বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গত ১৫ নভেম্বর বয়ে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর৷ সিডর কেড়ে নিলো প্রায় চার হাজারেরও বেশি প্রাণ৷ আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক৷ এখনো এর পরিমাণ নির্ধারণের অপেক্ষায়৷ তবে ক্ষতিটা যে কয়েক হাজার কোটি টাকার তা বলাই বাহুল্য৷ আমরা কথায় কথায় তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে বড়াই করি৷ কিন্তু প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে ও আমরা দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারলাম না৷ মানুষ অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখলো ঘূর্ণিঝড়ের তা-ব৷ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কয়েক কোটি মানুষ প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে আছে৷ প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা এক্ষেত্রে কী কী করতে পারতাম, কিভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো কমিয়ে আনতে পারতাম যেসব বিষয় নিয়ে আমাদের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখেছেন মর্তুজা আশীষ আহমেদ ৷
সিডর হচ্ছে সিংহলি শব্দ, যার অর্থ চোখ৷ এমন নাম দেয়ার কারণ, এই হারিকেনটির কেন্দ্রীয় অংশ দেখতে অনেকটা চোখের মতো৷ ধারণা করা হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়৷ কিন্তু সে তুলনায় জীবনের ক্ষয়ক্ষতির হার বেশ কম৷ বেশ কম এই অর্থে যে ১৯৭০ সালে ও ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সিডর থেকে কম শক্তিশালী দুটি ঘূর্ণিঝরে আঘাতে যথাক্রমে প্রায় ৩ লাখ ও ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, উন্নত বিশ্বে এর চেয়েও শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগেও হতাহতের পরিমাণ অনেক কম হয়ে থাকে৷ এটি সম্ভব হয় উন্নত প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগের কল্যাণে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে প্রযুক্তির একটি বিভাগ আছে, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কিভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম রেখে দুর্যোগ মোকাবেলা করা যায় সেটি নিয়ে গবেষণা করা হয়৷ বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সবারই আরো সচেতন হতে হবে৷ তাহলে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম রেখে দুর্যোগ মোকাবেলা করা যেত৷ আমরা দেখবো, উন্নত বিশ্বে কিভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা করা হয়৷
কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি
বিশ্বের অনেক দেশই এখন দুর্যোগের প্রাথমিক লক্ষণ অনুসন্ধানের জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে৷ এটি বেশ আগের প্রযুক্তি৷ বাংলাদেশও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ দুর্যোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সংগ্রহ করে থাকে৷ বাংলাদেশ ১৯৮০ সাল থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে৷ বাংলাদেশ দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে ছবি সংগ্রহ করে থাকে৷ এই উপগ্রহ দুটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নোয়া এবং এফওয়াইটুসি৷ ১৯৮০ সারে পর থেকে বাংলাদেশ শুধু নোয়া থেকে প্রতিদিন দুটি করে ছবি সংগ্রহ করতো৷ এই ছবি থেকেই নির্ণয় করা হতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের খবরাখবর৷ এফওয়াইটুসি ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরাখবর নির্ণয় করা অনেক সহজ হয়ে গেছে৷ এফওয়াইটুসি একটি আবহাওয়াবিষয়ক কৃত্রিম উপগ্রহ৷ ধারণা করা হচ্ছে, এফওয়াইটুসি ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে বলেই এবারের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এই কৃত্রিম উপগ্রহপ্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ব্যবহৃত প্রযুক্তি৷
কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তির অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে৷ এমন অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ আছে, যেগুলো এফওয়াইটুসির মতো নয়৷ এফওয়াইটুসি আলোর প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে ছবি তৈরি করে৷ কিন্তু এ ধরনের ছবি তোলার ক্ষেত্রে একমাত্র সমস্যা হলো আলো, স্বল্প আলো বা মেঘলা আকাশে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো ছবি তুলতে পারে না৷ এই ছবি তোলার প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন হয়েছে৷ আলোর সাহায্য ছাড়াই মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমেও ছবি তোলা যায়৷ সেক্ষেত্রে আলো কোনো সমস্যা নয়৷ এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর জন্য মাটিতে আলাদা মাইক্রোওয়েভ বেইজ স্টেশন থাকতে হয়৷ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ট্রান্সমিট করা মাইক্রোওয়েভ কৃত্রিম উপগ্রহে প্রতিফলিত হবার ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ছবি তৈরি করা হয়৷ এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ কিছুটা ব্যয়বহুল৷ পৃথিবীর অনেক দেশই এখন এ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে দুর্যোগের পূর্বাভাসসহকারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করে৷
তথ্যভিত্তিক ওয়েব প্রযুক্তি
