লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
চাই সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রি- নাহলে ডিজিটাল ডিভাইড
ইন্টারনেটভিত্তিক স্লো মোশনের সেবাগুলোই এখনও ঠিকমতো জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে কমপিউটার ব্যবহারে খুব একটা উন্নতি নেই। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের ৯২ শতাংশই শুধু কথা বলে, গান শোনে, গেম ব্যবহার করে। ৭ শতাংশ মাত্র ওয়েব ব্যবহার করে থাকে নিউজ সাইটগুলো দেখার জন্য। ১ শতাংশ মাত্র পেশাগত কাজে লাগায় স্মার্টফোনকে। বাংলাদেশের এই চিত্রটি বলতে গেলে হৃদয়বিদারকই। অথচ প্রতিদিনই প্রায় আইসিটিবিষয়ক সরকারি প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যায়; আইসিটিকে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য কাজে লাগানোর প্রত্যয়ের কথা জানা যায়। ভবিষ্যৎবাচক শব্দ প্রয়োগে বলা হয় নতুন উদ্যোগের কথা। কিন্তু এগুলো সবসময়ই থেকে যায় ভবিষ্যৎবাচকই। কখনও বর্তমান-বাস্তব না হয়ে চলে যায় অতীতের গর্ভে। গত ২৫ বছর ধরে এ ধারাই চলছে। ফলে উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে এ দেশে আইসিটির অবদান খুব সামান্যই। অথচ বিশ্ব মন্দা কাটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন আইসিটিকে অবলম্বন করে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে আইসিটিনির্ভর উদ্যোগ রয়েছে খুবই প্রান্তিক পর্যায়ে।
যদিও এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকা- থেমে নেই, কিন্তু তা কী গতিতে চলছে, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা একটি উদাহরণ ব্যবহার করতে পারি। অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশেও রাজধানীর সাথে বিভিন্ন অঞ্চলকে সংযোগকারী মহাসড়ক রয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে যানবাহন চলে যে গতিতে তা রিকশার চেয়ে বেশি গতিশীল নয়। বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে ইন্টারনেটেরও গতি-ডাটা ট্রান্সফার উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কাজে আইসিটির ব্যবহার ২০ বছর আগের গতিতেই চলছে। সরকারি এবং বাণিজ্যিক মূলধারায় ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে শুধু চিঠি চালাচালির কাজে। তথ্যের স্বর্ণখনি অর্থাৎ উন্নততর ডাটা ব্যবহার করে দ্রুতগতির বাণিজ্যের ধারে কাছেও নেই এ দেশের সরকার বা ব্যবসায়ীরা। অথচ গ্লোবাল আইটি রিপোর্টের রেটিংয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আমাদের কাছাকাছি দেশ সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের সাথে আমাদের দেশের লোকজনের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক রয়েছে। ধনী ব্যক্তিরা বেড়ানো বা চিকিৎসার জন্য হরহামেশাই ছোটেন সিঙ্গাপুরে। আবার একেবারে দরিদ্র-মেহনতী শ্রেণীর লোকজনও কর্মসংস্থানের জন্য বৈধ বা অবৈধ যেকোনো উপায়ে যেতে চান সিঙ্গাপুরে এবং তারা যানও। কিন্তু এত সবের পরও যে সম্পর্কটা সিঙ্গাপুরের সাথে গড়ে ওঠেনি, সেটা হচ্ছে কমার্শিয়াল শেয়ারিংয়ের। কারণ দুটো প্রান্তিকের দেশ হয়ে গেছে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর। ডিজিটাল ডিভাইডের উচ্চতর পর্যায়ে রয়েছে সিঙ্গাপুর আর প্রায় তলানির কাছাকাছি অবস্থাতে রয়েছে বাংলাদেশ। র্যাঙ্কিংটা হচ্ছে সিঙ্গাপুর ২ এবং বাংলাদেশ ১১৯। অবশ্য অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে ফারাকটা বড় মনে হয় না, কারণ সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে আইসিটিতে অবদান ১৬ শতাংশ আর বাংলাদেশের ২ শতাংশের কাছাকাছি। তবে দ্বীপ ও নগরবাসী সিঙ্গাপুরের উৎপাদন খাত, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে আইসিটির অবদান খুবই বেশি। আগে সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীরা বা উদ্যোক্তারা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ধর্না দিতেন কোনো প্রডাক্টের ক্লোন বা রিপ্যাক করার সুযোগ পাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন তারা আর তা করেন না। গত দশ বছরে চিত্রটা পাল্টে গিয়ে এমনই হয়েছে- আইসিটি সেবা ও পণ্যের জন্য এখন পশ্চিমারাই উল্টো সিঙ্গাপুরের দ্বারস্থ হয়। সিঙ্গাপুরের নারী উদ্যোক্তারা আগে স্বকর্মসংস্থানের জন্য হয় বুটিক না হয় রেসেত্মারাঁ খুলে বসতেন। এখন তা আর তারা করেন না। ÿুদ্র ও মাঝারি আইসিটি সেবার উদ্যোগগুলোর বেশিরভাগেরই মালিক এখন নারীরা। অন্যদিকে বাংলাদেশের নারীদের স্বকর্মসংস্থানের একমাত্র উপায় এখনও বুটিক। গ্রাম পর্যায়ে কারুপণ্য উৎপাদন। ডিজিটাল ডিভাইডটা এ ক্ষেত্রে বেশিমাত্রায় চোখে পড়ে বলেই এ উদাহরণ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু দৈনিক সংবাদপত্র কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতার ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও কৃষি ও কারুশিল্পের বাইরে তেমন কিছু নেই। সরকারের দিক থেকে গ্রাম পর্যায়ে আইসিটি সেবা পৌঁছানোর যে উদ্যোগ, তার দৃশ্যমানতা খুব একটা নেই। মোবাইল ফোনে ক্যাশ লেনদেন অথবা রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে এখনও। গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার প্রবাসীদের সাথে কথা বলা এবং সামান্য কিছু তথ্য লেনদেনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে ই-সেবা বা টেলিমেডিসিন খুব একটা কার্যকর নয়, কিংবা উপযোগিতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। এর কারণ হয়তো এই, ডাক্তাররা আইসিটি-ফ্রেন্ডলি হয়ে উঠেছেন কি না এবং অপর পক্ষে সেবা গ্রহীতারও তথ্য দিতে সক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে দেখা যায় ভাসা ভাসা কিছু পরামর্শ দিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানোর পরামর্শই দেয়া হয়।
তৃণমূল পর্যায়ের বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে দারিদ্র্য আছে, শিক্ষা নেই। শিক্ষার বিনামূল্যকরণ যেখানে শিক্ষা দিচ্ছে, তাতে আইসিটি-ফ্রেন্ডলি প্রজন্ম গড়ে ওঠার বদলে গড়ে উঠছে শুধু টাকা গুনতে সক্ষম একদল মানুষ। মোবাইল ফোনের এসএমএস পড়ার সক্ষমতাও তাদের তৈরি হয়নি, নিজে করতে পারা তো দূরের কথা। আইসিটির তৃণমূল পর্যায়ের বিস্তার বহুলাংশেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানহীন শিক্ষার কারণে। আর আইসিটিনির্ভর প্রজন্ম গড়ে উঠতে না পারায় আধুনিক মূল্যবোধ উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভবপর হচ্ছে না। এই প্রজন্মের ভেতর থেকে নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে যে কয়জন আইসিটি লিটারেট ও জিনিয়াস পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরকেও দেশে ধরে রাখা যাচ্ছে না, কারণ তাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।
