লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
দুই যুগের কমপিউটার জগৎ ও বাংলা কমপিউটিং আন্দোলন
চলতি সংখ্যাটি আমাদের ২৪তম বর্ষের দ্বাদশ সংখ্যা। অন্য কথায় কমপিউটার জগৎ-এর ২৪তম বর্ষপূর্তি সংখ্যা। যেহেতু এই ২৪টি বছরে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হলেও কমপিউটার জগৎ প্রকাশনায় কোনো ছেদ ছাড়াই এর প্রতিটি সংখ্যা নিয়মিত প্রকাশ করে আমরা আমাদের সম্মানিত পাঠকদের হাতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি, অতএব সহজেই জানিয়ে দেয়া যায়, চলতি সংখ্যাটিসহ এ পর্যন্ত কমপিউটার জগৎ-এর সর্বমোট ২৪ গুণন ১২ তথা ২৮৮টি সংখ্যা এরই মধ্যে আমাদের পাঠকদের হাতে পৌঁছে গেছে। আমাদের মতো ছোট অর্থনীতির ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা একটি দেশে কমপিউটার প্রযুক্তির মতো কাটখোট্টা বিষয়ের একটি বাংলা মাসিকের এত দীর্ঘ সময় শুধু কমপিউটার জগৎ পরিবারের একক প্রয়াসে এর নিয়মিত প্রকাশনা অব্যাহত রাখা নিশ্চয় কঠিন এক কাজ ছিল। কঠিন বলেই আমাদের দেশের বেশ কিছু কমপিউটার ম্যাগাজিনকে তাদের প্রকাশনা অকালে বন্ধ করে বিদায় নিতে দেখেছি। বিষয়টি দেশ-জাতির জন্য দুঃখজনকই বলতে হবে। সেদিক থেকে আমরা নিজেদেরকে সৌভাগ্যের অধিকারীই ভাবছি। আমাদের সম্মানিত পাঠক, গ্রাহক, উপদেষ্টা, পরামর্শক, এজেন্ট, বিজ্ঞাপনদাতা, পৃষ্ঠপোষক, শুভানুধ্যায়ীদের আন্তরিক ও সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া আমাদের পক্ষে এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না বলেই আমাদের বিশ্বাস। তাই শুরুতেই তাদের সবার প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। সেই সাথে প্রত্যাশা রইল, আগামী দিনেও তাদের কাছ থেকে অধিকতর সক্রিয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার। এটুকু বলেই ফিরে যেতে চাই এ লেখার মুখ্য বিষয়ের আলোকপাতে।
আপনারা জানেন, এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি জগতের অতি সুপরিচিত হয়ে ওঠা ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ নামের দাবিমুখী সেস্নাগানটি নিয়ে ১৯৯১ সালের মে মাসে মাসিক কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার যে অভিযাত্রাটি আমরা শুরু করি, তা আসলে ছিল এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নেয়ারই আন্দোলনের সূচনা। তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, একটি পত্রিকাই হতে পারে আন্দোলনের এক মোক্ষম হাতিয়ার। মাসিক কমপিউটার জগৎ-কে কেন্দ্র করে সে উপলব্ধিকে অন্তরে ধারণ করেই এ আন্দোলন-অভিযাত্রার এ দেশে সূচনা করেছিলেন এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক ও কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা-প্রাণপুরুষ অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদের। আসলে তিনি ছিলেন এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের নেপথ্যচারী ও প্রচারবিমুখ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তার নীতি-আদর্শ পোষণ করেই মাসিক কমপিউটার জগৎ আজও এই অভিযাত্রা জারি রেখেছে।
কমপিউটার জগৎ-এর পাঠকমাত্রই জানেন, আমাদের সূচনা সংখ্যাটির প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনামটি ছিল : ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’। কিন্তু এ দেশের প্রতিটি মানুষের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা যেহেতু বাংলা, সেহেতু আমাদের ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ সেস্নাগানকে সত্যিকার অর্থে সফল করে তুলতে চাইলে বাংলা কমপিউটিংয়ের উন্নয়ন ছাড়া তা সম্ভব নয়- এ উপলব্ধি আমাদের মাঝে ছিল একদম শুরু থেকেই। তাই তখন থেকে আমরা একটি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- জনগণের হাতে কমপিউটার পৌঁছানোর আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলা কমপিউটিংয়ের আন্দোলনকেও সমান্তরালভাবে আমাদেরকে এগিয়ে নিতে হবে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করেই মূলত আমাদেরকে চালিয়ে যেতে হবে বাংলা কমপিউটিংয়ের মূল আন্দোলন। এর বাইরেও সময়ের প্রয়োজনে অন্য সব মাসেও আমাদের কথা বলতে হবে বাংলা কমপিউটিংয়ের পক্ষে, যাতে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগের অবস্থানকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করানো যায়। যারা কমপিউটার জগৎ-এর নিয়মিত পাঠক, তারা নিশ্চয় লক্ষ করে থাকবেন আমাদের বাংলা কমপিউটিংও প্রধানত ছিল ভাষার মাস একুশে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। আসলে বাংলা কমপিউটিং আন্দোলনের প্রায়োগিক অর্থ কমপিউটারে বাংলাভাষার ব্যবহার যথাসম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার পথকে সুগম করা। সে উপলব্ধিকে সামনে রেখেই আমরা কমপিউটার জগৎকেন্দ্রিক বাংলা কমপিউটিং আন্দোলন অব্যাহত রাখি। আজও আমাদের সে প্রয়াস অব্যাহত আছে। ইনশালস্নাহ আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে- এমনটিই আমাদের প্রতিশ্রম্নতি।
