লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
রফতানি খাত হিসেবে আইসিটি
সুখবরই বলতে হচ্ছে একে। গত ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের জানালেন, তৈরী পোশাক শিল্পের পর আরও চারটি রফতানি খাতকে গড়ে তুলবে সরকার। এই খাত চারটি হচ্ছে- জাহাজ নির্মাণ, আইসিটি, ওষুধ ও চামড়া। সেদিন বাণিজ্যমন্ত্রীর দফতরে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার। সেই আলোচনার বিষয় সম্পর্কে জানাতে গিয়েই বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একাধিকবার বিশেষভাবে বলেছেন আইসিটির কথা।
ইতোমধ্যে যদিও আইসিটিবিষয়ক পণ্য ও সার্ভিস রফতানি হচ্ছে, কিন্তু তার পরিমাণ আশানুরূপ নয়। অন্তত এটা বলা যায়, এদেশে আইসিটির ব্যবহার যে সময় থেকে শুরু হয়েছিল এবং ইতোমধ্যে যে পরিমাণ লোকবল তৈরি হয়েছে, সে তুলনায় আইসিটিবিষয়ক পণ্য ও সার্ভিস রফতানি যতটা বাড়া উচিত ছিল, ততটা বাড়েনি। এ বিষয়ক প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়, কিন্তু তেমন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে বলতে হয় আইসিটি পণ্য রফতানির জন্য যে আইনি কাঠামো এবং এ খাত থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার যে প্রক্রিয়া তা সহজ হয়নি। এসব কারণে এবং অন্য আরও কিছু কারণে আইসিটির রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনের জন্য স্বতন্ত্র শিল্পখাতও গড়ে ওঠেনি।
প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের শিল্পখাত গড়ে তোলার জন্য অর্থবহ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রয়োজন। অন্তত অন্যান্য রফতানিযোগ্য শিল্পখাতকে যে ধরনের উৎসাহ-পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা দেয়া হয় সেটাও প্রয়োজন এ খাতকে গড়ে তোলার জন্য। আমরা জানি আরএমজি বা তৈরি পোশাক শিল্পখাতকে প্রণোদনাসহ নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হয়। হয়তো এই বিবেচনায় দেয়া হয়, কারণ এ খাতটি সবচেয়ে শ্রমঘন। অবহেলিত নারী সমাজসহ প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে সরাসরি এবং ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পে ও পরিবহন ক্ষেত্রেও নিয়োজিত হয়েছে অনেক মানুষ। নিশ্চয়ই আইসিটি শিল্প ওই ধরনের শ্রমঘন হবে না, অথবা অন্যান্য শিল্পখাত, যেগুলোর মাধ্যমে নতুন রফতানি পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, যেমন- জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ ও চামড়া শিল্প, এগুলোও এমন শ্রমঘন হবে না; তবে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা একেবারে কমও হবে না। এসব খাতে কর্মসংস্থান হবে অধিকতর শিক্ষিত যুবকদের। আইসিটি খাতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিতদের।
এছাড়া আইসিটি সাথে প্রস্তাবিত ডিশ রফতানি খাত গড়ে তোলা গেলে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াও পড়বে। বিশেষভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার যে নৈতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তা প্রশমিত হবে। কারণ কর্মসংস্থানের হাতছানি থাকলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে। আইসিটি খাত নিয়ে উৎসাহী শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদেরও অনিশ্চিত-দুশ্চিমত্মাগ্রস্ত অবস্থার অবসান হবে।
এখনই আইসিটি খাতের পণ্য ও সেবা রফতানির বাস্তব বিষয়। যদিও প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রম্নপ বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে খুব একটা উৎসাহী হয়নি, তবুও মেধাবী তরুণেরা নিজস্ব প্রচেষ্টাতেই অনেক উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন। ব্যক্তিগতভাবেও রাজধানী ছাড়া বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ ও বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, যেখানে আউটসোর্সিংয়ের জন্য পেশাজীবীদের দেখা মেলে। কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেগুলো সফটওয়্যার রফতানিকে প্রধান উদ্যোগ হিসেবে নিয়েছে, যদিও তাদের মুখোমুখি হতে হয় অনেক বাধার। অ্যানিমেশন নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারাও উদ্যোগগুলোকে বড় করে তুলতে পারছেন না পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে। ট্রাবলশুটিং ও অন্যান্য আইসিটিবিষয়ক সার্ভিসও একটা ভালো অর্থকরি রফতানি খাত হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে সেই ইঙ্গিতগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
দেরিতে নজর দেয়া হয়েছে, তা হয়তো ঠিক। তবে আইসিটি খাতের উন্নয়নে যা করা প্রয়োজন ছিল, সেগুলোই এখন দ্রুত করতে হবে। প্রথমেই প্রয়োজন আইসিটি পার্ক। সম্ভব হলে গাজীপুর ও মহাখালী দুটোই করা যেতে পারে। এছাড়া বিভাগীয় শহরগুলোতেও আইসিটি পার্ক গড়ে তোলা যেতে পারে এবং তা সম্ভবপরও।
আইসিটি খাতেরও বহুমাত্রিকতা আছে। এখানে যে প্রাথমিক উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছে, তার বাইরেও অনেক উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, গড়ে তোলা যেতে পারে হার্ডওয়্যার শিল্প। বিশ্বে কমপিউটার, সার্ভার, মডেমসহ অন্যান্য পণ্য ও যন্ত্রাংশ তৈরি করে যেসব কোম্পানি, তাদের সহযোগিতায় এদেশেও গড়ে তোলা যায় শতভাগ রফতানিযোগ্য আইসিটি শিল্প।
আইসিটিকে রফতানি খাত হিসেবে অগ্রগণ্য করে তোলার বিষয়টি যুগোপযোগী সন্দেহ নেই, তবে প্রকৃত শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অর্থের জোগান, সহজ বিনিয়োগ সুবিধা, স্থান সঙ্কুলান- এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আইসিটির গুরুত্ব অনুধাবন নতুন না হলেও আইসিটিবিষয়ক বৃহৎ উদ্যোগ নেয়ার অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি এখন পর্যন্ত।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই বাণিজ্যমন্ত্রী কথার কথা বলেননি। যদিও তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আইসিটি খাত দেশের অন্যতম রফতানি খাত হয়ে ওঠার যোগ্য। কিন্তু যে অবস্থায় চলমান উদ্যোগগুলো রয়েছে, সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রফতানি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে একটি একক মন্ত্রণালয় কখনই সব ভূমিকা পালন করতে পারবে না। আগেও দেখা গেছে, এক আইসিটি পার্কের অভিজ্ঞতাই বলছে পুরনো নিয়মে সম্ভব নয়। তদুপরি ডাক ও আইসিটিবিষয়ক মন্ত্রণালয়টি যে অবস্থায় আছে এবং এর জন্য যা অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তাতে একটি রফতানিযোগ্য শিল্পখাত গড়ে তোলার সক্ষমতা এখন পর্যন্ত এর নেই। সেই সক্ষমতা মন্ত্রণালয়টিকে দিতে হবে কিংবা অর্থ ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে সাথে রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যাতে আইসিটি শিল্প-সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে, ব্যাংকগুলো যাতে অর্থায়নে উৎসাহিত হয়, সে ব্যবস্থা করাটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ক্ষেত্রেই সমস্যা অনেক। অন্যান্য শিল্পও যেখানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস পায় না, সেখানে আইসিটি খাতকে একেবারেই পাত্তা না দেয়ার একটি প্রবণতা অনেক দিন ধরেই গেড়ে বসেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নির্দেশনা এবং রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন। এ পরিবর্তন এমন হতে হবে, যাতে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো বুঝতে পারে তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতেই হবে।
আইসিটি খাতকে অর্থকরি রফতানি খাত হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন একটা টাইম ফ্রেমও। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কর্মকা- শুরু করে পূর্বনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের তাগিদ থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজেটে এর বরাদ্দ থাকা। আগামী ২০১৫ সালের জুলাই মাসকে যদি শুরুর সময় ধরা হয়, তাহলে আগেই অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো দরকার। কারণ, ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়টি বাজেট প্রণয়ন কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। আগামী অর্থবছরেও অন্যান্য বছরের মতো আইসিটি খাতের জন্য বরাদ্দের ব্যাপারে যাতে হতাশ হতে না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। বিশেষ করে যারা অনুধাবন ও পরিকল্পনা করেছেন এ খাতকে রফতানির অন্যতম খাতে পরিণত করতে, তাদেরকে মূল জায়গায় কড়া নাড়তে হবে। আগামী দুই থেকে তিনটি অর্থবছরে ঠিকমতো বরাদ্দ এবং নির্দেশনা পেলে আইসিটি খাতের রফতানিতে সক্ষম শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। বিদ্যুতের মতো অবকাঠামো খাতকে যে সরকার তলানি থেকে টেনে তুলতে পারে, সে সরকার আইসিটিকে রফতানি খাত হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে না- এটা বিশ্বাস করা যায় না। সময়মতো এবং ঠিকমতো উদ্যোগ নিলে অবশ্যই সম্ভব হবে নতুন প্রজন্মের উপযোগী নতুন রফতানিযোগ্য শিল্পখাত গড়ে তোলা
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com