লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৫ - ফেব্রুয়ারী
সবার জন্য সব তথ্য : রেটিং সমস্যা
তথ্যের শক্তি সম্পর্কে এ যুগে কারও সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজনীয় তথ্য সময়মতো পেলে যেকোনো মানুষ ক্ষমতাবান ও অর্থশালী হয়ে ওঠে। অভাবী মানুষও হয়ে উঠতে পারে সচ্ছল ও আত্মবিশ্বাসী। আরও সূক্ষ্মভাবে বলা যায়- সব দেশেই সরকার জনগণের উন্নয়নের জন্য কিছু না কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ- বিশেষ করে যাদের ওই কর্মসূচির সহায়তা প্রয়োজন, তারা যদি বিষয়গুলো জানতে না পারে, তাহলে তাদের পক্ষে সরকারি উদ্যোগের সুবিধা নেয়া সম্ভব হয় না। এ কারণেই অনেক সময় দেখা যায়, সরকারের উদ্যোগ সত্ত্বেও দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত বিষয়গুলো জনসাধারণের জানা-শোনার বাইরেই রয়ে যায়। এ ছাড়া এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলো সাধারণ মানুষ জানতে পারলে সরকারের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বাড়ে- সে বিষয়গুলোও সাধারণ মানুষ সময়মতো জানতে পারে না। অথচ একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং তাদের নিরাপত্তাহীন অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে শঙ্কাহীন করে তোলা খুবই জরুরি। এর ফলে সার্বিকভাবে দেশের উন্নতি হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসে এবং অনিয়ম-দুর্নীতি ও জনবিরোধী কর্মকা- উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়।
আইসিটির মাধ্যমে এই কাজগুলো করা বা কোন দেশ বেশি করছে, ঠিকমতো করছে কিংবা করছে না অথবা করতে পারছে না, সে বিষয়গুলো কিন্তু মনিটরিং হচ্ছে এবং রেটিং পদ্ধতিও চালু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে অনেকেই হয়তো ‘ওপেন ডাটা ব্যারোমিটারের’ কথা জেনে গেছেন। যারা ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বের সেই দেশগুলোর রেটিং করছে, বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় তথ্য অনলাইনে জানাছে কিংবা জানানোর চেষ্টা করছে। মূলত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশন এই ওপেন ডাটা ব্যারোমিটার কর্মসূচি চালু করেছে। আইসিটি সম্পর্কিত তথ্য যাদের নখদর্পণে, তারা নিশ্চয়ই জানেন আমাদের যুগের আইসিটির বিশ্বায়নের অন্যতম নায়ক টিম বার্নাস লি গড়ে তুলেছিলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, যা আইসিটিভিত্তিক নেটওয়ার্কিং এবং ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সরকারের নেটওয়ার্ক অবস্থানকে শৃঙ্খলার মধ্যে এনেছে এবং রেখেছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশন গড়ে ওঠে ২০০৯ সালে। এই ফাউন্ডেশন কাজ করছে সেই সব দেশকে নিয়ে, যেগুলো সরকারি ও রাষ্ট্রীয় তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করতে নীতিগতভাবে একমত। এখন পর্যন্ত ৮৩টি দেশ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশনের তালিকায় সম্মতির মাধ্যমে সন্নিবেশিত হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এখন পর্যন্ত টিম বার্নাস লি-ই এই সংস্থার কার্যক্রমের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। অতি সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন ওপেন ডাটা ব্যারোমিটার রাষ্ট্রীয় তথ্য প্রদান, দুর্নীতি ও অন্যান্য স্বচ্ছতাবিষয়ক তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড ও ফ্রান্স। এই তালিকার প্রথম তিনটি দেশের অবস্থান গত বছরের মতোই আছে। আর বাংলাদেশের অবস্থান এ তালিকায় ৭৩ নম্বরে রয়েছে।
এই তালিকার আলোকে একটি বিষয় স্পষ্ট, যেকোনো বিবেচনাতেই অভ্যন্তরীণ প্রচারণায় বাংলাদেশের আইসিটিবিষয়ক সক্ষমতাকে যে উচ্চতাতেই দেখানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, দেশটি এখন পর্যন্ত সঠিক পথটা ধরতে পারেনি। যদিও এ তালিকা সম্পর্কে কিছু আপত্তি অনেকেই তুলতে পারেন এ যুক্তি দেখিয়ে যে, বাংলাদেশ সরকার আইসিটি সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো এবং তথ্য প্রদানের যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে সে তথ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশন সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। এমনও ঘটতে পারে যে, অর্থনৈতিকভাবে সমপর্যায়ের অনেক দেশের গড়পড়তা অবস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানটা তালিকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই আলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাকে যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে দেখা যাবে আইসিটি শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও নেটওয়ার্কের বিস্তৃতির তুলনায় সরকারের অনলাইন পারফরম্যান্স রয়ে গেছে প্রাথমিক পর্যায়ে। নেটওয়র্কের বিস্তার এবং অন্যান্য অবকাঠামো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে ঠিকই, সেই তুলনায় সেবা এবং যেসব তথ্য সরকারের ভাবমূর্তি উন্নত করে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, সে তথ্যগুলো সংরক্ষণ ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না বা এখন পর্যন্ত হয়নি।
টিম বার্নাস লি’র পর্যবেক্ষণ খুব একটা নতুন ইঙ্গিত না দিলেও আশু করণীয় সম্পর্কে যে বিষয়টি জানান দিয়েছেন, তা হলো অনলাইনে আর্থিক সংশ্লিষ্ট সেবা দেয়ার চেষ্টার পাশাপাশি এমন সরকারি ও রাষ্ট্রীয় তথ্য দিতে হবে, যাতে বহুল আলোচিত বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষের সন্দেহের নিরসন হয়। এ যুগে মূল বিষয়টি যে হচ্ছে দুর্নীতি, তা অনস্বীকার্য এবং এর ওপরই সরকারের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ সরকারের ই-টেন্ডারবিষয়ক পদক্ষেপ এর একটি অংশমাত্র। তবে অনেক বিভাগের দুর্নীতি নিরসনেই সরকার কাজ করছে এবং অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্যই সরকারের খাতে রয়েছে, যা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে অনেক তথ্য সরকারের হাতে আছে ঠিকই, কিন্তু তা অনলাইনে সংরক্ষেত নয়। ইতোমধ্যে আমরা তথ্য বাতায়নের কথা শুনেছি ঠিকই, কিন্তু যে ধরনের তথ্য সেখানে থাকার কথা বলা হচ্ছে, তাতে জনসাধারণের তথ্যতৃষ্ণা পুরোপুরি মিটবে বলে মনে হয় না।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে যেটুকু তথ্য জানানো হচ্ছে তা হালনাগাদ হতে সময় নিচ্ছে অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, কোন তথ্য কীভাবে সংরক্ষণ ও জনগণের ব্যবহারের জন্য দেয়া হবে, তা নির্ধারণ করার দায়িত্বশীল লোক নেই। এখন পর্যন্ত যাদের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে, তারা প্রাচীন পন্থায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমলা। তাদের পক্ষে এই যুগের উপযোগী তথ্য অকপটে প্রকাশ করা কষ্টকর। সে কারণেই অনেক আগেই সরকারের কাছে আইসিটি জাতীয় সেবা প্রচলনের দাবি জানানো হয়েছিল। যেকোনো দেশের নাগরিকের জন্য সরকারের দেয়া তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন পর্যন্ত আইসিটির মান অর্জনের ক্ষেত্রে তথ্য সংরক্ষণ ও জানানোর সরকারি প্রচেষ্টারও মূল্যায়ন হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশ সরকারকে এখন তথ্য বাতায়নের কাজটিই খুব দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর সেজন্য উপযুক্ত কর্মী বাহিনীরও প্রয়োজন হবে।
জনসাধারণের তথ্যতৃষ্ণা অসীম। অধিকন্তু বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে মানুষের রুচির এবং প্রয়োজনের বৈচিত্র্য বহুমুখী হওয়াই স্বাভাবিক। সে কারণেই সব তথ্যই তাদের কাছে পৌঁছানোটা গুরুত্বপূর্ণ। আর কাজটা স্বাভাবিক নিয়মের বলেই বিবেচনা করা উচিত। তথ্যের দ্রুত স্বাভাবিক প্রবাহ সরকারকে অনেক সমস্যা সমাধানে সহায়তাও করতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে সরকার জনসাধারণের অংশীদার হয়ে উঠতে পারে। জনসাধারণের মধ্যে থাকা মেধাবীরা তাদের অবদানও নিশ্চিত করতে পারে।
উপযোগবাদই আধুনিক জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর এ যুগের গণউপযোগী হচ্ছে তথ্য। যত দ্রুত মানুষ তথ্য পাবে, তত দ্রুততায় সন্দেহ নিরসন হবে এবং বিচ্ছিন্নতার অবসান হবে। নিজের ভাগ্যোন্নয়নের সাথে সাথে সে দেশের উন্নয়নেও অবদান রাখবে অবধারিতভাবে। বেশি তথ্য, বেশি সচেতনতা, বেশি সক্ষমতা এবং বেশি দেশপ্রেম এই বলিষ্ঠ তত্ত্বকে কি কেউ এই একবিংশ শতকে অস্বীকার করতে পারেন?
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com