• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > বাজেটে অবহেলিত আইসিটি খাত
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: ইমদাদুল হক
মোট লেখা:৬২
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৪ - জুলাই
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
বাজেট
তথ্যসূত্র:
বাজেট ও ‍আইসিটি
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
বাজেটে অবহেলিত আইসিটি খাত
ইতোমধ্যেই সংসদে ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বড় আয়তনের বাজেট পাস হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ ৬১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৩ শতাংশ। আয়তনে, আয়-ব্যয়, ঘাটতিতে এ বাজেট সবচেয়ে বড় বাজেট। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কার মধ্যেই বড় বাজেট এসেছে।
বাজেটে আইসিটি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর আশার বাণী শোনা গেলেও তা সরকারি প্রকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং সেই প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখলেই সেই বরাদ্দ থেকে প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন দৃষ্টিগোচর হতে পারে।
ভোক্তা পর্যায়ে ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের প্রতিশ্রম্নত ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ১৫ শতাংশ কর প্রত্যাহার না করা, সেলফোন আমদানিতে ১৫ শতাংশ আমদানি-শুল্ক আরোপ, আইসিটি খাতকে ‘অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পরও এই খাতে পণ্যগুলোর সুষম শ্রেণী-বিন্যাস না করে বাজেটে আইসিটি পণ্যের ওপর উচ্চহারের আমদানি-শুল্ক ও ভ্যাট বলবৎ রয়েছে।

আইসিটি নীতিমালা ও বাজেট
বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে প্রণীত ‘জাতীয় আইসিটি নীতিমালা ২০০৯’-এ রয়েছে ১০টি উদ্দেশ্য, ৫৬টি কৌশলগত বিষয়বস্ত্ত ও ৩০৬টি করণীয়। উল্লিখিত রূপকল্পে যে আরাধ্য কাজের কথা বলা আছে, তা হচ্ছে- ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করা; দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করা; সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা বাড়ানো; সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বে সুলভে জনসেবা জোগানো নিশ্চিত করা; ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ত্রিশ বছরের মধ্যে উন্নত দেশের সারিতে উন্নীত করার জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা।’ পাশাপাশি আমাদের জাতীয় আইসিটি নীতিমালার ১০টি উদ্দেশ্য হচ্ছে- সামাজিক সমতা, উৎপাদনশীলতা, অজ্ঞতা শিক্ষা ও গবেষণা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, তথ্যজগতে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার, পরিবেশ জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং আইসিটিতে সহায়তা দেয়া। রূপকল্প ও আইসিটি নীতিমালায় বর্ণিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে প্রকল্প-ভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। আইসিটি নীতিমালায় উল্লিখিত ৩০৬টি করণীয় সম্পর্কে জাতীয় নীতিমালার এক জায়গায় বাজেটে আইসিটি খাতে বরাদ্দের বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘...করণীয় বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক নিয়মিত কর্মকা- পরিচালনার জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়, দফতর ও সংস্থাগুলোয় আর্থিক বরাদ্দ দিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে আইসিটি উন্নয়নের জন্য তহবিল জোগানোর জন্য বার্ষিক বাজেট পরিকল্পনায় অনুদানের মাধ্যমে একটি আইসিটি তহবিল গঠন করা যেতে পারে।’ তাই আইসিটি খাতের সংশ্লিষ্টজনেরা জাতীয় বাজেটে বরাবরই আইসিটি খাতে বর্ধিত বাজেট বরাদ্দের প্রত্যাশা করে আসছেন।

আইসিটি খাতে বাজেট বরাদ্দ কমেছে
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে আইসিটি খাতে গত অর্থবছরের তুলনায় ৮৫ কোটি টাকা কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী আইসিটি খাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেটে ২০০৯-১০ অর্থবছরে আইসিটি খাতে উন্নয়নের সার্বিক বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ (সংশোধিত) অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ হাজার ২৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে আইসিটি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭১ শতাংশ। তবে বাস্তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত বাজেটে আইসিটি খাতের উন্নয়নে গত অর্থবছরের থেকে ৮৫ কোটি টাকা কম বরাদ্দ করা হয়েছে। এ অর্থবছরের জন্য ৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা আইসিটি খাতের উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অপরদিকে বাজেট পেশের পরদিন ৬ জুন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাজেটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে ৮৮০ কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। খবরে প্রকাশিত তথ্যে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৫৩০ কোটি টাকা। কিন্তু ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা : হালচিত্র ২০১৪’ অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের আবর্তক বরাদ্দ ৪ হাজার ২৪ কোটি টাকা থেকে কমে ৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। এ থেকে প্রতীয়মান, বিগত বছরগুলোতে বরাদ্দ দেয়া অর্থ কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার হয়নি। সারণী ৫-এ আইসিটি খাতে ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ সালের বাজেট বরাদ্দের তুলনামূলক বিশেস্নষণে দেখা যায়, বরাদ্দ বাড়ানোর পর থেকে কোনো বছরই বরাদ্দ দেয়া অর্থ কাজে লাগানো যায়নি।

