• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > আমরা থামলেও প্রযুক্তি থামেনি
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: আবীর হাসান
মোট লেখা:১৫০
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১১ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
প্রযুক্তি ভাবনা
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি বিপ্লব
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
আমরা থামলেও প্রযুক্তি থামেনি
বাংলাদেশের মানুষ এখন অপেক্ষায় আছে- হয় অভূতপূর্ব উন্নত কিছু দেখার কিংবা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার। একটু যাদের চেতনা শানিত, তা সে গ্রাম বা শহরের হোক অথবা বিশ্বের যুবা কিংবা বয়সী হোক- সবাই এরকম একটা দোলাচলের মধ্যে রয়েছে। মাঝে মাঝেই এরা শুনতে পাচ্ছে হাঁক-ডাক অর্থাৎ দেশের দায়িত্বশীলদের বক্তৃতা-বিবৃতি। স্বভাবতই এসবের মধ্যে থাকে আশা-জাগানিয়া অনেক কথাবার্তা, বলা হয় আগে যা কখনও হয়নি তা এখন বা অবিলম্বে হবে। দেশের মানুষ উন্নত বিশ্বের মতো সুবিধা ভোগ করবে। অন্তত চলাচল, বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা এই ক্ষেত্রগুলোতে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটবে এমন আশা সবারই। যারা বলেন এবং যারা শোনেন, সবাই আশাও যেমন করেন, সম্ভবত একই সঙ্গে বিশ্বাসও করেন যে, এসব বিষয়ে উন্নতি না হলে চলবেই না। কিন্তু এগুলোর পেছনে যা লাগে সেই পরিকল্পনা, অর্থায়ন আর বাস্তবায়ন এগুলো যারা করেন, তারা থাকেন চাপের মধ্যে। কারণ প্রয়োজনীয়তার সাথে সাথে পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় প্রাক্কলন করতে হয় সঙ্কুলানের বিষয়গুলোকে। আর অর্থায়ন যারা করেন তারা স্বভাবতই দেখেন বিনিয়োগ বা সেবার জন্য বরাদ্দ দিলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপযোগিতা কতটা সৃষ্টি হবে এবং ফেরত আসবে কতটুকু। সম্ভাব্য বাস্তবায়নের দায় যাদের, তারা কিন্তু জানেন না। কী করবেন বা তাদের সামনে বাস্তবায়নযোগ্য কী ধরনের বিষয় আসতে পারে। এদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক পদাধিকারী বা জনপ্রতিনিধি তারা চান এমন কিছু করতে যা জনসাধারণ এবং বিরোধীরা চর্মচক্ষে দেখতে পান এবং তাদের চোখও ধাঁধিয়ে যায়। কেউ কেউ উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়ে ভাসিয়ে দিতে চান সব আলোচনা-সমালোচনাকে। কাজেই বড়সড়, উজ্জ্বল, চলিষ্ণু, বহুমূল্য জিনিসই তাদের কাছে কদর পায় অগ্রাধিকারভিত্তিতে।

এজন্যই সম্ভবত ঢাকা মহানগরীতে রাসত্মায় ফ্লাইওভার তৈরি হওয়ার আগেই বিদেশী পুরনো গাড়ি এসে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেয়। এজন্যই সম্ভবত প্রাকৃতির গ্যাসের সঙ্কট থাকলেও এবং মজুদ খুব বেশি না থাকলেও অবাধে গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার করতে দেয়া হয়। জলপথ ব্যবহার বেশি সম্ভাবনাময় হলেও স্থলপথ নির্মাণ এবং বৃহৎ সেতুর মতো ব্যয়বহুল উদ্যোগ নিতে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়।

এই যে চাক্ষুস দেখানোর বিষয় অথবা খোলাসা করে বললে লোক দেখানোর প্রবণতা, এজন্যই সম্ভবত আইসিটির মতো প্রযুক্তি রাজনৈতিক বিবেচনায় হালে পানি পায় না। কারণ আইসিটির অনেক কিছুই আছে যা ক্ষুদ্র বা সূক্ষ্ম এবং আপাতদৃষ্টে দৃশ্যমান নয়। সাইবার স্পেস বা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের বর্ণাঢ্য আধুনিকতা এসব রাজনৈতিক ব্যক্তির চোখে পড়ে না। বছর পাঁচেক আগেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের আইসিটির ক্ষেত্রে ‘ব্যাক বেঞ্চার’ বলা হতো। সে সময় তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল ইইউর পক্ষ থেকে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদদের জন্য আইসিটির দুর্বলতা কেবল আমাদের দেশেরই সমস্যা নয়। অন্যান্য দেশেও এরকম ব্যবহার ঘটেছে, এখনও ঘটছে। তবে সেসব থেকে উত্তরণের পথও দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারত সম্ভবত একটু বেশি এগিয়ে, কারণ সেখানকার কিছু রাজনীতিবিদ হয়তো আইসিটি বিষয়টি একটু বেশিই বোঝেন। আর এই বেশি বোঝার কারণে আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনে করেন অবুঝ, আর সেজন্যই আইসিটি নিয়েও দুর্নীতি করেন। তবে দুর্নীতি করতে গিয়ে পার পান না বেশিরভাগ সময়। সাম্প্রতিক টু-জি কেলেঙ্কারি তার প্রমাণ। আসলে টেলিকম যখন থেকে আইসিটির সাথে সমতাভিত্তিক প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে তখন থেকেই বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ ও আমলারা এর থেকে দুর্নীতি করার উপায় খুঁজে আসছেন এবং করেও আসছেন। আগে থেকেই যেসব দেশের টেলিকম বিভাগে দুর্নীতি ছিল তাদের দুর্নীতিটা আইসিটির ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়েছে। ভারত হয়ত এর বড় প্রমাণ। তবে আমরাও কম যাই না। আইসিটির ভিওআইপি টেলিকম খাতের গ্যাঁড়াকলে পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর। তবে আমাদের মূল প্রসত্মাবনা এই বিষয়টি নয় অর্থাৎ দুর্নীতি নয়, মূল বিষয়টি হচ্ছে আগ্রহ। এদেশের রাজনীতিবিদ ও আমলাতন্ত্রের লোকজন আইসিটি বিষয়ে ততটাই আগ্রহী হন যতটায় তারা ফাইল ঠেকানোর কাজ করতে পারেন। বাকি যে বিষয়গুলো, সেগুলো কী করে হবে বা হবে না, তাতে তাদের মাথাব্যথা নেই। এই আগ্রহ না থাকার কারণেই অনেক প্রয়োজনীয় কাজ হবে হবে করেও হয় না।

অনেকেই আজকাল মনে করছেন বহির্বিশ্বে আইসিটিবিষয়ক প্রযুক্তির উন্নয়ন থমকে আছে আর সে কারণেই আমরা এক্ষেত্রে তেমন উন্নতি করতে পারছি না। আসলে এটা নিছই অপপ্রচার। কারণ, বিশ্বজুড়েই এখন আইসিটি উন্নয়নে গণিতবিদ, কমপিউটার বিশেষজ্ঞ এবং টেলিকম এক্সপার্টরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। আইসিটির সাথে টেলিকমের গাঁটছড়া বাঁধার কারণে বরং বিস্তৃত হয়েছে এই গবেষণা ও উন্নয়নবিষয়ক কার্যক্রম। একদিকে আইসিটির কমিউনিকেশন ব্যাকবোনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল এখন টেলিকম। একে ছেড়ে আসতে হচ্ছে পুরনো ক্যাবল, স্যাটেলাইট আর মাইক্রোওয়েভের জটিল জগৎ। আবার আইসিটিকে যেন গ্রাস করতে আসছে মোবাইল ফোনের প্রযুক্তি। কোনো দিকেই এখন পর্যন্ত স্থিতিশীলতা আসেনি। উন্নয়নের জন্য গবেষণা চলছে, কিছু কিছু প্রযুক্তি বাণিজ্যিক পরিমন্ডলেও দেখা যাচ্ছে। কমপিউটারের প্রসেসর-মাদারবোর্ড থেকে শুরু করে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সার্ভিস উন্নততর সুবিধা তৈরি করছে।

গত কয়েক বছরে আমরা দেখতে পেরেছি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক চুক্তি ও অর্থ লেনদেনের একাধিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। ই-গভর্নেন্স এবং শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন প্রযুক্তিও ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। একই সাথে নতুন ও উন্নত সফটওয়্যারের ব্যবহারও হচ্ছে ব্যাপক হারেই। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে খবর কিছুটা হয়ত আমরা পাচ্ছি কিন্তু প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার দেখার সুযোগ পাচ্ছি না বা ব্যবহার করে শিক্ষা-বাণিজ্যে গতিশীলতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

এক্ষেত্রে সরকারি দায়িত্বশীল বা হয়ত বলতে পারেন বেসরকারি খাতে এখন বড় বড় বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে- যারা নিজস্ব উদ্যোগে এসব ব্যবহার করলেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে একটা সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশে ইচ্ছে করলেই সবকিছু ব্যবহার করা যায় না। এর প্রমাণ তো ভিওআইপি। এছাড়া অনলাইন বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থ লেনদেনের বিষয়গুলোও কিন্তু আটকে আছে সরকারি সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই। এখন একটা বড় শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মূল্যবান অটোমেশন সফটওয়্যার একলা ব্যবহার করলে বিদেশের সাথে হয়ত দ্রুত যোগাযোগের সুযোগ পাবে, কিন্তু লেনদেনের সুযোগ পাবে না। আবার দেশের অভ্যন্তরেও অন্য ক্লায়েন্ট সরকার বা বিপণন পরিমন্ডলে অটোমেশন না থাকার অসুবিধার মধ্যে পড়বে।

কাজেই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না বহির্বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটলেও সেগুলো ব্যবহারের উপযুক্ত অবকাঠামো আমরা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেইনি। সরকারি অনেক কর্তাব্যক্তি মনে করেন সাবমেরিন ক্যাবলের একটি সংযোগই যথেষ্ট। এছাড়া এর গতি এবং ঝুঁকির বিষয়টি বোঝার ক্ষমতাও অনেকের নেই। সফটওয়্যারবিষয়ক সচেতনতা অথবা হালনাগাদ তথ্যও অনেকের কাছে নেই। তারা বোঝেন না গতিশীল ইন্টারনেট এবং উন্নত আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করা না গেলে শিল্প-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে গতিশীলতা আসবে না, চোখে পড়ার মতো উন্নতিও দেখা যাবে না।

সত্যিই এদেশের নতুন প্রজন্ম এখন অপেক্ষায় আছে সাইবার স্পেসে অভূতপূর্ব কিছু ঘটার। অনেকে ইশতেহার-বিবৃতি-বক্তৃতা তারা শুনেছে, এখনও শুনছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না অর্থকরী যে ডিজিটাল কর্মকান্ড- তা কিভাবে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কমপিউটার ব্যবহার বা হ্যান্ডহেল্ড টার্মিনালে ইন্টারনেট ব্যবহার এখন পর্যন্ত শখের পর্যায়েই আছে অর্থ আসার বদলে বেশি ব্যয় হচ্ছে বলে তা তেমন জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে না।

সাম্প্রতিককালে আমরা আশপাশের দেশগুলোতে দেখতে পাচ্ছি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যখন ছড়িয়ে দেয়া হয় তখন তার অর্থকরী দিকগুলোকে সঠিকভাবে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা হয় এবং সরকারি পর্যায়ে সেগুলো ব্যবহার করে উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়। উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখন সফটওয়্যারের চাহিদা বেসরকারি পর্যায়ের চেয়ে সরকারের দিক থেকেই বেশি। কারণ এসব দেশে শিল্প বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, কর ও শুল্ক আদায়, বিনিয়োগ ব্যাংকিং, রাজস্ব আদায় সবই চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে আইসিটির মাধ্যমে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা একটু লক্ষ করলেই দেশের ভেতরের একটি বিষয় থেকেই এর সম্যক ধারণা রাখেন। একই সাথে চলছে পাঁচটি বিদেশী মালিকানার টেলিকম কোম্পানি আর সরকারের একটি। নানারকম প্রযুক্তিগত সুবিধা দিতে পারায় বিদেশী টেলিকম কোম্পানিগুলো কোটি কোটি গ্রাহকের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যেতে পারছে। পক্ষান্তরে প্রযুক্তিগত সুবিধা দিতে না পারায় দেশীয় টেলিকম কোম্পানিটি বলতে গেলে ধুঁকছে। অথচ প্রথম চালু হওয়ার সময় এই কোম্পানিটির প্রতি মানুষ আস্থা রেখেছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সময়মতো প্রযুক্তিগত সুবিধা দিতে না পারায় শুধু অর্থ ছাড় দিয়ে ব্যবসায় সফল হতে পারছে না কোম্পানিটি।

কেউ যদি মনে করেন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার মানুষ করতে পারবে না, তাহলে তিনি ভুল করবেন। কারণ এখন পর্যন্ত আইসিটি ও টেলিকমভিত্তিক কোনো সুবিধাই মানুষ ব্যবহার না করে থাকেনি। একটি বিষয় এদেশে আইসিটির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে আছে- সেটি হলো ভীতি এবং এর সত্যিকার অর্থকরী সুবিধাগুলো জনসাধারণের সামনে তুলে না ধরা থেকেই জন্ম হয়েছে এ ভীতির। মোবাইল ফোনে আইসিটির আংশিক ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ভীতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্ম, কিন্তু তাদের সামনে আরও আধুনিক শিল্প-বাণিজ্যবান্ধব প্রযুক্তিগুলো ঠিকমতো আসছে না। শিক্ষাক্ষেত্রে বিষয়গুলোকে নিয়ে আসতে হবে। আর এজন্য অবশ্যই কিছু অর্থ ব্যয় করতে হবে সরকারকে। উচ্চতর পর্যায়ে কিছু উন্নয়ন ও গবেষণার সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে।

জানা গেছে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা। এই পরিকল্পনায় আইসিটির অর্থকরী বিষয়গুলো সন্নিবেশিত হলেই কিন্তু পাওয়া যাবে অভূতপূর্ব উন্নত কিছু। অন্যথায় দৃশ্যমান উন্নতি হয়ত কিছু হবে, কিন্তু তা টেকসই হবে কি না অথবা জাতির উন্নয়নে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, তাতে সন্দেহ আছে যথেষ্টই।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : abir59@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস