আরও অভিনব প্রযুক্তির মাধ্যমে থ্রিজি ও ফোরজি প্রযুক্তিকে ছড়িয়ে দেয়া। এ জন্যই চলমান প্রযুক্তিগুলোর পরিচালনা পদ্ধতির উন্নয়ন তথা সহজবোধ্য করে তোলার আয়োজন চলছে। ইতোমধ্যে আফ্রিকা ও ভারতের আঞ্চলিক কিছু ভাষাকে অনুবাদযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে এবং এ প্রযুক্তি আরও বেগবান করা হবে ২০১৪ সালে।
স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে- গুগল, ইয়াহু, অ্যাপল ও মাইক্রোসফটই প্রধানত ২০১৪ সালে তুমুল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রযুক্তি ও সেবার উন্নয়ন ঘটাবে। এ প্রতিযোগিতার নানা বৈশিষ্ট্য ২০১৩ সালেই বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মূলত দেখা গিয়েছিল অ্যাকুইজিশনগুলো এবং গবেষক ও কর্মকর্তাদের এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্ম পরিবর্তনের প্রবণতা। এসব পরিবর্তনের ফল ফলতে দেখা যাবে ২০১৪ সালেই। এ ক্ষেত্রে প্রথম চমকের অপেক্ষা থাকতে হবে মাইক্রোসফটের নকিয়া অ্যাকুইজিশনের ফল কেমন হয় সে জন্য। এছাড়া অ্যাপল আর স্যামসাংয়ের যে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে যুদ্ধ তার পরিণতিটাও দেখতে চাইবেন অনেকেই। তবে সবচেয়ে রহস্যময় হয়ে উঠেছে মনে হয় গুগলই। কারণ একদিকে এরা অ্যান্ড্রয়িডের বাজার ও আওতা বাড়ানোর জন্য মরিয়া, অন্যদিকে আবার নতুন বিস্ময়কর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার উদ্যোগও নিয়েছে। গুগলের অ্যান্ড্রয়িড প্রকল্পের প্রধান অ্যান্ডি রম্নবিনের নতুন ও বিশেষ প্রকল্প নাকি রোবট নিয়ে! আর এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগণ্য রোবটিক প্রতিষ্ঠান বোস্টন ডায়নামিক্স কিনে নিয়েছে গুগল। অ্যান্ডি রম্নবিনের মাথায় কী ঘুরছে, তা জানেন খুব কম লোকই। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, দ্রুত পরিবহনে সক্ষম স্বয়ংক্রিয় উড়ুক্কু যান তৈরি করবেন তিনি। যেমন কয়দিন আগে আমাজন তাদের ডেলিভারি ড্রোনের ডেমো দেখিয়েছিল। কিন্তু অনেকে আবার মনে করছেন, রম্নবিন রোবটিক প্রযুক্তিকে সমন্বয় করবেন অ্যান্ড্রয়িড ধরনের প্রযুক্তির সাথে এবং তার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হবে মুঠোফোন ধরনের ডিভাইসভিত্তিক। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকা অনলাইন বাণিজ্যে পণ্য সরবরাহের বক্সড প্রযুক্তিকে আরও উন্নততর করে তুলবেন তিনি। বোস্টন ডায়নামিক্স মার্কিন সমর বিভাগের ডরপা প্রকল্পের কাজগুলো করে। সেই সাথে টেক জায়ান্ট সনির রোবটিক প্রকল্পগুলোর উপদেষ্টারও কাজ করে। এ ছাড়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নানা ধরনের গবেষণাও করে। গুগল কোটি কোটি ডলার দিয়ে কিনেছে বোস্টন ডায়নামিক্স এবং জানিয়েছে চলমান প্রকল্পগুলো বন্ধ হবে না, শুধু সাথে যোগ হবেন অ্যান্ডি রম্নবিন তার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে।
গুগলের আরও কিছু কাজ আসছে। এদের সার্চ ইঞ্জিনের অনুবাদ সেবায় এখন ভাষার সংখ্যা ৮০টি। নতুন করে ৩০ কোটি মানুষ যোগ হচ্ছে এ সেবায়। এটাকে সেবা বলা হলেও আসলে বাণিজ্য বাড়ানোরই নামান্তর হয়ে উঠবে ও মানুষের অভ্যাস পরিবর্তনে অবদান রাখবে। এ ক্ষেত্রে যে উদাহরণগুলো এখন পর্যন্ত আছে, তা হলো টেক জায়ান্ট গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপল, ইয়াহুর। এদের পাশাপাশি কিন্তু অখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে চীন ও তাইওয়ান বাজার দখলের চেষ্টায় এতদিন লড়ছিল অনেকটা পেছনে থেকেই। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকেই এরা সামনে এগুনোর চেষ্টা শুরু করেছে। এর অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি হলো তাইওয়ানের ফক্সকন। আঞ্চলিক বাজারে মোটামুটি ভালো করলেও ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে ভালো করতে পারছিল না। এরা খোঁজ করছিল জনপ্রিয় ও চাহিদা আছে এমন এক ব্র্যান্ডের। সেটা এরা পেয়েও গেছে। সেটা হলো ব্লাকবেরি। বস্ন্যাকবেরি এক সময় জগত দাপিয়ে বেড়ালেও অ্যান্ড্রয়িড ও আইওএস আসার পর স্মার্টফোনের বাজার থেকে ছিটকে পড়েছিল। গত প্রান্তিক তাদের ক্ষয়তির পরিমাণ ছিল ৪৪০ কোটি ডলার। আর আয় ছিল মাত্র ১১৯ কোটি ডলার। ব্ল্যাকবেরির মূল কোম্পানির নাম রিম (রিসার্চ ইন মোশন)। এর সাথেই তাইওয়ানের ফক্সকন চুক্তি করেছে পাঁচ বছরের জন্য। এরা বস্ন্যাকবেরিকে আইওএস বা অ্যান্ড্রয়িডের সমক্ষ প্রযুক্তি সরবরাহ করবে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু একেবারে অনভিজ্ঞ এরা নয়। কারণ আগে এরা অ্যাপলের সাথে কাজ করেছে। আসলে ফক্সকন চেয়েছিল ব্ল্যাকবেরি ব্র্যান্ড ও টেকনোলজি কিনে নিতে, কিন্তু রিম রাজি হয়নি। অগত্যা চুক্তি হয়েছে পাঁচ বছরের জন্য। এ পাঁচ বছরের প্রথম বছরটিই হচ্ছে ২০১৪। আর তাই এ সময়েই ব্ল্যাকবেরিপ্রেমীরা পেয়ে যাবেন প্রতিযোগিতামূলক স্মার্টফোন।
মূলধারার অর্থনৈতিক এবং আর্থিক বাণিজ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আরও কিছু অবদান রাখবে ২০১৪ সালে। শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে আগাম ধারণা দেয়ার বিষয়টিও এখন চলে এসেছে আইসিটির আওতায়। এ ছাড়া অর্থ লেনদেনে সাধারণ ও অনলাইন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দেয়ার কাজটাও সফলভাবে শুরম্ন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ভারতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ২০১২ থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমকে আরও নিরাপদ ও বেগবান করার জন্য চেষ্টা চলছিল। এখন জানা গেছে, এ বছরই এ ব্যাপারটিকে প্রধানতম লেনদেনের মাধ্যম করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ অনলাইনে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ও বিভিন্ন পেমেন্ট পরিশোধ ইত্যাদির যে বাধাগুলো এখন আছে, সেগুলো দূর হবে। জব সার্চ এবং এমপ্লয়মেন্টের বিষয়গুলোকে সহজ ও নির্ভরযোগ্য করে তোলার কাজটাও মূলত অনলাইনভিত্তিক করে তোলার প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সাফল্য এসেছে ইতোমধ্যে, কিন্তু মাধ্যমগুলো তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালে এরা চাইছে বিশ্বের অন্তত ৫০ শতাংশ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ হবে তাদের মাধ্যমে।
শিক্ষা বিস্তারে অনলাইন কার্যক্রমকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সাথে জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকও উদ্যোগ নিয়েছে। এর আওতায় বিভিন্ন সংস্কৃতির কনটেন্ট তৈরির কাজ শুর হয়েছে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে। বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষার মাধ্যমে বাসত্মবভিত্তিক অনলাইন শিক্ষা উপকরণ দেশীয় বা স্থানীয় ভাষায় তৈরি করা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়গুলোকে আগামী তিন বছরে সম্পন্ন করার একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে জাতিসংঘ। এ বিশ্ব সংস্থাটি চাচ্ছে ২০১৭ সাল থেকে বিশ্বের কোনো দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেনো নেটওয়ার্কের বাইরে না থাকে।
এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে উচ্চতর শিক্ষার বিষয়গুলোকে অনলাইনে হালনাগাদ রাখার জন্য। গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা এ উদ্যোগ ২০১৪ সালের শেষ পর্যায়ে উপনীত হবে বলে মনে করছে এরা। দর্শন, পদার্থবিদ্যা চিকিৎসাশাস্ত্র ও সহিত্যকে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।
এই বাংলাদেশে বসেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একদিকে থ্রিজি নেটওয়ার্ক ক্রমাগত বিসত্মার লাভ করছে, স্মার্টফোন-ট্যাবলেট ইত্যাদি হ্যান্ডহেল্ড ডিভাইসের দাম কমছে, অন্যদিকে জাতিসংঘ-বিশ্বব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন সুবিধা ও সেবার আওতা বিসত্মৃতির কাজ চলছে। ২০১৪ সালে এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান আরও কিছু সামনে আসবে- এটাই সবাই আশা করে
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com