আসলে বাজেটে আইসিটি খাতকে পূর্ণ অবয়বে আনতে না পারলে তা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রাখতে ব্যর্থ হবে। তাই আইসিটি খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য বাস্তব-ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ এবং তা সময় মতো বাস্তবায়ন করা উচিত। শুধু সফটওয়্যার বা আইটিইএস-কে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের একমাত্র উন্নয়ন খাত হিসেবে গণ্য করলে তা এই খাতের সক্ষমতাকে খাটো করে দেখা হবে। এতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত শ্রেণি-বৈষম্যের শিকার হবে। এই ডিজিটাল বৈষম্য বিশ্ববাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় তাল মেলানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

বাজেটে আইসিটি খাত নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশায় ফারাক
বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে বর্তমান সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত মেয়াদের উন্নয়নের বিবরণ তুলে ধরে বলেছেন, বর্তমান মেয়াদে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনকিউবেটর এবং কমপিউটার ভিলেজসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। বর্তমানে আট হাজার ডাকঘর এবং ৫০০ উপজেলা ডাকঘরকে ই-সেন্টারে রূপান্তরের কাজ চলছে। আমরা দ্বিতীয় সাবমেরিন কনসোর্টিয়ামের সদস্য হয়েছি। শিগগিরই এর সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছি। শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ ছাড়াও প্রশাসন, ব্যাংকিং, চিকিৎসা, ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং গণযোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন দÿÿণ এশিয়ার শীর্ষে। কিন্তু, এই খাতগুলোতে কাঙিক্ষত প্রযুক্তির ছোঁয়া আনতে যে সহজ ও সুলভ অবকাঠামোগত সুবিধা প্রয়োজন, বাজেটে সে বিষয়ের সুস্পষ্ট কোনো আলোকপাত করা হয়নি।
তারপরও আইটি খাতের সফলতা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে আইটি এবং আইটিএস শিল্প ৩০ কোটি ডলারের বাজার সৃষ্টি করেছে। এতে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ আয়ের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ২০ লাখ ডলার। এই আয় ২০১১-১২ অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি। উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হলে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে আইটি/আইটিইএস শিল্পের প্রবৃদ্ধি ৫০ থেকে ১০০ শতাংশে উন্নীত হবে।

একইভাবে প্রামিত্মক পর্যায়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সহজলভ্য না করে উপরন্তু এর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বলবৎ রেখেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রযুক্তিজ্ঞান-সম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে আইসিটি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বলেছেন, শুধু হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সংযুক্তি নয়, বরং এগুলো ব্যবহার করে সেবাদান পদ্ধতি আরও সহজ, দ্রুত এবং সাশ্রয়ী করা এবং জনসেবা গ্রহণ-পদ্ধতি আরও সহজ করার লÿ্য নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। সেই লক্ষেই অভ্যন্তরীণ সংযোগ বাড়াতে এবারের বাজেটে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, আইসিটি বাজার নিয়ে সরকারের নিজস্ব কোনো তথ্য স্থান পায়নি বাজেটে। এমনকি সফটওয়্যার রফতানি থেকে আর্জিত আয়ের পরিমাণ উল্লেখ করতে গিয়ে উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বেসিসকে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা : হালচিত্র ২০১৪’ আইসিটি বাজেট সহায়ক পুস্তিকায় বাংলাদেশের আইসিটি খাতের বর্তমান অবস্থা শীর্ষক আলোচনায় ‘আইটি শিল্পের বাজারের আকার’ ক্যাটাগরিতে বাদ দেয়া হয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতকে। কিন্তু বাজেট বক্তব্যে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘দেশে টেলিমেডিসিন এবং ইন্টারনেট ডেনসিটি যথাক্রমে ২২.৮ এবং ২৩.৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।’ এছাড়া দেশজুড়ে ৪ হাজার ৫২৬টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ৪০ লাখ মানুষ ই-সেবা পাচ্ছে এমন তথ্য উপস্থাপন করা হলেও এ খাত থেকে আয়ের বিষয়টি থেকে গেছে অন্তরালেই।
বস্ত্তত, ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা রূপকল্প ২০২১-এ সবচেয়ে আলোচিত খাত হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে বিবেচনা করার ফলে সরকার প্রশংসিত হলেও এই খাতের পরিসংখ্যানগত তথ্য পেতে এখনও জনসাধারণের জন্য সহজপ্রাপ্য কোনো উৎস নেই। ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ কার্যক্রম না থাকায় অনেক কাজ হলেও তার ফিডব্যাক থেকে যাচ্ছে দৃশ্যান্তরে। অধিকতর উন্নয়নের পথ থেকে পিছিয়ে আমরা। ঘুরছি একই আবর্তে। তাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবা ও ব্যবসায় খাতকে সমন্বিত করে এই খাতের বাজার সম্পৃক্ত তথ্যাদির জরিপ, গবেষণা এবং প্রতিবেদনের জন্য আলাদা প্রকল্প ও বাজেট বরাদ্দ সময়ের দাবি। আর তা না হলে বাজেটে উদ্ধৃত আশার বাণীগুলোর বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো নিশ্চয়তা দেয়া কঠিন।

