এদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। এরা তথ্য পাওয়া ও ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। দেশের ৪০ লাখ মানুষ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং এদের বড় একটা অংশ শিক্ষার্থী, যারা পড়ালেখা করছে নিম্ন মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ লাইব্রেরি কিংবা বাজারে তাদের জন্য পর্যাপ্ত পাঠ্যবই ও অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রীর ঘাটতি প্রবল। ক্লাসনোট ও পাঠদান তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে তথ্য পাওয়া ও পড়াশোনায় তারা পিছিয়ে পড়ছে। যদিও উন্নত বিশ্বে তাদের তথ্য পাওয়া ও তা ব্যবহারে সহযোগিতা করতে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের বেশিরভাগ শিক্ষা উপকরণ আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। সেসব প্রযুক্তি ব্যবহারের যুতসই সুযোগের অভাবে স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যথাযথ সরকারি সহায়তা পেলে বাংলায় ব্রেইল এবং স্ক্রিন রিডার আমাদের দেশে তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ডেইজি-ই পারে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে।
সহজে পাওয়া এবং ব্যবহারোপযোগী পাঠ্য উপকরণ
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও পঠনপ্রতিবন্ধী (প্রিন্ট ডিজএ্যাবিলিটি) ব্যক্তিদের জন্য তাদের ব্যবহারের উপযোগী করে বই এবং অন্যান্য মুদ্রিত উপকরণ সরবরাহ করা বেশ কঠিন ব্যাপার। ইচ্ছে থাকলেও চাহিদার তুলনায় এর উৎপাদন কম এবং এটি প্রস্ত্ততের নিয়মও দুরূহ। ব্যবহারোপযোগী শৈলী বা আকারে উপকরণ পাওয়া না-পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিল কারণ এর সাথে সম্পৃক্ত :
সময় : পাঠকের প্রয়োজন অনুযায়ী উপকরণ সহজলভ্য ও মুদ্রণের জন্য তৈরির পর তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
খরচ : মুদ্রিত আকারের অতিরিক্ত কোনো খরচ ছাড়াই সহজলভ্য হওয়া উচিত।
সহজে পাওয়া : ছাপার বিকল্প আকার নিম্নরূপ হতে পারে- ব্রেইল, কথা বলিয়ে বই (টকিং বুক), ই-মুদ্রণ ও বড় অক্ষরে মুদ্রণ।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বে কমপিউটার এই শৈলী বা আকারের উৎপাদন ও বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ব্রেইল উৎপাদন : বিশ্বের সব জায়গায় ব্রেইল উৎপাদনে কমপিউটারের ব্যবহার একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।
টকিং বুক বা কথা বলিয়ে বই : ডিজিটাল রেকর্ডিংয়ের ফলে নানা সুবিধা পাওয়া যায়। উন্নত বিশ্বে ডিজিটাল টকিং বুক বা কথা বলিয়ে বই দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে। এটি কমপিউটারে ধারণ ও সিডিতে সংরক্ষণ করা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বেও এই প্রযুক্তির সুবিধা এনে দেবার প্রচেষ্টা চলছে।
ই-টেক্সট : কমপিউটারের পর্দার লেখা পড়তে পারে এমন সফটওয়্যার একজন দক্ষ পাঠক হিসেবে দৃষ্টি ও মুদ্রণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বইটি পড়তে সাহায্য করে। এর উৎপাদন ও বিতরণ খুবই সহজসাধ্য।
বড় অক্ষরে মুদ্রণ : কমপিউটারে ইলেকট্রনিক টেক্সট বড় আকারে দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উৎপাদন সহজতর হয়েছে।
