লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি অধ্যাপক কাদেরকে
চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি অধ্যাপক কাদেরকে
গোলাপ মুনীর
আজ থেকে ১৪ বছর আগে ২০০৩ সালের ৩ জুলাই আমরা কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা, এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক ও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের তৎকালীন উপ-পরিচালক (প্রশিক্ষণ) অধ্যাপক মো: আবদুল কাদের আমাদের অনেককেই শোকাভিভ‚ত করে চলে যান না ফেরার দেশে। তখন কমপিউটার জগৎ-এর জুলাই, ২০০৩ সংখ্যাটি প্রকাশের একদম শেষ পর্যায়ে। অধ্যাপক আবদুল কাদেরের ইন্তেকালের পর ওই সংখ্যাটি প্রকাশে নেমে আসে এক নিশ্চলতা। কারণ, তার মৃত্যুতে আমরা গোটা পরিবার একদিকে ছিলাম শোকাভিভ‚ত, অন্যদিকে এরই মাঝে ওই সংখ্যাটির বিষয়বস্তুতে আমাদেরকে আনতে হয় ব্যাপক পরিবর্তন। প্রচলিত তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি ছাপাখানা থেকে ফিরিয়ে এনে নতুন করে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখতে হয় মরহুম অধ্যাপক আবদুল কাদেরকে নিয়ে। আর সেদিন তাকে নিয়ে ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটি লিখতে হয়েছিল আমাকেই। সে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটিতে তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার প্রয়াস ছিল। কারণ, আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের সূচনা ও সে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এই মানুষটি যে অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন, তা এ প্রজন্মের মানুষের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আসলে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের এক নেপথ্য পুরুষ ছিলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছেন, তা এ প্রজন্মের অনেকের কাছে অজানা থেকে গেছে তার প্রচারবিমুখিনতার কারণে। কিন্তু কমপিউটার জগৎ-এর সম্পাদক হিসেবে তার সাথে কাজ করতে গিয়ে তার সম্পর্কে এই লেখকের নির্মোহ এক উপলব্ধির বহির্প্রকাশও ঘটেছিল। আমার নির্মোহ উপলব্ধিসূত্রে আমি সেই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটিতে তার সম্পর্র্কে যে উপসংহার টানতে পেরেলিাম তা হচ্ছেÑ ‘সত্যিই অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাদের একজন ব্যক্তিমাত্র নন, একটি প্রতিষ্ঠান। একটি ইনস্টিটিউশন। এ ইনস্টিটিউশন কাজ করে গেছেন একটি মাত্র লক্ষ্য নিয়ে; এ জাতিকে সব মহলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।’
তাকে হারানোর ১৪ বছর পর আজ যখন তার চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করতে যাচ্ছি, তখন মনে হচ্ছে তার সম্পর্কে আমার এই মূল্যায়ন ছিল যথার্থ। কারণ, তার মতো সহজাত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষ সমাজে খুবই বিরল। তাকে ‘সহজাত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করছি যথার্থ কারণেই। আমরা তাকে অনেকেই জানি ও চিনি কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। আজ থেকে দুই যুগেরও বেশি সময় আগে তথ্যপ্রযুক্তির মতো একটি কাঠখোট্টা বিষয়ে বাংলাভাষায় একটি সাময়িকী প্রকাশের মতো দুঃসাহসিক কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন যে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে, সেটি ছিল তার তথ্যপ্রযুক্তি প্রেমের ভিত। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, অধ্যাপক আবদুল কাদের ১৯৬৪ সালে যখন মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণীর এক স্কুলবালক, তখন নিজে সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে তার আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ‘টরেটক্কা’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পত্রিকাটির কয়েকটি সংখ্যা বের হওয়ার পর অর্থাভাবে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতটা সচ্ছল ছিল না যে, একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশের ঘাটতি-ব্যয় বহন করে এর প্রকাশনা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। আর সেই সময়টাও ছিল বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক, যখন প্রকাশনার কাজ আজকের মতো এতটা সহজ ছিল না। অসচ্ছল পরিবারের একজন স্কুলবালক বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশে হাত দিতে তাকে তাড়িত করেছিল বিজ্ঞানের প্রতি তার সহজাত প্রেম ছাড়া আর কিছুই নয়। সে জন্যই তাকে ‘সহজাত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করার মাঝে দোষের কিছু নেই বলে মনে করি। সম্ভবত তিনি ‘টরেটক্কা’ পত্রিকাটি প্রথম সংখ্যা বের করে সেটি এ দেশের আরেক বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষ ড. মুহম্মদ ইব্রাহিমের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ড. মুহম্মদ ইব্রাহিমের কোনো এক লেখা পড়ে জানতে পেরেছিলাম, তিনি তখন স্কুলবালক আবদুল কাদেরের এই সাহসের ভ‚য়সী প্রশংসা করেছিলেন এবং তাকে এ কাজে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তবে বাস্তবতা তাকে সেই ‘টরেটক্কা’র প্রকাশনা কমপিউটার জগৎ-এর মতো অব্যাহত রাখতে দেয়নি। এর বহু পড়ে লেখাপড়া শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে ১৯৯১ সালে তিনি কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার সূচনা করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, তাই তিনি আইনগতভাবে কমপিউটারের জগৎ-এর সম্পাদক বা প্রকাশক ছিলেন না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন এর প্রাণপুরুষ। তার সঠিক নেতৃত্বে কমপিউটার জগৎ যেমন হতে পেরেছে এ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত তথ্যপ্রযুক্তি সাময়িকী, পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা তেমনি এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি অধ্যাপক আবদুল কাদেরের সহজাত প্রেমের ভিত।
কমপিউটার জগৎ-এর যারা নিয়মিত পাঠক, তারা নিশ্চয় এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে তার অবদানের কথা জানেন। তিনি এ ক্ষেত্রে নির্মোহভাবে কাজ করে অনন্য সাধারণ অবদান রেখে গেছেন কমপিউটার জগৎ-কে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে। কারণ, তার সচেতন উপলব্ধি ছিল একটি পত্রিকাও হতে পারে আন্দোলনের মোক্ষম এক হাতিয়ার, যদি তা হয় সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমুখিন। কমপিউটার জগৎ-এর পাঠকমাত্রই জানেন, অধ্যাপক কাদের সেই সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই কমপিউটা জগৎ প্রকাশে মাঠে নেমেছিলেন। তাই তিনি কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের মাধ্যমে জাতিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’। এর মাধ্যমে তিনি সুস্পষ্টভাবে একটি কথা সেদিন জাতিকে জানাতে চেয়েছেন, জনগণকে তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত করতে পারলেই শুধু আমাদের মতো সব দিক থেকে পিছিয়ে থাকা জাতিকে সমৃৃদ্ধ এক জাতিতে পরিণত করা সম্ভর। দুই যুগেরও বেশি সময়ের কমপিউটার জগৎ-এর প্রয়াস ছিল সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। আগামী দিনেও অধ্যাপক আবদুল কাদেরের রেখে যাওয়া পথরেখা ধরেই আমরা আমাদের পথচলা অব্যাহত রাখব।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে মরহুম অধ্যাপক আবদুল কাদের অনেকটাই অচেনা। কারণ, তার ইন্তেকালের পর এরই মধ্যে ১৪টি বছর পেরিয়ে গেছে। জাতি হিসেবে তার জীবন ও কর্ম তুলে ধরার ক্ষেত্রে আছে আমাদের সীমাহীন ব্যর্থতা। আজও তাকে প্রদান করতে পারিনি জাতীয় কোনো পুরস্কার। এভাবে চললে হয়তো এই অনন্যসাধারণ মানুষটিকে একদিন আমরা ভুলে যাব। সে যাই হোক, তরুণ প্রজন্মের কাছে তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলার তাগিদ এখানে অনুভব করছি।
অধ্যাপক মো: আবদুল কাদেরের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। মৃত্যু ২০০৩ সালের ৩ জুলাই। বাবা মরহুম আবদুস সালাম ছিলেন ঢাকার লালবাগের নওয়াবগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা। ১৯৬৪ সালে ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৬৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানে এমএসসি পাস করেন যথাক্রমে ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালে। তিনি জীবনে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন। এসব কর্মসূচির বাইরে তিনি নিয়েছেন কমপিউটারবিষয়ক ২০টি অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামের ওপর প্রশিক্ষণ। শিখেছিলেন বেশ কয়েকটি প্রোগামিং ল্যাঙ্গুয়েজও।
কর্মজীবনে প্রবেশ ১৯৭২ সালে, ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রভাষক হিসেবে। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অল্প কিছুদিন ছিলেন পটুয়াখালী কলেছে। সেখান থেকে তাকে নবায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-পরিচালক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের কমপিউটার সেলের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়। এরপর তিনি সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে তার অবসর নেয়ার কথা ছিল। স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি জীবনে বেশকিছু অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি সরকারি নির্দেশে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের কমপিউটারবিষয়ক বেশ কয়েকটি কমিটিতে সদস্য ছিলেন। তিনি লেখালেখির সাথেও জড়িত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, মালয়েশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ সফর করেন। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তার অসাধারণ অবদানক্ষেত্র হচ্ছে কমপিউটার জগৎকেন্দ্রিক তার বিশাল কর্মকান্ড।
তার অবদান আমাদের তরুণ প্রজন্ম যত বেশি করে জানবে, ততই তার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার দুয়ার তাদের সামনে খুলে যাবে। সে দুয়ার খোলার পদক্ষেপ নেয়ায় সরকারের ভ‚মিকা আছে বৈকি