বাজেটে আইসিটি খাতের উন্নয়নে অন্য খাতের প্রকল্প
এবারের বাজেটে আইসিটি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৫ সাল। সেই লক্ষে আইসিটির অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের দিকে জোর দেয়ার কথা বাজেটে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। এখানে অঙ্গীকার করা হয়েছে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে টেলিডেনসিটি ৭০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ইন্টারনেটের সংযোগের আওতায় আনা হবে সব উপজেলাকে। একইভাবে ব্রডব্যান্ডের সংযোগ ৩০ শতাংশে উন্নীত করা হবে এবং চালু করা হবে ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাজেটে আইসিটি উন্নয়ন খাতের বরাদ্দের টাকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র দেয়া, ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্যচাষ প্রযুক্তি-সেবা সম্প্রসারণ, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বিসিসি শক্তিশালী করা, ময়মনসিংহ ও গোপালগঞ্জে দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ১০ কিলোওয়াট এফএম বেতার কেন্দ্র স্থাপনের মতো প্রকল্প। উন্নয়ন বাজেটে ৬৩ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ২২৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অপরদিকে রাজস্ব বাজেটের আওতায় ১৬টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭৬৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখানে নতুন প্রকল্প হিসেবে যুক্ত হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং ইনোভেশন ফর স্মার্ট গ্রিন বিল্ডিং প্রকল্প।

বাজেট নিয়ে আইসিটি খাতের ব্যবসায় সংগঠনের বক্তব্য
এ কথা বলতেই হয় ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের বাজেটে কমপিউটার পণ্যের ওপর থেকে আমদানি-শুল্ক প্রত্যাহারের পর থেকেই দেশে কমপিউটারে ব্যবহারের হার বেড়ে গিয়েছিল। ফলে এই খাতের গতি-প্রকৃতি ঠিক করতে জাতীয় বাজেটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মোবাইল ফোন, কমপিউটার, ইন্টারনেটের ব্যবহার আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, তার দিকনির্দেশনা হতে পারে জাতীয় বাজেট। তাই তো দেশের আইসিটি ব্যবসায় খাতের নানা চাওয়া থাকে বাজেটকে ঘিরে। গণমাধ্যমকে ঘটা করে জানিয়ে সেই প্রত্যাশার কথা লিখিতভাবে জমা দেয়া হয় অর্থমন্ত্রীর কাছে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। উপরন্তু এবারই প্রথম বিসিএস, বেসিস ও আইএসপিএবি যৌথভাবে নিজেদের প্রত্যাশার কথা জানায়। কিন্তু সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার পর আবার তাদেরকে ছুটে যেতে হয় অর্থমন্ত্রীর দরবারে। কিন্তু শেষতক শতভাগ প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় বাজেট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে আইসিটি খাতের ব্যবসায় সংগঠনগুলো। কোনো সংগঠনই বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। সবাই গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার না করায় অসন্তুষ্ট। দীর্ঘদিনে শেষ না হওয়া হাইটেক পার্ক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের মতো নতুন করে মহাখালী আইটি পার্ক ও সিলেট হাইটেক পার্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়ে মন্তব্য করেনি কোনো প্রতিষ্ঠানই। শুধু হতাশা ব্যক্ত করেছে। পুনর্ব্যক্ত করেছে বাজেট-পূর্ব নিজেদের প্রত্যাশার কথা।