বিশ্বায়নের বিশ্বে ডিজিটাল তথ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছানো এখন সেকেন্ডের কাজ। এক জায়গায় উৎপাদিত উপাত্ত সহজেই এখন বিভিন্ন স্থানে ব্যবহার করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- ব্রেইল ব্যবহার করে চট্টগ্রামে লেখা একটি বই সহজে ই-মেইলে যেকোনো স্থানে পাঠানো যায় এবং একটি ব্রেইল মুদ্রণ যন্ত্র দিয়ে এর অজস্র কপি কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি করা যায়। বর্তমানে পাঠ্য উপকরণের সব উৎপাদনে রয়েছে বিচ্ছিন্নতা। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ই-মুদ্রণের ত্রুটিহীন অনুলিপি তৈরিতে প্রচুর শ্রমসাধ্য উপাত্ত ব্যবহার করে। যদি এই উৎপাদনে পারস্পরিক স্বীকৃত পদ্ধতির সমন্বয় করা যেতো তাহলে খরচ আর শ্রম কমিয়ে ফেলা যেত। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ডিজিটাল পাঠ্য উপকরণ তৈরিতে সর্বজনীন মানদন্ড অনুসরণ না করা হবে এই সমন্বয় শুধু কাগজেই রয়ে যাবে।
ডিজিটালপ্রযুক্তি খুবই গতিশীল। ডিজিটাল আকারে প্রস্ত্তত উপাত্ত বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ ও উৎপাদন সম্ভব। ব্যাপারটি অনুধাবন করে বিশ্বের বিকল্প উপকরণ প্রস্ত্ততকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এক হয়ে ই-মুদ্রণ ও টকিং বুক উৎপাদন ও সংরক্ষণে একক মানদ নির্ধারণ করেছে। এই মানদন্ডকে বলা হয় ‘ডেইজি মানদন্ড’।
ডেইজি বিষয়ে ঘটনা বিশ্লেষণ বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
ডেইজি বা ‘ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম’ কমপিউটারভিত্তিক বহুমাত্রিক মাধ্যমের সুবিধা পাওয়া ও ব্যবহারের একটি উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক মানদ । ২০০৫ সালে ইপসার (www.ypsa.org) হাত ধরে এটি বাংলাদেশে আসে। এই কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে সফটওয়্যারটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অত্যন্ত সহজে পড়তে সাহায্য করে। সম্পাদনার কাজে আলাদা একটি সফটওয়্যার ব্যবহার হয়।
২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ১ মে এক সেমিনারের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ডেইজি বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। এই সেমিনারে অংশ নেয় ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসা অসংখ্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি। পরে ডেইজি কনসোর্টিয়ামের আর্থিক সহায়তায় ইপসা ‘ডেইজি সেন্টার’ চালু করে। ২০০৫ সালের অক্টোবরে এখানে ডেইজির কলাকৌশলের ওপর দশজন প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এর ধারণা ছড়িয়ে দেয়া। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছাড়াও কয়েকজন অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিও এখানে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে। প্রশিক্ষণে দুটি সম্পাদনার সফটওয়্যার ‘মাই স্টুডিও পিসি’ এবং ‘সিগটুনা’ ব্যবহার হয়। এগুলো ইপসা ও ডেইজি কনসোর্টিয়াম থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। এর জন্য অবশ্য একটি লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে ইপসা এই লাইসেন্স দেয়ার কর্তৃপক্ষ। একথা সত্যি, প্রতিবন্ধী মানুষের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে ডেইজি কর্মসূচি আমাদের দেশে এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। এর সাথে আছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য স্বল্পসংখ্যক কমপিউটার সরবরাহের প্রতিষ্ঠান। এর দুটি ঢাকায় এবং একটি চট্টগ্রামে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেইজি বই তৈরি হয়েছে ৪৫০টি। বাংলাদেশ সরকারের একসেস টু ইসফরমেশন (এটুআই) প্রজেক্টে (www.infokosh. bangladesh.gov.bd) ডেইজি কনটেন্টগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে।
ডেইজি কী?