কমপিউটারে বাংলার আদর্শ মান
আপনারা জানেন, ১৯৯১ সালের ১ মে কমপিউটার জগৎ প্রকাশনা শুরু হওয়ার পর আমরা প্রথম যে একুশে ফেব্রুয়ারিটি উদযাপনের সুযোগ পাই, সেটি ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এই ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা কার্যত কমপিউটারে বাংলাভাষার ব্যবহারের ওপর দাবিধর্মী শিরোনাম দিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ দেশে বাংলা কমপিউটিংয়ের আন্দোলনের কাজটি শুরু করি। এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনামটি ছিল- ‘কমপিউটারে বাংলা ব্যবহার : সর্বস্তরে আদর্শ মান চাই’। একই সাথে এ সংখ্যাটিতে আমরা একই বিষয়ের ওপর একটি সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করি, যার শিরোনাম ছিল এমন : ‘৯২-র একুশের দিনে জাতীয় জীবনে কমপিউটার প্রতিষ্ঠার শপথ নিন’।
উল্লিখিত প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শুরুতেই তখন আমরা উল্লেখ করেছিলাম- ‘কমপিউটারের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রসার লাভ করেছে। তাই বর্তমান যুগ কমপিউটার-যুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশকেও প্রযুক্তির এই প্রবাহে অংশ নিতে হবে। ... জাতীয় উন্নয়নে বিজ্ঞানের এই নতুন আবিষ্কারের অবদানকে ত্বরান্বিত করার জন্য কমপিউটারের সাথে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার অপরিহার্য। বাংলা ব্যবহারের মাধ্যমে কমপিউটারকে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব। সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টাতে এর অবদান হবে যুগান্তকারী। ইংরেজিতে নির্ভুল, সহজ ও তাড়াতাড়ি লেখার যান্ত্রিক যে সুবিধাদি বিদ্যমান, বাংলাভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহার এবং সবার কাছে গ্রহণীয় করার জন্য বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সেসব সুবিধা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে।’
একই প্রতিবেদনে আমরা আরও উল্লেখ করেছিলাম- ‘গত কয়েক বছর ধরে কমপিউটারে বাংলা ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে প্রচুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে- এটি আমাদের জন্য আশার বাণী। এ প্রেক্ষেতে আমাদের মাঝে কিছু ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে বলে কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষ আলোচনা প্রয়োজন। কমপিউটারে বাংলা ব্যবহারকে শুধু বাংলা ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ের গ--র মধ্যে সীমিত রাখা আমাদের উচিত হবে না। কমপিউটারে বাংলা ব্যবহার বলতে আমাদের কমপিউটারে রিয়েল টাইম ব্যবহার, কমপিউটার যোগাযোগ, বাংলা অক্ষর শনাক্তকরণ ও কমপিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদিতেও বাংলা ব্যবহারের প্রয়োজনগুলো বুঝতে হবে। এসব ব্যবহারের চিন্তা যদি এই সময়ে আমাদের বিবেচনা থেকে বাদ রাখি, তবে কমপিউটারের সত্যিকারের প্রয়োগ থেকে আমরা বঞ্চিত হব এবং পরবর্তী সময়ে প্রচুর সমস্যার বেড়াজালে আমাদেরকে আবদ্ধ হতে হবে।’
এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের মাধ্যমে তখন আমরা জাতিকে জানিয়ে দিই- কমপিউটারে বাংলা ব্যবহারের জন্য চাই প্রয়োজনীয় বাংলা কীবোর্ড, বাংলা কীবোর্ডের মান নির্ধারণ এবং বাংলা কীবোর্ডের সম্ভাব্য সমাধান। এ ছাড়া প্রয়োজন কমপিউটারে বাংলা ব্যবহারে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান।