বর্তমান বিশ্বের প্রধান বাণিজ্যিক উদ্যোগ বলে বিবেচিত হচ্ছে সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রি। অর্থাৎ প্রচলিত শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগকে উৎপাদনশীলতা ও গতি দেয়ার জন্য এই সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রির অবদান অপরিসীম হয়ে উঠেছে। হার্ডওয়্যার থেকে নিয়ে সলিউশন- ট্রাবলশুটিং ও যোগাযোগের সেবা, সর্বোপরি ডাটার ব্যবহার নিশ্চিত করছে এখন সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলোই। বিগ ডাটার ব্যবহার করে নানা ধরনের ক্যারিশমা দেখাচ্ছে সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলো। অর্থাৎ সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রির কল্যাণে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের চাহিদা যেমন জানতে পারছে, তেমনি নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনকে বিভিন্ন প্রডাক্টের উপযোগী করতেও সহায়তা করছে। এ ছাড়া তারা পণ্য বিপণনের বিভিন্ন নতুন কৌশল প্রয়োগ করতে পারছে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ বছর পঁচিশেক আগেই এখানে কিছু উদ্যোক্তা এসেছিলেন এবং বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস ও ট্রাবলশুটিংয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই উদ্যোগগুলো মূলধারার বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহের কারণে ভেসেত্ম যায়। অনেকে ব্যবসায় ছেড়ে দেন। আবার কেউ কেউ আইসিটি প্রডাক্টের ট্রেডিং শুরু করেন।
এখন অস্বীকার করা যাবে না যে পরিস্থিতি পাল্টেছে। দশ বছর ধরে চলা বৈশ্বিক মন্দা থেকে বেরিয়ে এসেই আইসিটি এতটা মহা-আলোড়ন তুলেছে। অনেক টেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আইসিটিই মন্দা থেকে তাদের বের করে এনেছে। যার কারণ হলো, মন্দার মধ্যেও আক্রান্ত উন্নত দেশগুলো আইসিটির গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকা- এবং তথ্যভা-ার সমৃদ্ধকরণের কাজগুলো অব্যাহত রেখেছিল।
পক্ষান্তরে আমাদের রাষ্ট্রপরিচালকেরা সন্তুষ্ট ছিলেন এই ভেবে, মন্দার সেরকম প্রকোপ আমাদের গায়ে লাগেনি। কৃষিনির্ভরতা এবং মন্থরগতির উন্নয়ন ধারাবাহিকতা রÿÿত হওয়াতেই তারা সন্তুষ্ট ছিলেন। এখনও সে সন্তুষ্টির ধারাবাহিকতা যেহেতু তারা রক্ষা করে চলেছেন, সেহেতু নতুন কনসেপ্টগুলো তারা বুঝতে পারছেন না। আইসিটিকে ইন্ডাস্ট্রি লেভেলে নিয়ে যাওয়ার এবং উচ্চতর পর্যায়ে আধুনিক প্রয়োগ পদ্ধতিতে ডাটার ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি কাজে লাগিয়ে শিল্প ও বাণিজ্যের গতিশীলতা আনা উৎপাদন বৈচিত্র্যময় করে তুলে ভোক্তা চাহিদা বাড়ানো, কর্মসংস্থান বাড়ানো ইত্যাদি বিষয় এ দেশে এখন পর্যন্ত প্রান্তিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। সমাজের অল্পসংখ্যক মানুষ বুঝতে পারছেন, কিন্তু তার নীতিনির্ধারকেরা বোঝাতে পারছেন না।
ডিজিটাল ডিভাইডের প্রকোপে পড়ে গেলে বৈশ্বিক অর্থনীতির আসন্ন ভালো সময়েও যে আমাদের ঝুঁকতে হবে সেই উপলব্ধিটা হওয়া খুবই প্রয়োজন। সন্তুষ্টি ডেকে আনতে পারে সর্বনাশ! এটা পরিষ্কার, আইসিটির উন্নত ধারণাগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন উদ্যোগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটা থাকা এখন খুবই জরুরি ছিল। এটি থাকলে সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রির জন্য এখন হা-হুতাশ করতে হতো না। এখনও বোধহয় সময় আছে আগামী তিন বছরের একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়ে সরকার যদি মাঠে নামে, তাহলে দেশে থাকা আইসিটি অভিজ্ঞ লোকজনকে দিয়েই হিলারিয়াস কিছু করা সম্ভব হবে। সরকারে এটুআই প্রোগ্রামটিকে আধুনিক করে উন্নয়ন-গবেষণা এবং হাই এন্ডে কাজ করতে সক্ষম করে তোলা হলে বেশ কিছু সাফল্য আসতে পারে
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com