ডেইজি (ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম) কমপিউটারভিত্তিক বহুমাত্রিক (মাল্টিমিডিয়া) মাধ্যমের জন্য একটি উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক মানদন্ড। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, ডাইলেক্সিক ও মুদ্রণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ডেইজি কনসোর্টিয়াম সারা দুনিয়ায় তথ্য ও জ্ঞান বিনিময়ে প্রতিবন্ধী এবং সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহারোপযোগী বিভিন্ন মাধ্যমের আদর্শ মান নির্ধারণ করে থাকে।
বিশ্বজুড়ে তথ্য ও জ্ঞান বিনিময় প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি-নির্বিশেষে সবার জন্যই ডেইজি মাল্টিমিডিয়া বা কমপিউটারভিত্তিক বহুমাত্রিক মাধ্যম আদর্শ। ডেইজি উন্নয়নশীল ও উন্নত বিশ্বের মধ্যে ডিজিটাল তথ্য বিনিময়ের সেতুবন্ধ স্থাপন করে। ডেইজি মুদ্রণপ্রতিবন্ধীসহ ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও যেসব জনগোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি নেই, সেই সব শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত মানুষদের জন্য কার্যকর এক প্রযুক্তি।
ভাবুন তো এমন ধরনের বই যেটি ডিজিটাল উপায়ে প্রস্ত্তত, সংরক্ষণ এবং বিতরণযোগ্য; বইটি দেখে এবং ছুঁয়ে এটি পড়া ও শোনা যায়; প্রতিবন্ধী বা অপ্রতিবন্ধী, সব বয়সের মানুষ লিখিত ভাষা বা লিখিত ভাষা ছাড়াই বইটি পড়তে পারে; ১০০০ পৃষ্ঠারও বেশি এমন একটি বই একটি সাধারণ সিডিতে ধারণ করা সম্ভব; আর বইটির উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণের প্রযুক্তি মুক্ত (ওপেন সোর্স), অলাভজনক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত; সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই প্রযুক্তির মূলনীতি হচ্ছে সর্বজনীন (ডিজাইন্ড ফর অল), যার সুবিধা সবাই পেতে পারে ও সবার ব্যবহারোপযোগী।
মানবিক কল্পনার অনেক কিছুই বাস্তবে সত্যি করে তুলেছে এই ডেইজি।
ডেইজি কেনো? ডেইজি ব্যবহারের পক্ষে মূল যুক্তিগুলো
বৈচিত্র্যময় মুদ্রণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাংলাদেশের সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের জন্য ব্যবহারোপযোগী; বিশ্বের যেকোনো স্থানে এই প্রযুক্তি ও বিষয়বস্ত্ত তৈরি করা সহজ ও সুবিধাজনক; এটি দীর্ঘস্থায়ী; ভাষা-নিরপেক্ষ, হার্ডওয়্যার-নিরপেক্ষ এবং প্লাটফর্ম-নিরপেক্ষ; ব্রেইল, বর্ধিত আকারে মুদ্রণ, ই-পাঠ প্রভৃতি মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার এবং রূপান্তরযোগ্যতা।
ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী
ডেইজি কনসোর্টিয়াম মুদ্রণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কাজ করছে। এই সংজ্ঞা অবশ্য একেক দেশে একেক রকম। একে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে দৃষ্টি, মানসিক বা শারীরিক কারণে মুদ্রণ মাধ্যম ব্যবহারে অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। মুদ্রণপ্রতিবন্ধী বলতে তাদের বুঝায় যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন, পড়তে অক্ষম, এমনকি বই ধরতে অপারগ এমন কেউ। এছাড়াও প্রবীণ ব্যক্তি, মস্তিষ্কজনিত পক্ষাঘাত, এমনকি নিরক্ষর ব্যক্তিরাও ডেইজির সুবিধা পেতে পারেন।
http://www.daisy.org/publications/docs/20020913153305/theory_dtbook.html
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : vashkar79@hotmail.com