বিসিএস : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে ছয়টি বিষয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আটটি প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার আহবান জানিয়েছে আইটি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি তথা বিসিএস। বিসিএস কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে দেয়া প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যায়ন বিষয়ে এই দাবি জানানো হয়।
বাজেট মূল্যায়নে ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্কিং যন্ত্রাংশে শুল্ক কমানো, কর অবকাশ সুবিধা ২০১৯ সাল পর্যন্ত করা, কোম্পানির কর হার কমানো এবং ব্যক্তি পর্যায়ে কর হার পুনর্বিন্যাসের জন্য বিসিএস কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বিসিএস সভাপতি এএইচএম মাহফুজুল আরিফ জানান, বাজেট বক্তব্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ‘জ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তি-নির্ভর মাধ্যম’ হিসেবে আইসিটি খাতকে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে এর গুরুত্ব প্রকাশ করাটা ইতিবাচক। কিন্তু বিসিএসের প্রস্তাবিত বাজেটের পুনর্মূল্যায়নে ১৯ ইঞ্চির চেয়ে বড় ২৭ ইঞ্চি পর্যন্ত মনিটরকে শুল্ক সুবিধা দেয়া; ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর গ্রাহক পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার; এইচএস কোড পুনর্বিন্যাস; আইসিটি প্রতিষ্ঠানের বাড়ি ভাড়া মূসকমুক্ত রাখা; সিসি ক্যামেরায় শুল্ক কমানো; ওয়েব ক্যামকে শুল্কমুক্ত রাখা; ভোক্তা পর্যায়ে আইসিটি পণ্যের ওপর এটিভি ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা; হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও নেটওয়ার্কিংয়ে সম্পূরক শুল্ক-অবকাশ সম্প্রসারণে সুদৃষ্টি না দিলে সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়নে তাদের নেয়া উদ্যোগের ভবিষ্যৎ ফলপ্রসূতার বিষয়ে সন্দিগ্ধ দেশের প্রচীনতম এই আইটি সংগঠনটি।
বেসিস : চলতি অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার ইনফরমেশনস অ্যান্ড সার্ভিসেস তথা বেসিস। তবে সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশ করার পর বিসিএসের সাথে অর্থমন্ত্রীকে দেয়া যৌথ প্রস্তাবনায় কমপিউটার মনিটরের আকার ১৯ ইঞ্চি থেকে বাড়িয়ে ২৭ ইঞ্চি পর্যন্ত শুল্কমুক্ত করা, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২২ ইঞ্চি পর্যন্ত ছিল, ইউপিএসে ব্যবহৃত সিলড ব্যাটারিতে ৯৩ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব সংশোধন করে পূর্ববর্তী শুল্কহার ৩৭ শতাংশ বহাল, ইন্টারনেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার, আইসিটি পণ্য আমদানিতে এইচএস কোড পুনর্বিন্যাস করার অনুরোধ জানানো হয়। এ ছাড়া আইসিটি শিল্পকে বাড়ি ভাড়ার মূসক থেকে অব্যাহতি, সিসি ক্যামেরা আমদানিতে শুল্ক কমানো, ওয়েব ক্যাম থেকে ১০ শতাংশ আমদানি-শুল্ক প্রত্যাহার, ভোক্তা পর্যায়ে কর হার কমানো এবং আইসিটি পণ্যের এটিভি ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে আইসিটি খাত-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেসিস সভাপতি শামীম আহসান বলেন, ইন্টারনেটের ওপর ভোক্তা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ই-কমার্সের বাড়ি ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ ট্যাক্স প্রত্যাহার না করা এবং আইটিএস বিকাশে সংশিষ্টদের আয়কর বলবৎ থাকায় আমরা হতাশ হয়েছি।
অ্যামটব : টেলিযোগাযোগ খাতের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে বাজেটে মোবাইল সিমের ওপর নির্ধারিত ৩০০ টাকা ও সিম রিপ্লেসমেন্টের জন্য আরোপিত ১০০ টাকা কর আরোপে ÿুব্ধ অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব)। একই সাথে উচ্চহারে কর্পোরেট করারোপ করার বিষয়টিও ব্যবসায়বান্ধব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন এ সংগঠনের নেতারা।