কমপিউটার জগৎ-এর এই সংখ্যাটিতে আমাদের সম্পাদকীয় বক্তব্য ছিল : ‘বায়ান্নর অঙ্গীকার ছিল মাতৃভাষার ও স্বাধীনতার। কমপিউটার শুধু মাতৃভাষাকেই ধারণ করেনি, আভিজাত্যের ও গজদন্ত মিনার ছেড়ে কমপিউটার মানুষের দ্বারপ্রামেত্ম হাজির হয়েছে। দুর্জয় স্বাধীন অসিত্মত্বে জাতীয় ভবিষ্যৎ নির্মাণে কমপিউটার বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের হাতিয়ার হতে চলেছে। স্বাধীনতার স্বপ্নকে সবচেয়ে সৃষ্টিশীলভাবে ধারণ করেছে কমপিউটার। কিন্তু এ সরকারের কিছু সংস্থা ও স্বার্থান্ধ কিছু ব্যক্তির কারণে এ রাষ্ট্রভাষা জ্ঞান ও মুক্তির বাহন হিসেবে কমপিউটারকে ধারণ করতে পারছে না। সব আকাঙক্ষা ও সৃষ্টিশীলতাকে নস্যাৎ করে রাষ্ট্রকে বন্ধ্যা করে রাখার চক্রামেত্মর সামনে গুমরে উঠছে বুয়েটের তরুণ, প্রবাসী বিজ্ঞানীসহ অসংখ্য মানুষ। তাদের অদৃশ্য মিছিল চলছে বায়ান্নর একুশকে ঘিরে। প্ল্যাকার্ড-ব্যানারের মতো স্বপ্নের কমপিউটার বয়ে উজ্জ্বল সাহসী নবীনেরা এগিয়ে যাচ্ছে পায়ে পায়ে। সামনে ক্রুর ক্রুর রাবণের সীমানা। এরপরই মুক্তির প্রান্তর। মিছিল চলছে। আঘাতের পর আঘাত আসছে। আহত তরুণেরা কাঁদছে। কান্না ও মাতমের মধ্যে যখন এ মিছিল দুর্নিবার, তখন একুশের মিছিল শুরু হয়েছে। কবিতার চেয়ে নান্দনিক, মারণাস্ত্রের চেয়ে অভ্রান্ত, স্বর্ণখণির মতো ঐশ্চর্যময় কমপিউটারকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার মিছিল চলছে, বিরানববইয়ের একুশ ঘিরে।’
যারা কমপিউটার জগৎ-এর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যার উল্লিখিত প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়টি আগাগোড়া পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে বাংলা কমপিউটিং আন্দোলনকে, আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় কমপিউটারে বাংলাভাষা প্রয়োগের আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ায় কমপিউটার জগৎ-এর ভূমিকা কতটুকু জোরালো ছিল এবং এ আন্দোলনকে আমরা কোন লক্ষে্যর দিকে ধাবিত করায় প্রয়াসী ছিলাম। আর আমাদের এই চবিবশ বছরের কমপিউটার জগতের পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে সে ক্ষেত্রে আমাদের ধারাবাহিকতা কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছিলাম।
বাংলা একাডেমির হাতে বিপন্ন বাংলা
বাংলা কমপিউটিংকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থের প্রতি আমরা ছিলাম বরাবর আপোসহীন। এজন্য যেখানে যেটুকু উচ্চারণের সাহস দেখানো প্রয়োজন ছিল, সে সাহস আমরা দেখাতে কুণ্ঠাবোধ করিনি। সে কারণে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে যথাসময়ে যথাতাগিদটুকু আমরা দিয়েছি। এর সাক্ষ্যবহ একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করতে চাই। যে বাংলা একাডেমির একমাত্র কাজ বাংলার সার্বিক উন্নয়ন, ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এসে আমরা দেখলাম সেই বাংলা একাডেমির হাতে বাংলা কমপিউটিং বিপন্ন হতে বসেছে। তাই আমরা কমপিউটার জগৎ, জানুয়ারি ১৯৯৩ সংখ্যায় কার্যত এর প্রতিবাদ জানাই ‘বাংলা একাডেমির হাতে বিপন্ন বাংলা’ শীর্ষক প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তখন আমরা লক্ষ করি- দেশে কমপিউটারে বাংলা কীবোর্ড প্রণয়নের জন্য বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে প্রকৌশল বিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি ছয় বছর ধরে কাজ করার পর হঠাৎ করে বাংলা একাডেমি সাইটেক নামে একটি বিপণন প্রতিষ্ঠানের কীবোর্ড বিন্যাসকে গ্রহণ করেছে। এতে দেশের কমপিউটারবিদ ও ব্যবহারকারী মহলে নানা ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। তখন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক বলেন- ছয় বছর ধরে এ কমিটি কোনো কীবোর্ড প্রস্তাব করতে না পারায় একাডেমি তাদের জন্য আর অপেক্ষা করেনি। কিন্তু কমিটিভুক্ত বিশেষজ্ঞ, ব্যবহারকারী ও উদ্ভাবকেরা বলেন- কীবোর্ড প্রশ্নে এরা যখন প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেন, ঠিক তখনই এই কমিটিকে কোনো সুযোগ না দিয়ে বাংলা একাডেমি-সাইটেক হঠাৎ করে একটি ফন্ট ও কীবোর্ড হাজির করে। তখন সাইটেক বিতর্কে না গিয়ে এরই মধ্যে বলে দেয়, ঐকমত্যের অভাব দেখা দিলে এরা এদের প্রস্তাবিত ও বাংলা একাডেমির গৃহীত কীবোর্ড নিয়ে আর সম্প্রসারণে যাবে না।
ছয় বছরে উল্লিখিত কমিটি একটি বাংলা কীবোর্ড জাতিকে উপহার দিতে পারল না, এর জন্য দায়ী কে? প্রচ্ছদ প্রতিবেদন তৈরির প্রয়োজনে এ ব্যাপারটি অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে আমরা জানতে পারি নাটকীয় সব অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ। এতে প্রতীয়মান হয়, বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক একটি বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐকমত্য গড়তে গিয়ে আমাদের অগ্রসর শ্রেণীর জ্ঞানীগুণীরা দারুণভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক অহংবোধ, পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ও ক্ষোভজনিত উদাসীনতায় ভুগছেন। এতে বিঘ্নিত হয় জাতীয় স্বার্থ। বাংলা কমপিউটিংকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অপরিহার্য বাংলা কীবোর্ডের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আমরা লক্ষ করি, এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির ব্যর্থতা সীমাহীন। তাই এ বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আমরা তৈরি করি খুবই তথ্যসমৃদ্ধ এই প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদন বাংলা একাডেমির কোনো কোনো মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে জেনেও সত্য উচ্চারণে আমরা পিছপা হইনি। কারণ, বাংলা কমপিউটিংকে এগিয়ে নেয়ায় আমরা বরাবর প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ ছিলাম, আছি এবং থাকব। এ ছাড়া আমরা গর্বিত এই ভেবে যে, সেদিন আমরা উচ্চারণ করতে পেরেছিলাম একটি নিদারুণ সত্য : ‘বাংলা একাডেমির হাতে বিপন্ন বাংলা’।
প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে বাংলা কমপিউটিং
কমপিউটার জগৎ-এর নিয়মিত পাঠকমাত্রই জানেন, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির সার্বিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছি আমাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনগুলো ও সম্পাদকীয়গুলোকে। বাংলা কমপিউটিং আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। বাংলা কমপিউটিংয়ের পক্ষে এই ২৪ বছরে আমরা রচনা করেছি অসংখ্য প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়। এসব প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়গুলোর শিরোনামগুলো পরিচয় বহন করে বাংলা কমপিউটিং আন্দোলনে কমপিউটার জগৎ-এর ভূমিকা কী ছিল। বাংলা কমপিউটিংসংশ্লিষ্ট আমাদের কিছু প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল এরূপ- ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ : কমপিউটারে বাংলা, সর্বস্তরে আদর্শ মান চাই; জানুয়ারি ১৯৯৩ : বাংলা একাডেমির হাতে বিপন্ন বাংলা; আগস্ট ১৯৯৩ : বিবিসির পোস্ট মর্টেম, বাংলাদেশের বাংলা ভারতের নিয়ন্ত্রণে; ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ : অনিশ্চয়তার পথে বাংলাদেশের বাংলা; ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ : কমপিউটার ও বাংলা সফটওয়্যার, সফটওয়্যার বাণিজ্য; মে ১৯৯৬ : কমপিউটার ও বাংলাভাষা; মার্চ ২০০১ : বাংলাভাষার বিশালাকার তথ্যপ্রযুক্তি বাজার; ফেব্রুয়ারি ২০০৩ : বাংলা কমপিউটিংয়ের দুরবস্থা এবং বায়োসের উদ্যোগ; ফেব্রুয়ারি ২০০৪ : বাংলায় আইসিটি; ফেব্রুয়ারি ২০০৫ : তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে বাংলা কমপিউটিং; ফেব্রুয়ারি ২০০৬ : কমপিউটারে বাংলাভাষা প্রয়োগ, প্রয়োজন আরও জোরালো গবেষণা; ফেব্রুয়ারি ২০০৭ : ডিজিটাল যন্ত্রে কেমন আছে বাংলাভাষা; ফেব্রুয়ারি ২০০৮ : বাংলা কমপিউটিং ও আমরা; ফেব্রুয়ারি ২০০৯ : বাংলা কমপিউটিংয়ে গবেষণা; এ ছাড়াও এ সংখ্যায় ছিল আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ লেখা : ‘কমপিউটারে ডিজিটাল ধ্বনির প্রয়োগ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে বাংলাভাষার সঙ্কট’; ফেব্রুয়ারি ২০১০ : আইসিটি ও আমাদের বাংলাভাষা; ফেব্রুয়ারি ২০১১ : বাংলা কমপিউটিং ও কয়েকটি বাংলা সফটওয়্যার; ফেব্রুয়ারি ২০১২ : বাংলা কমপিউটিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অবদান; ফেব্রুয়ারি ২০১৩ : উদাসীনতায় তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার জয়রথ; এবং এ সংখ্যায় আরেকটি প্রতিবেদন : আমার বর্ণমালা, দুঃখিনী বর্ণমালা; ফেব্রুয়ারি ২০১৪ : প্রযুক্তিতে পিছিয়ে বাংলাভাষার মেলবন্ধন; আগস্ট ২০১৪ : ইউনিকোডের বিজয় ও বাংলালিপির প্রমিতকরণ; এবং ফেব্রুয়ারি ২০১৫ : বাংলাভাষায় কমপিউটার প্রযুক্তি।
এসব প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের বিষয়বৈচিত্র্য এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপকতাকেই তুলে ধরে।
সম্পাদকীয় : যথাসময়ে যথাতাগিদ
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ও অন্যান্য সংবাদ নিবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা কমপিউটিংয়ের পক্ষে কথা বলার পাশাপাশি আমরা অসংখ্য সম্পাদকীয় লিখে বাংলা কমপিউটিংয়ের প্রসারকল্পে যথাসময়ে যথাজন ও যথাকর্তৃপক্ষকে যথাতাগিদ দিতে ছিলাম আন্তরিক ও সচেতন। বাংলা কমপিউটিং বিষয়ে লেখা আমাদের এসব অসংখ্য সম্পাদকীয় থেকে কয়েকটি সম্পাদকীয়র চুম্বকাংশ এখানে উপস্থাপন করছি, যা থেকে বাংলা কমপিউটিং নিয়ে আমাদের অতীত অনুভূতি-উপলব্ধি ও অবস্থান কী ছিল, সে সম্পর্কে পাঠক-সাধারণ কিছুটা হলেও অাঁচ করতে পারবেন।
জানুয়ারি ১৯৯৩ : ‘এবার ভুল করল বাংলা একাডেমি। কীবোর্ড প্রমিতকরণে জাতীয় স্বার্থসংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলা একাডেমির প্রশাসনিক দফতর। প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও। কী জবাব দেবে বাংলা একাডেমি, আমরা তা জানি না। কিন্তু আমরা এটুকু বুঝি, এ ঘটনা দেশীয় প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও বিকাশে বিরূপ প্রভার ফেলবে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে যেখানে একটি ভাষার জন্য প্রচলিত কীবোর্ডের সংখ্যা একাধিক নয়, সেখানে বাংলাদেশে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের বাণিজ্যের ষোলকলা পূরণের অভিপ্রায়ে প্রসব করে চলেছে একের পর এক কীবোর্ড। এ মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না হচ্ছে, ততদিন বিশ্বপ্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক না কেনো, বন্ধ্যত্ব ঘুচবে না আমাদের।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ : ‘ভাষা আন্দোলনের ৪০ বছর পরও সরকার ও সরকারি সংস্থা একটি জাতীয় বাংলা কীবোর্ড হাজির করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার ডালি মাথায় বয়ে আরেক ফেব্রুয়ারিতে হাজির হয়েছি আমরা। বাংলাভাষায় কীবোর্ড ৬ বছরেও কিছু হয়নি। রাষ্ট্র ও ভাষা ঐতিহ্যের হেফাজতকারী সরকারের কাছে এ আমাদের জিজ্ঞাস্য।’
ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ : ‘বাংলাভাষার জন্য আন্তর্জাতিক একটি তথ্য বিনিময় কোড তৈরির যোগ্যতা এ দেশের অনেকের ছিল এবং আছে। কিন্তু সরকার সময়মতো কাজ না করায় এ দেশ ভারতের কোড ও এর প্রযুক্তির নিচে চাপা পড়ার অবস্থায় উপনীত হয়েছে। মণীষাসম্পন্ন মানুষের বগলে বর্ণচোরা আমলাদের ওপর ভর করে সরকার জাতিকে পরাভবের পথে ঠেলে দিয়েছে। অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির পাশাপাশি এ জাতির আপন বাংলাভাষার অহঙ্কার খুন করে এরা যখন একুশের নাম উচ্চারণ করে, তখন ধিক্কার উচ্চারণই হয়তো সমীচীন।’
অক্টোবর, ২০০২ : ‘বাংলা কীবোর্ড প্রমিতকরণ হয়নি। মাত্র দুই হাজার ডলার দিয়ে বাংলাদেশ এখনও ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য হতে পারেনি। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরির কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আমরা মনে করি, এসব ক্ষেত্রে ত্বরিত ও কার্যকর ব্যবস্থা এখনই নেয়া উচিত।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ : ‘মায়ের ভাষার জন্য ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আত্মত্যাগের মহান নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম, সে গৌরব আজ মস্নান হতে বসেছে বাংলা কমপিউটিংয়ের দৈন্য দেখে। সত্যিই বাংলা কমপিউটিংয়ে অমার্জনীয়ভাবে এই পিছিয়ে যাওয়াটা চরম লজ্জাজনক।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ : ‘মুদ্রণপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগে আমরা অনেকটা সফল হলেও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগে আমরা অনেকটা পিছিয়ে। সেই সাথে দুঃখের সাথে বলতে হয়, আইসিটি নীতিমালায় বাংলাভাষা প্রয়োগের কোনো উল্লেখ নেই। আমরা বাইল্যাঙ্গুয়াল হব, না ইউনিল্যাঙ্গুয়াল হব, এর কোনো দিকনির্দেশনা নেই। অথচ তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষা প্রয়োগের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ : ‘গত ৩০ জানুয়ারি মাইক্রোসফট বেঙ্গলি ইন্ডিয়া নামের বিশ্বের প্রথম বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাক প্রকাশ করেছে। এটি কমপিউটারে বাংলাভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক নিশ্চয়। তবে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাকে বেঙ্গলি ইন্ডিয়া কিংবা বেঙ্গলি বাংলাদেশ নামে আখ্যায়িত করে কেনো এভাবে ভাগ করা হবে? এর যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। তা ছাড়া মাইক্রোসফটের বাংলা ফন্টের নাম রাখা হয়েছে বৃন্দা। কেনো এর নাম রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল করল না? তা-ও আমাদের বোধে আসে না।’
ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ : ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করতে চাইলে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তবে সহজেই অনুমেয়, এ গবেষণা খুবই ব্যয়বহুল। এ গবেষণা দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হয়। এ কারণে এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে ব্যাপক কোনো গবেষণার কথা শোনা যায় না।’
ইউনিকোড ও কমপিউটারে বাংলাভাষা
আমরা শুরু থেকেই ইউনিকোডে বাংলাভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করে কমপিউটারে বাংলাভাষার প্রমিত ব্যবহারে খুবই সচেতন ছিলাম। ইউনিকোড হলো সারা দুনিয়ার ভাষাগুলোর জন্য ডিজিটাল যন্ত্রের এক ও অভিন্ন অ্যানকোডিং ব্যবস্থা। অপরদিকে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম হচ্ছে এই কোড প্রমিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত একটি অলাভজনক সংস্থা। এর সূচনা ১৯৪৬ সালে হলেও এর জন্ম ধরা হয় ১৯৮৭ সালে। আর এই কনসোর্টিয়াম মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে ইউনিকোড ইনকর্পোরেটেড হয়। বস্ত্তত কমপিউটারে অপারেটিং সিস্টেম প্যাকেজ আকারে আসার আগে রোমান হরফ ছাড়া অন্য কোনো হরফ ব্যবহার করার কথা ভাবাই যেত না। প্রো-ডস, এমএস-ডস ইত্যাদি অপারেটিং সিস্টেমে ইংরেজি হরফ ব্যবহারের বদলে কোনো মতে অন্য হরফ উৎপাদন করা যেত। কিন্তু কমপিউটারে অরোমান হরফ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে অ্যাপল কোম্পানির ম্যাকিনটোশ কমপিউটারে। এতে কমপিউটার অপারেটিং সিস্টেম, সংলাপ ঘর এবং ফন্টগুলো বাংলায় রূপান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই সূত্র ধরেই অ্যাপল এমনকি আরবি, চীনা, জাপানি, কোরীয় ইত্যাদি ভাষায় রূপান্তর করতে সমর্থ হয়। এক সময় অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমে ওয়ার্ল্ড স্ক্রিপ্ট নামের প্রযুক্তি ব্যবহার হতো। ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা সমর্থন করত বলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও ম্যাকিনটোশ কমপিউটার বিক্রি হতো।
কিন্তু এতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়নি। রোমান হরফের জন্য তখন কমপিউটারে মাত্র ২৫৬টি কোড বরাদ্দ ছিল। সেটি পরিচিত আসকি কোড হিসেবে। ম্যাকিনটোশের ওয়ার্ল্ড স্ক্রিপ্ট প্রযুক্তি এরচেয়ে বেশি কোড ব্যবহার করলেও বিশ্বের সব ভাষাকে এক সাথে ব্যবহারের মতো সুযোগ তা করতে পারেনি। বাংলাভাষার ক্ষেত্রে এর ২৫৬টি কোডের মাত্র ২২৪টি কোডের সংস্থান করা সম্ভব হয়। তখন বাংলাভাষার সব যুক্তাক্ষর, চিহ্ন ও হরফ কমপিউটারে প্রকাশ করা যেত না। কমপিউটারের ২৫৬টি কোডের মাঝে বিভিন্ন ভাষাকে সংস্থান করার এসব সমস্যার কথা বিবেচনা করে অ্যাপলই প্রথম ভাবতে থাকে, সব ভাষার জন্য একটি কোডিং সিস্টেম তৈরি করা দরকার। এদের ওয়ার্ল্ড স্ক্রিপ্ট সে সমস্যার আংশিক সমাধান দেয়ার ফলে এরা আরও একটি উন্নত পদ্ধতি তৈরির জন্য ইউনিকোড সিস্টেম গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়। নববইয়ের দশকের শুরুতে এরা ২৫৬টি কোডের বিষয়টিকে ৬৫৫৩৬ কোডে রূপান্তরের প্রয়াস নেয়। অ্যাপলের উদ্যোগে গঠিত হয় ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম। অ্যাপলের এই উদ্যোগ সাফল্য পেতে থাকে। কারণ, অ্যাপল শুরুতেই ভাবে, এটি শুধু অ্যাপলের নিজস্ব কোনো মান নয়, সারা দুনিয়ার ভাষাগুলোর জন্য কমপিউটারের সব নির্মাতার জন্য যেনো একটি আদর্শ মান হয়ে দাঁড়ায়। কমপিউটারের অপারেটিং সিস্টেম যারা তৈরি করেন, তাদের সবাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নেন। অ্যাপল, মাইক্রোসফট, কম্প্যাক, এইচপি, আইবিএম, ওরাকল, এসএসপি, সাইবেজ, ইউনিসিস ও সান- এরা সবাই ইউনিকোডকে মেনে নেয়।
ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলাভাষার প্রমিতকরণের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সাথে আমাদের যুক্ত হওয়া। এরই মধ্যে এই সংস্থাটি বাংলাভাষার জন্য ব্যবহার হওয়া লিপিমালার প্রমিতকরণও এই সংস্থাটি করেছে। বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও ইউনিকোড প্রয়োগ করা হয়েছে। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছি। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমাদেরকে কমপিউটার জগৎকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংবাদ, নিবন্ধ ও প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নানা তাগিদ দিতে হয়েছে। ১৯৯৩ সালের আগস্ট সংখ্যার ‘বিবিসির পোস্টমোর্টেম : বাংলাদেশের বাংলা ভারতের নিয়ন্ত্রণে’ শীর্ষক প্রচ্ছদ প্রতিবেদন, ২০০১ সালে এপ্রিল সংখ্যার ‘ইউনিকোড ও বাংলাভাষা : ইউনিকোড সংস্থায় বাংলাদেশ অনুপস্থিত’ শীর্ষক প্রচ্ছদ প্রতিবেদন এবং ২০১৪ সালের আগস্ট সংখ্যার ‘ইউনিকোডে বিজয় ও বাংলা লিপির প্রমিতকরণ’ শীর্ষক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের বিষয়টি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আজকের প্রজন্মের জানা দরকার, অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাভাষা আজ ইউনিকোডভুক্ত এবং বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামভুক্ত। কিন্তু এটি ঠিক, যে সময়টায় ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম নামের সংস্থাটির সাথে আমাদের যুক্ত হওয়ার কথা ছিল, সেই যথাসময়ে তা আমরা পারিনি। সেজন্য বাংলা বর্ণমালার প্রমিতকরণ নিয়ে সঙ্কটও ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান এর সদস্য হওয়া। আর সদস্য হতে প্রয়োজন ছিল ১২ হাজার মার্কিন ডলার চাঁদা পরিশোধ। কিন্তু বাংলাদেশের অতীত সরকারগুলো তা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ইউনিকোডের জন্মের ২৩ বছর পর ২০১০ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্যপদ লাভ করে। আর ১ জুলাই ২০১০ থেকে এই সদস্যপদ কার্যকর হয়। অথচ এরও ১৯ বছর আগে আমরা এ সদস্যপদ পেতে পারতাম।
বাংলা কমপিউটিংয়ের ইতিহাস বলে- বাংলাদেশে কমপিউটারে বাংলা প্রয়োগের বিষয়টিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষে্য ১৯৮৭ সালে বুয়েটের তৎকালীন ভিসি মরহুম অধ্যাপক মুহম্মদ শাহজাহানকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির দায়িত্ব ছিল বাংলা কোডসেট ও কীবোর্ড প্রমিতকরণের জন্য প্রস্তাব করা। সে কমিটিতে বিশেষজ্ঞেরা ছাড়াও যারা কমপিউটারে বাংলাভাষার প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছিলেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে প্রযুক্তিব্যক্তিত্ব মোস্তাফা জববারও ছিলেন। কমিটি ১৯৯৪ সালে একটি কোডসেট তৈরি করে এবং বিএসটিআইকে তা প্রমিত করার জন্য প্রস্তার করে। সেটি বস্ত্তত প্রণীত হয় বুয়েটের কমপিউটার বিজ্ঞানের তৎকালীন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মাহবুবুর রহমানের মতামত অনুযায়ী। সে কোড প্রণয়নের সময় মোস্তাফা জববার প্রস্তাব করেছিলেন, কমপিউটারের কোডিংয়ের ভবিষ্যৎ হলো ইউনিকোড। সুতরাং বাংলাকোড তৈরির জন্য ইউনিকোড পদ্ধতি গ্রহণ করা হোক। কিন্তু সে কমিটি তার প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। সে কোডসেট প্রথমে কমপিউটার কাউন্সিল ও পরে বিএসটিআই হয়ে পরে আইএওতে যায়। এর পরের ইতিহাস সুদীর্ঘ, যেখানে প্রবেশের কোনো অবকাশ এখানে একদম নেই। তাবে নানা আন্দোলনের মধ্য নিয়ে বাংলাভাষা আজ ইউনিকোডভুক্ত। বাংলাদেশ আজ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য। সে পর্যায়ে পৌঁছার আন্দোলনে কমপিউটার জগৎ ছিল আন্তরিক প্রয়াসী। কমপিউটার জগৎ-এর লেখালেখি এর দালিলিক প্রমাণ বহন করে।
বাংলাদেশের বাংলা ভারতের নিয়ন্ত্রণে?
১৯৯৩ সালের আগস্টে এসে আমরা জাতিকে বাংলা কমপিউটিং প্রশ্নে একটি ভয়াবহ উদ্বেগের কথা জানাই কমপিউটার জগৎ-এর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের মাধ্যমে। তখন আমরা দেখলাম, আমাদের অবহেলার কারণে তথ্যপ্রযুক্তি দিগমেত্ম আমাদের প্রাণের বাংলাভাষা চলে যাচ্ছে ভিন দেশের নিয়ন্ত্রণে। তখন বিষয়টি নিয়ে তৈরি ‘বংলাদেশের বাংলা ভারতের নিয়ন্ত্রণে’ শীর্ষক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে সে উদ্বেগের কথা প্রকাশ করে এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে লিখি- ‘শ্রীলঙ্কা থাইল্যান্ডের মতো দেশ আইএসওতে নিজস্ব ভাষার কোডিং জমা দিয়ে অপেক্ষা করছে দু’বছর ধরে। ভাষার অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না যে জাতির, সেই জাতির বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে রেখে এ জাতির ভাষার বর্ণমালার কোডিং তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এরা বাংলাভাষার ওপর যে সফটওয়্যার তৈরির কাজ সেরেছে, তা আগ্রাসী শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করবে অচিরেই। বিনাযুদ্ধে ভাষা ও বর্ণের ওপর জাতীয় অধিকার ছেড়ে দিয়ে এ সরকার ১৯৫২-র ও ১৯৭১-এর বিজয়কে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। অথচ কেতাব রচয়িতা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।’
এই উদ্বেগের কথা জানিয়ে এই প্রতিবেদনে আমরা আরও লিখেছিলাম, ‘যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত বাংলাদেশের কমপিউটার বিজ্ঞানী ড. জাফর ইকবাল এ ব্যর্থতার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে দু’বছর আগেই জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন : ‘অবিলম্বে বাংলা বর্ণমালা ও চিহ্নগুলোর তথ্য বিনিময় কোড (ASCII-র অনুরূপ) প্রমিতকরণের ব্যবস্থা না নিলে, যদি অন্য কোনো দেশ তাদের কীবোর্ড প্রমিতকরণ করিয়ে নেয়, তাহলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। এমন কোনো কোড তৈরি করে আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি আদায় পেতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগে।’
একই প্রতিবেদনে আমরা উচ্চারণ করতে বাধ্য হই, ‘কমপিউটার জগৎ দুই বছর ধরে সুদূর চীন ও আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের লেখাসহ পাঁচ-সাতটি ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ ব্যাপারে মাথা কুটবার পরও উন্নাসিক আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিকদের মধ্যে বিন্দুমাত্র গরজ তৈরি হয়নি। কারণ, কমপিউটারের সাথে সংস্রবহীন, এমনকি কমপিউটারবিদ্বেষী হীনমন্য কিছু লোক এসব ক্ষেত্রে কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। সবকিছু উপেক্ষার মধ্যেই এরা আত্মজাহিরের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন, কিন্তু একবারও ভেবে দেখেন না, এর ফলে জাতি কী গুরুতর সঙ্কটে পতিত হচ্ছে।’
এভাবে পুরো প্রতিবেদনে বিষয়টির নানা দিক তুলে ধরে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টজনদের বাক্যবাণে জর্জরিত করতে কুণ্ঠাবোধ করিনি আমরা। কারণ, আমাদের কাছে জাতীয় স্বার্থরক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।
দেশের বৃহত্তম বাংলা আইটি ওয়েবপোর্টাল
বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পৌঁছে দিতে বাংলা ভাষার তথ্যপ্রযুক্তি ওয়েবপোর্টাল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে উপলব্ধি আমাদের শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু চাইলেই বাংলায় একটি সম্পূর্ণ ওয়েবপোর্টাল চালু করে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ও প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতা সীমাহীন। এসব নানা বাধাবিপত্তি কাটিয়ে কমপিউটার জগৎ-এর ১৮তম বর্ষপূর্তির মাস ২০০৯ সালের এপ্রিলে আমরা চালু করতে সক্ষম হই দেশের বৃহত্তম বাংলা তথ্যপ্রযুক্তি ওয়েবপোর্টাল। সে বছরের ২৫ এপ্রিল মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর ইতিহাসে, এমনকি বাংলাদেশের বাংলা কমপিউটিংকে এগিয়ে নেয়ার ইতিহাসে সৃষ্টি হয় এক মাইলফলক। এই দিনে মাসিক কমপিউটার জগৎ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে এর নিজস্ব ওয়েবপোর্টাল www.comjagat.com-এর বেটা ভার্সন। এটি বাংলায় ও ইংরেজিতে করা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আইটিবিষয়ক পোর্টাল। এতে কমপিউটার জগৎ-এর চবিবশ বছরে প্রকাশিত সব সংখ্যা আর্কাইভ করা আছে, যেগুলো যেকেউ চাইলেই বিনে পয়সায় ডাউনলোড করতে কিংবা অনলাইনে পড়তে পারবেন।
এই ওয়েরপোর্টালে প্রযুক্তিধর্মী মানুষ নানাধর্মী সেবা পেতে পারেন সহজেই। এসব সেবার মধ্যে আছে : ০১. কমপিউটার জগৎ-এ প্রকাশিত সব নতুন ও পুরনো লেখা ডাউনলোড ও অনলাইনে পড়ার সুযোগ; ০২. নিজের লেখা পোস্ট করার সুযোগ; ০৩. ক্যুইজে অংশ নেয়ার সুযোগ; ০৪. তথ্যপ্রযুক্তি, নতুন পণ্য, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও অন্যান্য বিষয়ের খবর জানার ও প্রকাশের সুযোগ; ফ্রিল্যান্সিং ও স্কলারশিপসহ নানাধর্মী তথ্য জানার সুযোগ; ০৫. পণ্য ও লেখার র্যাশঙ্কিং, রেটিং ও মন্তব্য করার সুযোগ; ০৬. নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইল তৈরি, অনুষ্ঠিত ও অনুষ্ঠিতব্য অনুষ্ঠানের খবর প্রকাশের সুযোগ; ০৭. আইসিটিবিষয়ক বিভিন্ন অফার ও নতুন পণ্যের বিবরণ তুলে ধরার সুযোগ এবং ০৮. ব্লগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আগ্রহের আইটি বিষয়ে দলীয় আলোচনার সুযোগসহ আরও নানা ধরনের সুযোগ।
শেষকথা
বাংলা কমপিউটিংয়ের আন্দোলনে আমরা কতটুকু সফল কিংবা কতটুকু ব্যর্থ, সে বিচারের ভার আমাদের সম্মানিত পাঠক মহলের ওপর। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা অবশ্যই জোরালোভাবে দাবি করব, এ আন্দোলন প্রশ্নে আমরা ছিলাম বরাবর প্রতিশ্রম্নতিশীল ও শতভাগ আন্তরিক। আগামী দিনেও এ ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি থাকবে না- অন্তত এ প্রতিশ্রম্নতি পাঠকবর্গকে নিশ্চিতভাবে দিতে পারি