ইন্টারনেটের মাধ্যমেও এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ এখনকার সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলো প্রতিনিয়ত নিজেদের সংবাদ-তথ্য হালনাগাদ করে থাকে৷ এই হালনাগাদ করা শুধু যে সংবাদভিত্তিক তা নয়৷ এগুলো যথাযথ চিত্রভিত্তিক৷ যেমন বিবিসি, সিএনএন, এপি, এএফপি প্রভৃতি সাইটগুলো দুর্যোগের চিত্রভিত্তিক সংবাদ প্রচার করেছে৷ সংবাদভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন অত্যাধুনিক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে৷ তাছাড়াও চিত্রভিত্তিক বিভিন্ন সাইট সাম্প্রতিক আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট ছবি প্রকাশ করে থাকে৷ যেমন নাসা-র আর্থ অবজারভেটরি, ইয়াহু ইমেজ প্রভৃতি৷ তাছাড়াও আবহাওয়াভিত্তিক অনেক ওয়েবসাইট আছে, যেগুলো থেকে খবরাখবর নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ কিছু কিছু ওয়েবসাইট আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট ভিডিও প্রকাশ করে থাকে৷ যেমন- ইউটিউব৷ এই সাইটগুলোতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় সিডরের বিভিন্ন তথ্য ও ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে৷ সুতরাং ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ ওয়েব সাইট : www.youtube.com, www.afp. com, www.ap.org, news.bbc.co.uk/1/ hi/world/asia-pacific/default.stm
সফটওয়্যার প্রযুক্তি
তথ্যপ্রযুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে সফটওয়্যারের বিপ্লব৷ সফটওয়্যারের মাধ্যমেও এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ আজ গুগল আর্থ-এর কথা আমরা সবাই জানি৷ এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ছবি দেখা বা তোলা সম্ভব৷ এধরনের ইন্টারনেটভিত্তিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে আগে থেকেই দুর্যোগের বিভিন্ন ছবি পাওয়া সম্ভব৷ বাংলাদেশে সিডর আঘাত হানার আগেই গত ১৪ নভেম্বর থেকেই গুগল আর্থে ঘূর্ণিঝড়ের ছবি দেখা গেছে৷ গুগল আর্থ নিয়মিতই হালনাগাদ তথ্য পরিবেশন করে থাকে৷ দুর্যোগের আগে ও পরে এমন সফটওয়্যারের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্ভব৷ ওয়েব সাইট earth.google.com
স্যাটেলাইট ফোন প্রযুক্তি
এমনি আরেকটি প্রযুক্তি হলো স্যাটেলাইট ফোন৷ স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে আজকাল উন্নত বিশ্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে৷ আমাদের দেশে এখনো স্যাটেলাইট ফোন পরিচিত নয়৷ আশা করা যায় স্যাটেলাইট ফোনের ব্যবস্থা করা গেলে এরকম বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো কম হবে৷ স্যাটেলাইট ফোন বা স্যাটফোন অনেকটা মোবাইল ফোনের মতোই টেলিফোন সিস্টেম৷ পার্থক্য হলো এটি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় স্যাটেলাইটকে৷ যোগাযোগের জন্য তৈরি করা বিশেষ স্যাটেলাইটের সাহায্যে স্যাটফোন কাজ করে৷ মোবাইল ফোনের সাথে এর মূল পার্থক্য হলো, মোবাইল ফোন কাজ করে কাছাকাছি থাকা বেইজ স্টেশনের মাধ্যমে৷ আর স্যাটফোনের ক্ষেত্রে বেইজ স্টেশনের বদলে সরাসরি স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়৷ এর ফলে মোবাইল ফোনের চেয়ে সুবিধা অনেক বেশি পাওয়া যায়৷ এই সুবিধাগুলো হলো নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সুবিধা ও এর কভারেজ অঞ্চল অনেক বেশি৷ সেই সাথে নেটওয়ার্ক ডাউন হবার প্রবণতাও কমে যায়৷ আমরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করি বলে এর বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা জানি৷ নেটওয়ার্ক না থাকলে বা নেটওয়ার্কে ঝামেলা দেখা দিলে এই ফোন হয়ে ওঠে এক অসহ্য যন্ত্রণাময় জড়বস্তু৷ সাম্প্রতিক দুর্যোগ সিডরের কথাই ধরুন, এ দুর্যোগের সময় বাংলাদেশের কোনো মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে সার্ভিস দিতে পারেনি৷ বস্তুত এর ফলে ক্ষয়ক্ষতি আরো বেড়েছে৷ মোবাইল ফোন সক্রিয় থাকলে ক্ষতির পরিমাণ হয়ত আরো কম হতে পারত৷ আমরা এটাও দেখেছি, শুরুতে মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে কতটা বেগ পেতে হয়েছে৷ স্যাটফোন এখনো অনেক ব্যয়বহুল৷ কিন্তু স্যাটফোনের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে এতটা বেগ পেতে হতো না৷ মাত্র একটি স্যাটেলাইটেই অর্ধেক পৃথিবী কভার করা সম্ভব৷ সিডরের তা-বের ফলে মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচুর নেটওয়ার্ক টাওয়ার পড়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ স্যাটফোনের ক্ষেত্রে এমনটি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ কারণ, এটি নিজেদের নেটওয়ার্ক ট্রান্সমিট করে মহাকাশ থেকে৷ স্যাটফোনের সমস্যা একটাই, খরচ অনেক বেশি৷ স্যাটফোনের ব্যবহারকারীর যন্ত্রাংশকে (ইউজার এন্ড ডিভাইস) আর্থ স্টেশন বা টার্মিনাল বলে৷ এই টার্মিনালগুলো বেশ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হয়৷ এগুলোর ট্রান্সমিটিং ও রিসিভিং ক্ষমতা অন্যান্য যেকোনো ধরনের ফোনের চেয়ে বেশি৷ তবে ট্রান্সমিটিং ও রিসিভিং অনেক দূর থেকে হয় বলে অনেক সময়ই বহুতল ভবনগুলোর নিচের সারির ফ্লোরগুলোতে নেটওয়ার্ক নিয়ে কিছুটা সমস্যা হতে পারে৷ এজন্য স্যাটফোনের নির্মাতারাও বলে দেন, মহাকাশ অভিমুখে থাকা অবস্থায় এর পারফরমেন্স সবচেয়ে ভালো পাওয়া যাবে৷ স্যাটফোনের এটি একটি সীমাবদ্ধতা৷ আরো কিছু সীমাবদ্ধতা আছে স্যাটফোনের৷ যেকোনো ফোন সিস্টেমে আমরা খুব সহজেই যেভাবে কথা বলতে পারি, স্যাটফোনে ততটা সাবলীলভাবে কথা বলা সম্ভব নয়৷ অনেক দূর থেকে ট্রান্সমিটিং ও রিসিভিং হয় বলে কথা কিছুটা দেরিতে শোনা যায়৷ তবে জরুরি প্রয়োজন যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এটি কোনো সমস্যা নয়৷ অবশ্য প্রযুক্তির উত্কর্ষে এই সমস্যা এখন অনেকটাই দূর হয়ে গেছে৷
স্যাটেলাইট ফোন কাজ করে অনেকটা মোবাইল ফোনের মতো করেই৷ একটি স্যাটফোন ডিভাইস কল করার সময় নিকটবর্তী স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে৷ স্যাটেলাইট এখানে তথ্যকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে৷ স্যাটেলাইট এর পরে খুঁ জে বের করে সেই ব্যবহারকারীর অবস্থান যাকে কল করা হয়েছে৷ এরপরে সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কলকারী এবং কল গ্রহণকারী উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়৷
স্যাটফোন স্যাটেলাইটনির্ভর হওয়াতে এর ধরনও একটু আলাদা৷ আলাদা বলতে নির্দিষ্ট স্যাটেলাইটের ওপর ভিত্তি করে স্যাটফোন কাজ করে৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোন দেশের কোড অনুযায়ী পরিচালনা করা হয়৷ দেশের অভ্যন্তরে হলে সেক্ষেত্রেও আলাদা আলাদা কোড আছে৷ স্যাটেলাইট ফোনের ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যাপার নেই৷ যেমন- ইনমারস্যাট, ইরিডিয়াম, গ্লোবাল স্টার প্রভৃতি স্যাটেলাইটের নামানুসারে স্যাটফোনগুলোও পরিচিত৷ ইনমারস্যাট স্যাটফোনের ডায়াল করার কোড হচ্ছে +৮৭০, +৮৭১, +৮৭২, +৮৭৩ ও + ৮৭৪৷ ইরিডিয়াম স্যাটফোনের ডায়ালিং কোড হচ্ছে +৮৮১৬ ও +৮৭১৭৷ অনেক স্যাটফোন আবার সাধারণ ডায়ালিং কোডের মাধ্যমে কাজ করে৷ এরকম একটি স্যাটফোন হচ্ছে গ্লোবাল স্টার স্যাটফোন৷
এবার স্যাটফোন হ্যান্ডসেটের খরচাপাতির কথায় আসা যাক৷ পুরনো মডেলের থুরায়া, ইরিডিয়াম এবং গ্লোবাল স্টার স্যাটফোন হ্যান্ডসেটের দাম প্রায় ২০০ ইউএস ডলার৷ আর নতুন মডেলের হ্যান্ডসেটের দাম প্রায় ১০০০ ইউএস ডলার৷ তাছাড়াও প্রতিটি কলে গড়ে প্রতি মিনিটে ৩ থেকে ১৫ ইউএস ডলার খরচ হয়৷ তবে আশার কথা, দিন দিন স্যাটফোনের খরচ কমে আসছে৷ অদূর ভবিষ্যতে এটি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই চলে আসবে বলে ধারণা করা যায়৷
হ্যাম রেডিও প্রযুক্তি
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে রেডিও৷ রেডিওর মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে সাবধান করা যায়, অন্য কোনো মাধ্যমে এতো সহজে সাবধান করা যায় না৷ রেডিও সাধারণত তিন ধরনের৷ এগুলো হচ্ছে- অ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও, সিটিজেন রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও৷ বাংলাদেশের জন্য রেডিও ব্যবস্থা সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম৷ কারণ, এর খরচ সবচেয়ে কম৷ এবারে দেখা যাক, কোন ধরনের রেডিওর সুবিধা-অসুবিধা কী৷ অ্যামেচার রেডিও সাধারণত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে৷ এই রেডিও যেকেউ ব্যবহার করতে পারে৷ বিভিন্ন মেসেজ বা তথ্য আদান-প্রদানে অ্যামেচার রেডিও বেশ কার্যকর৷ পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ অ্যামেচার রেডিও ব্যবহার করছে বা এর সাথে কোনোভাবে জড়িত আছে৷ অ্যামেচার রেডিও কখনই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় না৷ সারা বিশ্বে অ্যামেচার রেডিও মানুষ একান্ত প্রয়োজনে বা শখের বশে অথবা গবেষণায় ব্যবহার করে থাকে৷ অ্যামেচার রেডিওর প্রথম প্রচলন ঊনবিংশ শতাব্দীতে৷ বর্তমানে যে ধরনের অ্যামেচার রেডিও ব্যবহার করা হয়, তার প্রথম উত্পত্তি ১৯২০ সালে৷ এই ধরনের রেডিও এখনো বিভিন্ন গবেষক এবং শৌখিন জনেরাই ব্যবহার করে থাকেন৷ অ্যামেচার রেডিওর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি গবেষণায়, শিল্পে, প্রকৌশলে এবং সামাজিক বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা হয়েছে৷ জীবন রক্ষাকারী রেডিও হিসেবে অ্যামেচার রেডিও বহুবার আবির্ভূত হয়েছে৷ এ ধরনের রেডিও বিভিন্ন উপায়ে ট্রান্সমিশন ও রিসিভিং সম্পন্ন করে থাকে৷ ট্রান্সমিশন ও রিসিভিংয়ে একেক প্রয়োজনে একেক রেডিও ব্যান্ড ব্যবহার করে থাকে৷ এটি এফএম বা সিঙ্গেল সাইডব্যান্ড ব্যবহার করে ট্রান্সমিশন ও রিসিভিং সম্পন্ন করে থাকে৷ তথ্য আদান-প্রদানে অ্যামেচার রেডিও সোর্স কোডও ব্যবহার করে থাকে৷ আমাদের দেশে বিভিন্ন দুর্যোগে সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি হয় যোগাযোগের মাধ্যম ক্ষতিগস্ত হবার কারণে৷ অ্যামেচার রেডিও সেক্ষেত্রে একটি ভালো যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে৷ এর খরচ কম বলে এটি স্থাপন করা যায় সহজেই৷ থানা বা ইউনিয়ন পরিষদ লেভেলে বেশ সহজেই আমরা অ্যামেচার রেডিও ব্যবহার করতে পারি৷
সিটিজেন রেডিও প্রযুক্তি
আরেক ধরনের রেডিও হচ্ছে সিটিজেন রেডিও৷ উন্নত বিশ্বে সিটিজেন রেডিও স্বল্প দূরত্বের রেডিও হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত৷ এর আরেক নাম হচ্ছে সিবি রেডিও৷ এটি এক ধরনের টু-ওয়ে সিমপ্লেক্স রেডিও৷ অনেকটা ওয়াকিটকির মতো৷ এ ধরনের রেডিওর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর কোনো লাইসেন্স লাগে না৷ এই রেডিও যেকেউ ব্যবহার করতে পারে৷ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও এই রেডিও ব্যবহার করা যেতে পারে৷ অবশ্য আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানই সিটিজেন রেডিও ব্যবহার করছে৷ এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে বিআরটিসিসহ দেশের প্রাইভেট অনেক বাস কোম্পানিই এই রেডিও ব্যবহার করছে৷ ১৯৪৫ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই রেডিও চালু আছে৷ এই রেডিও চলে সাধারণত ইউএইচএফ ৪৬০ থেকে ৪৭০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি সীমা পর্যন্ত৷ সিবি রেডিও অনেক ধরনের হয়৷ এগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে৷ বিভিন্ন শ্রেণীর রেডিও আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে৷ এগুলো শ্রেণী এ, শ্রেণী বি প্রভৃতি নামে পরিচিত৷ এই রেডিওগুলো ব্যান্ড হিসেবে বেছে নেয় এএম, এফএম, ও এসএসবিআই, অবশ্য দেশভেদে ব্যান্ড ও ফ্রিকোয়েন্সিরও ভেদাভেদ আছে৷ উন্নত বিশ্বের যানবাহনের ড্রাইভাররা যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় সিটিজেন রেডিও৷ যুক্তরাষ্ট্রে হাইওয়েতেও এই রেডিও ব্যবহার করা হয়৷ এই রেডিওর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এটি ছোট, বহনযোগ্য ও খুব কম পাওয়ারেও চলে৷ আগেই বলা হয়েছে, খুব কম দূরত্বে কাজ করার জন্য এই রেডিও আদর্শ মানের৷ এর সর্বোচ্চ আউটপুট হচ্ছে ১২ ওয়াট৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এই রেডিও বেশ কাজের৷
কমিউনিটি রেডিও প্রযুক্তি
কমিউনিটি রেডিও অনেকটা আমাদের সাধারণ ব্যবহারের রেডিওর মতো৷ কিন্তু এর ক্ষমতা খুব কম৷ কমিউনিটি রেডিওর একটি ট্রান্সমিশন সেন্টার থাকবে, যার কাজ হবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, খবরাখবর, বাণী ইত্যাদি প্রচার করা৷ স্থানীয় রেডিও হিসেবে এটি বেশ কার্যকর৷ আমাদের পাশের দেশ ভারতেও এখন ব্যাপকহারে কমিউনিটি রেডিও ব্যবহার হচ্ছে৷ এর সুবিধা হলো, এর ট্রান্সমিশন সেন্টারের খরচ অন্যান্য রেডিও ট্রান্সমিশন সেন্টারের তুলনায় অনেক কম৷ এটি ব্যাটারিতেও চালানো যায়৷ আমাদের দেশের জন্য এই রেডিও সবচেয়ে কার্যকর৷ দুর্যোগের কবলে এর ট্রান্সমিশন সেন্টার পড়লেও এর ব্যাটারি ও ট্রান্সমিটার নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া যায়৷
তারপর নিরাপদ স্থান থেকে আবার এর সম্প্রচার করা সম্ভব৷ অনেকটা মোবাইল রেডিও সেন্টারের মতো এর ট্রান্সমিশন সম্ভব৷ কমিউনিটি রেডিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী৷ কারণ এর খরচ কম, বহনযোগ্য৷ দুর্যোগ চলাকালীন সময়ে এই রেডিওর পুরো ইউনিটসহকারে নিকটবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া সম্ভব৷ সেই নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাকালীন সময়ে সম্প্রচার করার প্রয়োজন হলে এই রেডিওর অ্যান্টেনা কোনো উঁচু স্থানে এমনকি বাঁ শের মাথায় লাগিয়ে দুর্যোগের সময়েও সম্প্রচার করা যেতে পারে৷ মাসিক কমপিউটার জগত্-এর অক্টোবর ২০০৬ সংখ্যায় কমিউনিটিরেডিও ও তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলন শীর্ষক একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা হেছিল৷ সেখানে এর বিস্তারিত বিবরণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়েছিল৷
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- জনসংখ্যা সমস্যা৷ অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে সুষ্ঠুভাবে যেকোনো ব্যবস্থাপনাই এদেশে দুষ্কর৷ তাই দুর্যোগে প্রাণহানিও অনেক বেশি হয়৷ তাই মানুষের মৃত্যুহার ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রযুক্তিরও বড় ভূমিকা রাখতে হবে৷ অন্যান্য প্রযুক্তির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিকেও কাজে লাগাতে হবে৷ তবেই সম্ভব সঠিকভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা৷
দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় প্রথমেই আক্রান্ত এলাকা বিদ্যুত্, টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ বাংলাদেশে এই বিদ্যুত্ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে নতুন করে সংযোগ স্থাপনের সুব্যবস্থা নেই৷ আর এ সেবাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেই ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়৷ এবারের দুর্যোগে আমাদের দুর্যোগ আক্রান্ত অঞ্চলের বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ থেকে শুরু করে আমাদের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বিশেষ করে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক দুর্যোগপরবর্তী সময়ে কোনো সেবাই দিতে পারেনি৷ যুক্তরাষ্ট্রে যখন ক্যাটরিনা আঘাত হানলো, তখন এদের আধুনিক প্রযুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবার ফলে এরা আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি পুরনো প্রযুক্তিও ব্যবহার করেছে৷ পুরনো আমলের টেলিগ্রাফ প্রযুক্তিও এরা ব্যবহার করেছে৷ আমাদেরও শিক্ষা নিতে হবে দুর্যোগ থেকে, যাতে করে এরকম সব ধরনের প্রযুক্তির সম্মেলন ঘটানো যায়৷ তাহলে ক্ষয়ক্ষতির হার অনেকাংশে কমানো সম্ভব৷ বাংলাদেশ যেহেতু দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল তাই আমাদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে করে সঠিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির হার সবচেয়ে কম হয় সেদিকে৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তিনটি পর্যায় আছে৷ এগুলো হচ্ছে- দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগের সময় ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা৷ দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা বলতে দুর্যোগের পূর্ববর্তী সময়ের ব্যবস্থাপনাকে বুঝায়৷ অর্থাত্ আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে দুর্যোগের খবর ও দুর্যোগের প্রকৃতি জেনে সম্ভাব্য ক্ষয় ক্ষতির যতটুকু কম করা যায় সেই চেষ্টা করা৷ আমাদের দেশে কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় বলে দুর্যোগ নিরূপণ করা যায়৷ ভেবে দেখুন এই প্রযুক্তিও যদি না থাকতো তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতো বেশি হতো তা ভাবাই দুষ্কর৷ এই কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তিও কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিরই অবদান৷ ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা৷ আর মানুষকে সচেতন করার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হতে পারে রেডিও, টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি মাধ্যম৷ উন্নত বিশ্বে সংবাপত্র ও টেলিভিশন মিডিয়া সাধারণত এক্ষেত্রে বেশ ভালো ভূমিকা রাখে৷ কিন্তু আমাদের দেশে এই খাতে এখনো বেশ সমস্যা আছে৷ আমাদের দেশে সংবাদপত্রগুলোর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই৷ কিন্তু দেশের শিক্ষিতের হার বেশ কম হওয়াতে এবং মানুষের অনীহার কারণে সংবাদপত্র পাঠ করার কালচার তেমন একটা নেই৷ শহরগুলোতে মোটামুটি এই কালচার থাকলেও গ্রাম-গঞ্জের অবস্থা খুবই খারাপ৷ ক্ষয়ক্ষতির হার কমাতে হলে অবিলম্বে এই অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে৷ আর আমাদের টেলিভিশন মিডিয়া এক্ষেত্রে তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারে না৷ দুর্যোগ শুরু হবার আগেই রেডিও ও টেলিভিশন মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার চালানোর প্রয়োজন আছে৷ ব্যাপক প্রচার চালানো গেলে মানুষের মধ্যে গুজব ও ভ্রান্ত ধারণার অবকাশ অনেক কমে যাবে৷ তাছাড়া আমাদের দেশের দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের মানুষেরা বেশ সাহসী৷ ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস নিয়ে তাদের অবজ্ঞাও কম নয়৷ ক্ষয়ক্ষতির হার বাড়ে সাধারণত এসব মানুষের অবজ্ঞার কারণেও৷ রেডিও-টেলিভিশন মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার চালানো গেলে মানুষের অবজ্ঞার পরিমাণও কমে যাবে৷ এজন্য প্রতি ১৫ মিনিট পরপর বা নিয়মিত প্রচারের প্রয়োজন আছে, যা আমাদের দেশে করা হয় না৷ দুর্যোগ মোকাবেলার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সবাইকে সচেতন রাখা, যা মিডিয়ার কাজ৷ দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখতে পারে এমন সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি৷ প্রশ্ন জাগতে পারে, আমাদের দেশে এ ধরনের কাজে তথ্যপ্রযুক্তি অবহেলিত কেন? তথ্যপ্রযুক্তি অবহেলিত থাকার অনেক কারণ রয়েছে৷ অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা খুব রিলায়েবল নয়৷ কয়েকদিন পরপর আমাদের সাবমেরিন ক্যাবল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ তখন ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবার পাশাপাশি পুরো দেশ বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগবিহীন থাকে৷ তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে আমাদের সবার আগে প্রয়োজন একটি রিলায়েবল ইন্টারনেট সংযোগ৷ কিন্তু আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাও অতটা নির্ভরযোগ্য নয়৷ তাই বর্তমান যুগে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির অনন্য অবদান ইন্টারনেটকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগাতে হবে৷ সেইসাথে তথ্যপ্রযুক্তির আরেকটি অবদান রেডিও কমিউনিকেশন ব্যবস্থাকে ভুলে গেলে চলবে না৷ কারণ, রেডিও কমিউনিকেশন হচ্ছে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম৷ বলা দরকার, দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ রেডিও ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কমিউনিটি রেডিওর ব্যাপক প্রসার৷ এজন্য কমিউনিটি রেডিওর পাশাপাশি হ্যাম রেডিও এবং সিটিজেন রেডিওর প্রচলন ঘটাতে হবে৷ সেইসাথে আমাদের প্রচলিত রেডিও এবং এফএম রেডিওর যুগোপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷ এভাবেই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে৷ এভাবে ভালো দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে আশা করা যায় সঠিকভাবে দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা সম্ভব হবে৷ তাহলেই আমরা ক্ষয়ক্ষতির হার অনেক কমিয়ে আনতে পারবো৷
দুর্যোগকালীন ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পালন৷ ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানার আগেই স্থানীয় মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হবে৷ আগেই বলেছি, আমাদের যথেষ্ট সাইক্লোন শেল্টার নেই৷ আমাদের সকলেরই এ ব্যাপারে নজর দেয়া উচিত৷ আমাদের দেশে কোনো মাধ্যমই খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয় বলে ধরেই নিতে হবে দুর্যোগের সময় মাধ্যমগুলো কাজ করবে না৷ সাধারণত দুর্যোগের সময় সবার আগে লাইফলাইন এসেনশিয়াল বিচ্ছিন্ন হয়৷ লাইফলাইন এসেনশিয়াল বিচ্ছিন্ন হলে বেশিরভাগ মাধ্যম কাজ করবে না৷ তথ্যপ্রযুক্তি এর ব্যতিক্রম নয়৷ লাইফলাইন এসেনশিয়াল বিচ্ছিন্ন হলেও একটা মাধ্যম কাজ করতে পারে, সেটি হলো রেডিও৷ আর রেডিওর মধ্যে সবচেয়ে উপযোগী হলো কমিউনিটি রেডিও৷ আর কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচার বা রেডিও ব্যবস্থাপনায় মনে রাখতে হবে সেটি যেন সম্প্রচারিত হয় অঞ্চলভেদে আঞ্চলিক ভাষায়৷ তা না হলে সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে উপকৃত হবে না৷ কমিউনিটি রেডিও চালু থাকলে দুর্যোগ শুরু হবার আগেই এর ব্যাটারি ও ট্রান্সমিটার নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে৷ প্রয়োজনে সাইক্লোন শেল্টার থেকেও যেন রেডিওর সম্প্রচার চালু রাখা যায়, সে বিষয়ে সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে৷ আর দুর্যোগ চলার সময়ে যদি ইন্টারনেট চালু থাকে, তাহলে সর্বশেষ খবরাখবর সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাহলে দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিতরণ সহজ ও সময়োপযোগী হবে৷ দুর্যোগ সময়ে বিভিন্ন ইউনিট প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে করে দুর্যোগ শেষ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিডিয়াগুলোর ক্ষতি পরীক্ষা করে দ্রুত যোগাযোগ মাধ্যম আবার সচল করা যায়৷ মনে রাখতে হবে, যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর ভিত্তি করেই দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে৷ তাই দুর্যোগ সময়ের ব্যবস্থাপনাকে মোটেও হেলাফেলা করা উচিত নয়৷
দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা বলতে দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যোগাযোগ মাধ্যমকে পুনরায় সচল করা, ত্রাণ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাকে বুঝায়৷ এটি অনেকাংশে নির্ভর করে দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগসময়ের ব্যবস্থাপনার উপরে৷ দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনায় টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট ও রেডিওর ভূমিকা অসীম৷ বিশেষ করে কমিউনিটি রেডিওর কথা আবারো বলতে হচ্ছে৷ দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনায় যেমন স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করার সুযোগ আছে তেমনি দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনাতেও কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করা যায়৷ দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রথমাংশেই যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো ক্ষতিগ্রস্ত টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, রেডিও ব্যবস্থা পুনরায় সচল করা৷ যদি লাইফলাইন এসেনশিয়ালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে সেগুলোও সচল করতে হবে৷ এরপরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন করতে হবে৷ তাদের সহযোগিতায় প্রয়োজনে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে হবে৷ আর হাসপাতালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে চিকিত্সা প্রয়োজন এমন মানুষদের জন্য দূরবর্তী হাসপাতালে নেয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে৷
আমাদের করণীয়
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল৷ পরিবেশ দূষণসহ নানা কারণে বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে৷ তাই দিনে দিনে এদেশের দুর্যোগপ্রবণতা বাড়ছে৷ আমাদেরকেও এর সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে৷ তা না হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই যাবে৷ এমনিতেই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি ভালো নয়৷ তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে, কত কম খরচে অধিক সুরক্ষা পাওয়া যায়৷ এজন্য অবিলম্বে এদেশে কমিউনিটি রেডিও কার্যকর করতে হবে৷ আমাদের আবহাওয়া ও দুর্যোগ প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ আমাদের দুর্যোগের সিগন্যালিং ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে হবে৷ সিগন্যালিং ব্যবস্থা বন্দরভিত্তিক না করে অঞ্চলভিত্তিক করতে হবে৷ আমরা সবাই জানি, আমাদের ৮, ৯ এবং ১০ নম্বর বিপদসঙ্কেত মোটামুটি একই অর্থ বহন করে৷ সেইসাথে দুর্যোগের প্রকৃতি নির্ণয় করেই দুর্যোগের সঙ্কেত দিতে হবে৷ তা না হলে মানুষের মধ্যে এই সঙ্কেতগুলোর গুরুত্ব থাকবে না৷ আমাদের দেশে যে সাইক্লোন হয়, সেগুলো বেশ বড় ধরনের৷ উন্নত বিশ্বের সাইক্লোন এ ধরনের নয়৷ তাই সাইক্লোনের, গতি-প্রকৃতি এবং সংজ্ঞাও সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হবে৷ সেইসাথে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে৷ আর মিডিয়াগুলোর উন্নয়নের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিকে আরো কার্যকর মাধ্যমে পরিণত করতে হবে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হলে বিভিন্ন দুর্যোগে এদেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো কমে যাবে৷
...................................................................................................................................
সাক্ষাৎকার
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ভূমিকা আছে৷ আমরা সবসময়ই এই খাতকে অবহেলা করে এসেছি
ড. এ এম চৌধুরী
সাবেক স্পারসো চেয়ারম্যান ও
সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল
? বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সিডরের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেমন হলো বলে আপনি মনে করেন?
>আমার তো মনে হয় দুর্যোগের তুলনায় এবারের মানুষের প্রাণহানি বেশ কম৷ কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মোটেও কম নয়৷ যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে৷ ফসলাদি থেকে শুরু করে পরিবেশের ভারসাম্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ যত বড় বড় দুর্যোগ এর আগে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গেছে, তখন ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়েছে৷ সেই তুলনায় ক্ষতি অনেক কম৷ এবারে দুর্যোগের আগে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার ফলে মৃত্যুহার অনেক কম ছিল৷ তাই সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করলে আমি বলবো প্রচুর ক্ষতি হয়েছে৷ এই ক্ষতি পূরণ করা কষ্টসাধ্য৷ তবে মানুষের মৃত্যুর হার আরো কম করা যেত বলেই আমি মনে করি৷
? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের যথাযথ প্রযুক্তি কতটুকু অপ্রতুল বলে আপনি মনে করেন?
>দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রযুক্তি এখনো যথেষ্ট অপ্রতুল৷ প্রথমেই আমি বলবো, আমাদের যথেষ্ট সাইক্লোন শেল্টার নেই৷ যতগুলো আছে, সেগুলোও খুব ভালো অবস্থায় নেই৷ এর মধ্যে অনেক সাইক্লোন শেল্টার আছে, যেগুলো শুধু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, যা খুব দুঃখজনক৷ আর আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় সাইক্লোন শেল্টারগুলোও বেশ ছোট ছোট৷ ঝড়ের সময় এই সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে বেশি মানুষের সঙ্কুলান হয় না৷ এর ফলেই মানুষের প্রাণহানি বেশি হয়৷ এছাড়াও দুর্যোগ আসার আগে সাধারণ মানুষকে যথেষ্ট পরিমাণে দুর্যোগের খবর জানানো সম্ভব হয় না৷ যদি মানুষকে আরো বেশি সচেতন করা যেত, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি আরো কম হতো৷ এত গেল দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা৷ দুর্যোগপূর্ব নেয়া যায় এমন যথেষ্ট প্রযুক্তিরও আমাদের অভাব আছে৷ আপনারা হয়তো জানেন, প্রাকৃতিক এই দুর্যোগসমূহের পূর্বাভাস নির্ণয় করার জন্য আমাদের রয়েছে স্পারসো৷ স্পারসোর সাহায্যে আমরা বেশ ভালোভাবেই দুর্যোগ সম্পর্কে জানতে পারি৷
কিন্তু আরো আধুনিক প্রযুক্তি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে৷ আর একটি জিনিসের অভাব আমি সব সময়ই অনুভব করি, তাহলো কমিউনিটি রেডিও৷ কমিউনিটি রেডিওকে যদি আমরা যথাযথ ব্যবহার করতে পারতাম তা অনেক কাজে দিত৷
? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা আরো কী কী করতে পারতাম, যাতে করে ক্ষয়ক্ষতি আরো কম হতো?
>দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক কিছু করার আছে৷ আমি বলবো যথেষ্ট হারে মানুষকে সচেতন করা যায়নি৷ রেডিও-টিভিতে আরো বেশি করে সতর্কবাণী প্রচার করার প্রয়োজন ছিল৷ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরানোর প্রয়োজনীয়তা ছিল৷ অবশ্য সরকার এক্ষেত্রে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়েছে৷ যার কারণে বিদেশীরাও আমাদের কাজের প্রশংসা করেছে৷ কিন্তু সতর্কতার কোনো শেষ নেই৷ সংবাদ মাধ্যম বা মিডিয়াগুলোকে আরো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে৷ মিডিয়াকে আরো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে৷ পুরো বিষয়টি আরো সতর্কতার সাথে বিবেচনা করলে ক্ষয়ক্ষতি আরো কম হতো৷
? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আরো কী কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে?
>আমি আগেই কমিউনিটি রেডিওর কথা বলেছি৷ কমিউনিটি রেডিও আমাদের জন্য বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে৷ বাংলাদেশ যেহেতু দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল, সেহেতু কমিউনিটি রেডিও খুব প্রয়োজন৷ তাছাড়া আমাদের সাইক্লোন শেল্টার বাড়ানো এবং যথাযথ সংস্কার করা প্রয়োজন৷
? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি কী কী ভূমিকা রাখতে পারে?
>দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ভূমিকা আছে৷ আমরা সবসময়ই এই খাতকে অবহেলা করে এসেছি৷ বাংলাদেশের সর্বত্র ইন্টারনেটের ব্যবস্থা নেই৷ এটি থাকা এখন যুগের চাহিদা৷ দুর্যোগপূর্ব সময়ে আমরা ই-মেইলের মাধ্যমে থানায় থানায় বা ইউনিয়ন পরিষদেও জরুরি বার্তা পাঠাতে পারি৷ তাছাড়া আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করি, এটিও কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিরই একটি অংশ৷ এই সেক্টরের অনেক উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে৷ ............................................................................................................
আমাদের প্রয়োজন যুগোপযোগী একটি সিগন্যালিং সিস্টেম
ডি. ডি এ কাদীর
অধ্যাপক, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়
সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, স্পারসো
? বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সিগন্যালিং সিস্টেম কি যথেষ্ট যুগোপযোগী?
>আসলে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সিগন্যালিং সিস্টেম বা সঙ্কেত ব্যবস্থা দুর্যোগের আলামত হিসেবে কোনোকালেই যুগোপযোগী ছিল না৷ এটা আসলে বন্দরের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয়৷ ইংরেজ আমলে বন্দরে নিরাপত্তার জন্য এই সিগন্যালিং ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়৷ কিন্তু এই সিগন্যালিং সিস্টেম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একেবারে অপ্রতুল৷
? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা কী কী প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি?
>প্রথমেই আমাদের প্রয়োজন একটি যুগোপযোগী সিগন্যালিং সিস্টেম৷ আমাদের মনে রাখতে হবে, এই বিশাল দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে প্রচুর নিরক্ষর মানুষ বাস করে৷ এমনিতেই আমাদের সিগন্যালিং সিস্টেম যুগোপযোগী নয়৷ তাছাড়া এসব নিরক্ষর মানুষ সিগন্যালিংয়ের ব্যাপারে কিছুই বুঝবে না৷ আর আমাদের সিগন্যালিং সিস্টেম সতর্কতাভিত্তিক না হয়ে সতর্কতার পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক হবার বিশেষ প্রয়োজন আছে৷ যেহেতু এই সিগন্যালিং সিস্টেম মানুষের জন্য নয়, বরং বন্দরের জন্য৷ তাই সাধারণ মানুষের বুঝার উপযোগী করে যুগোপযোগী সতর্কতামূলক অঞ্চলভিত্তিক সিগন্যালিং সিস্টেম চালু করতে হবে৷
আমরা স্পারসো থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের যে ছবিগুলো পাই, সেগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য খুব উন্নতমানের যন্ত্রপাতি দেশে নেই৷ বিসিসতে একটি আইবিএম সুপার কমপিউটার আছে৷ এই সুপার কমপিউটারের অপারেটিং সিস্টেম হচ্ছে ইঅঙ৷ এটি ইউনিক্সভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম৷ আমাদের দেশে ইউনিক্সভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করার মতো অপারেটরও খুব বেশি নেই৷ উন্নত বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য নানা ধরনের মডেল বিশ্লেষণ করতে হয়৷ এই মডেলগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য সুপার কমপিউটার প্রয়োজন৷ সুতরাং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি৷
? এক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
>দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকেই সবার আগে কাজে লাগাতে হবে৷ আমি সুপার কমপিউটার ব্যবহারের কথা বলেছি৷ আমাদের দেশে সুপার কমপিউটারও সিস্টেম লসের কারণে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না৷ এসব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ অনেক মডেল বিশ্লেষণ করা আমাদের দেশে সম্ভব হয় না৷ এগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন৷ দুই ধরনের মডেল বিশ্লেষণ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন৷ এগুলো হচ্ছে জিএসএম এবং আরএসএম৷ জিএসএম হচ্ছে গ্লোবাল স্পেকটোরাল মডেল৷ এটি বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ নির্ণয় ব্যবস্থার একটি মডেল৷ অপরদিকে আরএসএম হচ্ছে রিজিওনাল স্পেকটোরাল মডেল৷ এটি হচ্ছে আঞ্চলিক দুর্যোগ নির্ণয় ব্যবস্থার মডেল৷ এগুলো বিশ্লেষণ করার মতো ব্যবস্থা থাকতে হবে৷ অবশ্যই এক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে৷
? সিডরের আঘাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কি কমানো যেত?
>সিডরের আঘাতে যা ক্ষয়ক্ষতির হয়েছে, তা বর্তমান ব্যবস্থার কারণে খুব বেশি কমানো যেত না৷ ১৯৯১ সালে যে বড় ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার তুলনায় বর্তমান সময়ে ক্ষয়ক্ষতি কম হবার একটাই কারণ হচ্ছে, আমাদের প্রস্তুতি আগের থেকে উন্নত হয়েছে৷ তবে যে অঞ্চল দিয়ে ঘূর্ণিঝড় গেছে, সেই অঞ্চলে সাইক্লোন শেল্টার অনেক কম৷ এটি বেশি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেত৷
? আমাদের দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশোনা হয় না কেন?
>আমাদের দেশ ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে পড়েছে৷ তাই এই বিষয়ে আমাদের স্নাতক পর্যায়ে কোর্স করানো উচিত্৷ তবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বা ডক্টরাল পর্যায়ে এ বিষয়ে গবেষণা হয়৷ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতক পর্যায়ে পরিবেশ বিজ্ঞান পড়ানো হয়৷ কিন্তু এগুলো প্রকৃতপক্ষে পরিবেশ বিজ্ঞান নয়৷ কারণ, পরিবেশ বিজ্ঞানে অবশ্যই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে৷ আমরা আগেও এ ব্যাপারে বিভিন্ন সেমিনার বা পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে বলেছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ তাই এ ব্যাপারে আমরা যত দ্রুত চিন্তাভাবনা কার্যকর করতে পারব, ততই জাতি উপকৃত হবে৷
..........................................................................................................
সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কমিউনিটি রেডিওসহ যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন করলে এটিই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক ভূমিকা রাখতে পারে।
এ এইচ এম বজলুর রহমান
প্রধান নির্বাহী
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন
? দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি রেডিও কী ভূমিকা রাখতে পারে?
>দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি রেডিওর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি রেডিও সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে৷ রেডিও তিন ধরনের হয়৷ এগুলো হচ্ছে এমেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও, সিটিজেন রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও৷ এগুলো ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতির হার অনেক কমিয়ে আনা যেতে পারে৷
? তথ্যপ্রযুক্তি এই কমিউনিটি রেডিও প্রযুক্তির সাথে মিলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কী কী ভূমিকা রাখতে পারে?
>তথ্যপ্রযুক্তি একটা অত্যাধুনিক মাধ্যম৷ আর রেডিও একটা সনাতন প্রযুক্তি৷ এ দুয়ের দুই ধরনের প্রয়োজনীয়তা আছে৷ আমেরিকাতে যখন হারিকেন ক্যাটরিনা আঘাত হানে, তখন সেখানে নীতিনির্ধারকরা ঠিক করলেন আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি সনাতন প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে৷ সে অনুসারে এরা কাজ করলো এবং এর ফলে পুরো কমিউনিকেশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লো না৷ তথ্যপ্রযুক্তি যখন ব্যর্থ হলো, তখন রেডিও ও ওয়্যারলেস সিস্টেমের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হলো৷ কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের চিন্তাধারা আশা করা কঠিন৷ এখনো এখানে মনে করা হয় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কই তো এখানে আছে এবং প্রায় ৩ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে৷ তাই আমরা সব পেয়ে গেছি, আর কোনো প্রযুক্তি বা সিস্টেমের প্রয়োজন নেই৷ অথচ প্রয়োজনের সময় কিন্তু মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করেনি৷ তাই শুধু তথ্যপ্রযুক্তি ও কমিউনিটি রেডিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখতে পারবে এ কথা ভুল৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখতে হলে দেশের নীতিনির্ধারকদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, আন্তরিকতা ও সব ধরনের প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে৷
? আমাদের দেশে যেখানে রেডিও কালচারই নেই, সেখানে কিভাবে কমিউনিটি রেডিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখতে পারে?
>আমাদের দেশে রেডিও কালচার নেই কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়৷ আমরা শহরে থাকি বলে শহরের বিভিন্ন মিডিয়ার সাথে পরিচিত৷ এখানে মিডিয়ার অভাব নেই৷ টেলিভিশন বলেন, রেডিও, ইন্টারনেট, প্রিন্ট মিডিয়া যাই বলেন না কেন, পল্লী অঞ্চলে কিন্তু এত ধরনের মিডিয়া নেই৷ মানুষ এখনো রেডিও শোনে৷ আর রেডিওর মধ্যেও আবার রকমফের আছে৷ আমাদের সরকারি রেডিও ব্যবস্থা বেশ পুরনো আমলের৷ রেডিওকে অঞ্চলভেদে সবখানে পৌঁ ছে দিতে হবে৷ যদি আপনার ভাষাকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছাতে চান, তাহলে আপনাকে তা গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় পৌঁছাতে হবে৷ এক্ষেত্রে জাতীয় রেডিওর পাশাপাশি কমিউনিটি রেডিওকে এগিয়ে আসতে হবে৷ রেডিও মানেই যে বিনোদন তা নয়৷ বিনোদনের পাশাপাশি খবরাখবর, বিভিন্ন ইভেন্ট যেমন জন্ম-মৃত্যু সংবাদ, ফসলাদির সংবাদ, আবহাওয়া প্রভৃতির সংবাদ কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে প্রচার করা যেতে পারে৷ মোট কথা কমিউনিটি রেডিও হচ্ছে অল্প খরচে কমিউনিকেশনের একটা মাধ্যম৷ বিদ্যুত্, টেলিসংযোগ প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও কমিউনিটি রেডিও সচল রাখা যায়৷ কারণ, এই রেডিও চলে মাত্র ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারিতে৷ তাছাড়াও এটি সহজেই বহনযোগ্য৷ দুর্যোগের সময় এটি নিয়েই সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়া সম্ভব এবং তথ্য সম্প্রচারসহ প্রয়োজনীয় সবই সম্ভব৷ তাই সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কমিউনিটি রেডিওসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলে এটিই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক ভূমিকা রাখতে পারে ।
ফিডব্যাক : mortuza_ahmad@yahoo.com