বাজেট নিয়ে অ্যামটব মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবীর বলেছেন, মোবাইল অপারেটরগুলোর ওপর উচ্চহারে চাপিয়ে দেয়া করের কারণে গ্রাহকসেবা ও তৃণমূল পর্যায়ের গ্রাহকদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। এতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল টেলিযোগাযোগ বাজারগুলোর একটি হওয়ার পরও শিল্পবান্ধব কর-নীতির অভাবে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া পৃথিবীতে সবচেয়ে কম দামে মোবাইল টেলিযোগাযোগের সুযোগ দানকারী এ খাতটির ওপর উচ্চহারে করারোপ অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে। মোবাইল অপারেটরেরা তাদের প্রতি ১০০ টাকা আয়ের ৫৫ টাকাই সরকারকে দেয়। এরপরও আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে আরও বেশি করারোপ করা হয়েছে। এ জন্য আমদানি করা মোবাইল হ্যান্ডসেট এবং স্থানীয় হ্যান্ডসেটের ওপর কর কমিয়ে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

তিনি জানান, বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিগুলোর জন্য কর্পোরেট কর ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন অপারেটরের ওপর ৪০ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত নয় এমন মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ওপর ৪৫ শতাংশ কর্পোরেট ট্যাক্স অপরিবর্তিত রয়েছে। এটি দেশে পুঁজিবাজারের অগ্রগতির জন্য টেলিকম খাতের কোম্পানিগুলোকে প্রত্যাশিত ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংয়ের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবে। ফলে এ খাতে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধারাবাহিক অবদান সত্ত্বেও বাজেটে টেলিকম খাতে কোনো প্রণোদনা নেই। ফলে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের পক্ষে বর্তমান দরে সেবা দেয়া চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এ হারে করারোপ অব্যাহত থাকলে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের পক্ষে সেবার মূল্য বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না। আমদানি করা মোবাইল সেটের ওপর ট্যাক্স না কমালে থ্রিজি নেটওয়ার্ক বিস্তার বাধাগ্রস্ত হবে। করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সরকার এ খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে।

অ্যামটবের মতে, এটা যুক্তিসঙ্গত ট্যাক্স নয়। এ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও এ ব্যবস্থা নেই। যখনই এ ধরনের ট্যাক্স বসানো হবে, তখন সিম বিক্রি কমে যাবে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। এতে সরকার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি মোবাইল অপারেটর এবং গ্রাহকেরা একই ধরনের ভোগামিত্মতে পড়বেন। প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সিম রিপ্লেসমেন্ট হয়ে থাকে। থ্রিজির জন্য মোবাইল অপারেটরেরা ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু বাজেটে যে ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, তাতে থ্রিজি নেটওয়ার্কেও বিস্তার বাধাগ্রস্ত হবে।

আইএসপিএবি : বাজেট নিয়ে এবার আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)

একনজরে প্রস্তাবিত বাজেটে আইসিটি খাত
বাজেটে আইসিটি নামে আলাদা কোনো খাত নেই। আইসিটি খাতের উন্নয়নের নামে যে প্রকল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা থেকে আইসিটি খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা বা প্রামিত্মক পর্যায়ের ভোক্তারা সরাসরি কতটুকু উপকার পাবে তা ভেবে দেখার বিষয়। আইটিইএস খাতে কর অবকাশ সুবিধা ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু তা শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও আইটি সেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনে ব্যবহৃত মাল্টিপ্লেক্সার, গ্র্যান্ডমাস্টার ক্লকের আমদানি-শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব পণ্যের ওপর বর্তমানে ২৫ শতাংশ আমদানি-শুল্ক এবং ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি প্রযোজ্য আছে। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা সবশেষ সংস্করণের আইটি পণ্যগুলোর ওপর শুল্কাদি হ্রাস করা হয়নি। মোবাইল হ্যান্ডসেটের ওপর ১৫ শতাংশ আমদানি-শুল্ক এবং সিমকার্ড প্রতিস্থাপনের ওপর ১০০ টাকা কর আরোপ করা হয়েছে। সিমকার্ডের ওপর ৩০০ টাকা শুল্ক/কর বহাল রাখা হয়েছে। ডিজিটাল ক্লাসরুমে ব্যবহারের মনিটরের সুবিধাপ্রাপ্ত মনিটর ২১ ইঞ্চি থেকে ১৭ ইঞ্চিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবকাঠামোগত টেকসই ও সমান্তরাল উন্নয়নকে অবহেলিত রেখে সফটওয়্যার খাতের উন্নয়ন আশা করা দুরাশার অতীত।

পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৪ - জুলাই সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস