লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
স্বাস্থ্য পরিসেবায় আইটির ব্যবহার এবং নীতি প্রসঙ্গ
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য পরিসেবার কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। উন্নত দেশগুলো আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীর সব তথ্য সংরক্ষণ করে। এতে সরকার জানতে পারে কোন রোগে দেশের কী পরিমাণ রোগী আছে। আমাদের দেশে অন্যান্য রোগের যেসব জরিপ হয়, তাতে প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, কিন্তু রোগের চিকিৎসা সেবার বিস্তারিত তথ্য সেখানে থাকে না। থাকার সুযোগও সীমিত।
আমাদের দেশের মতো গরিব দেশগুলোয় চিকিৎসা সেবা এমনিতেই ব্যয়বহুল ও জটিল। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব, যা অনেক দেশে প্রমাণিত। গত এক দশকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সবিশেষ অগ্রগতি হয়েছে, অনেক তরুণ প্রযুক্তিসেবার নতুন ধারণা বাস্তবায়ন করছে, যা বিভিন্ন খাতে উদ্ভাবনী কৌশল নির্মাণে স্বীকৃত হয়েছে ও নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিসেবায় তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে কম। অবশ্য কিছু কিছু দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, যা নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে।
ঢাকার বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল রোগীদের তথ্য-উপাত্ত বা রেকর্ড সংরক্ষণ করে। এই কাজে বেশ কিছু আধুনিক ও উন্নতমানের সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই আমাদের দেশে তৈরি করা হয়েছে। যদিও এসব সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে হাসপাতালের বিলিং রেকর্ড বা টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর তথ্য সংরক্ষণে যে পরিমাণ মনোযোগ বা অগ্রাধিকার দেয়া দরকার, সেটি না থাকায় রোগের তথ্য বিস্তারিত পাওয়া যায় না। ফলে কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা এখনও বিদ্যমান।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবন হয়েছে বেসরকারি খাতে, মাঠ পর্যায়ে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে মোবাইল ডিভাইস, ফোন বা ট্যাবলেট। গ্রামে-গঞ্জে সীমিত আকারে ইন্টারনেট বিসত্মৃত হওয়ার ফলে মোবাইল ডিভাইস দিয়ে ইন্টারনেটভিত্তিক স্বাস্থ্য উপাত্ত সংগ্রহ, রোগীদের ফলোআপ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার বেশ কিছু কাজ ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যায় এসএমএসভিত্তিক কিছু কাজও বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছে। কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্যান্সার রোগীদের তথ্য ব্যবস্থাপনায় ও রোগ পরিচর্যায় মোবাইল ফোনের কার্যকর ব্যবহার করে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
স্বাস্থ্য উপাত্ত সংরক্ষণ কতখানি জরুরি এখন তা নিয়ে বিতর্ক না থাকলেও উপাত্ত সংরক্ষণ কোন মেয়াদের জন্য হবে, তা নিয়ে বা কতদিন এই উপাত্ত ধরে রাখা হবে, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ডাটা সেন্টার স্থাপন করে অন্তত বছরওয়ারী তথ্য সংরক্ষণ জরুরি। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা যখন স্বাস্থ্য উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা নেন, তখন এসব উপাত্ত বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য বিষয়ক উপাত্ত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দুটি দিক প্রণিধানযোগ্য :
০১.স্বাস্থ্য উন্নয়ন গবেষণায় রোগের প্রাদুর্ভাব, বিসত্মৃতি, চিকিৎসা ও মান সংরক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে যথাযথভাবে রাখা স্বাস্থ্য উপাত্ত গবেষণার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নির্ণয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
০২.স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ছাড়া বহুমুখী সেবা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। একটি সফল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশেরই মৌলিক পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হতে পারে না।
এসব গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের সরকারের বেশ কিছু নীতিগত পদক্ষেপ জরুরিভাবে নেয়া দরকার।
সংক্ষেপে কয়েকটি সম্ভাব্য ও আমাদের দেশে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করছি :
০১.সরকারি উদোগে হেলথ ডাটা সেন্টার নামে একটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। বর্তমানের স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখা এ ধরনের কাজের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্ত্তত নয়। দেখা গেছে, সরকার যখন কোনো বিভাগ আধুনিকায়ন করেন, তখন তার জনবলের মধ্যে আগের ধাঁচে কাজ করা জনবল সহজে নতুন কাজের ধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে না, বা বেগ পেতে হয়। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আধুনিক পদ্ধতিতে উপাত্ত সংগ্রহ, বিন্যাস ও সংরক্ষণ বর্তমানে হাতে কাজ করা অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়ায় এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী চ্যালেঞ্জ নেয়াই শ্রেয়, সরকারকে তার পরিকল্পনায় সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য বাস্তবায়নে সমস্যার মুখে পড়তে হয়।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশে প্রচুর প্রশিক্ষিত তরুণ জনবল আছে, যারা এ কাজে সরকারকে ভালোভাবে সহযোগিতা করতে পারবে।
০২.উপাত্ত সংগ্রহ পদ্ধতি আধুনিক, উদ্ভাবনী ও ব্যয়সাশ্রয়ী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রণোদনাভিত্তিক উদ্ভাবন প্রকল্প হাতে নিয়ে মোবাইল ডিভাইসসহ অন্যান্য সাশ্রয়ী ডিভাইস ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে ভালো মানের তথ্যপ্রযুক্তির প্রায়োগিক গবেষণা কেন্দ্র বা সুযোগ না থাকায় আমাদের তরুণদের উদ্ভাবনাগুলো যথেষ্ট স্বীকৃতি পাচ্ছে না। কিছুদিন ধরে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান কিছু মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির উদ্যোগ নিলেও প্রায়োগিক গবেষণার সুযোগ না থাকায় এসব ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সাফল্য আসছে না।
সরকারকে এ বিষয়ে উপযুক্ত নীতি-পরিবেশ তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে তরুণদের উৎসাহ দেয়ার নামে কর্পোরেট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের পুরস্কার দিয়ে কাজের আগেই স্বীকৃতি দিয়ে দেয়ার অভিনব কৌশল হাতে নিচ্ছে। কোনো প্রায়োগিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি না করে প্রচারের জন্য তৈরি এসব কর্মকা- বন্ধ হওয়া দরকার। এতে তরুণদের সৃজনশীলের ক্ষতি হয়, যার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।
০৩.স্বাস্থ্য উপাত্ত বিন্যাসে স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, গবেষক, চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলোর সক্রিয় অংশ নেয়া বাড়াতে হবে। সরকারকে নিয়মিত স্বাস্থ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ দেখে নিতে হবে।
যেকোনো পরিকল্পনার আগে তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের সাথে আলোচনা করে নেয়া বাঞ্ছনীয়। এ ধরনের সমন্বিত আলোচনা পরিকল্পনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত কর্মকর্তাদের জন্য সহায়ক হবে।
০৪.স্বাস্থ্য উপাত্ত ব্যবহার হাসপাতালগুলোর জন্য চিকিৎসা পরিসেবা উন্নয়নে আন্তযোগাযোগের অন্যতম জরুরি বিষয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় আমাদের দেশের উপযোগী নীতিমালা বা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইন তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন। টেলিমেডিসিন সেবায় কারও ব্যক্তিগত তথ্য যেনো গোপনীয়তার শর্ত ভঙ্গ না করে, সে বিষয়টিও সরকারকে বিশেভাবে লক্ষ করতে হবে। আশা করি সরকারের নীতি-নির্ধারণ মহল প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখবে।
লেখক : পরিচালক আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প
ফিডব্যাক : rezasalim02@yahoo.com