টারমিনেটর হলিউডের একটি ছবির নাম। বেশ কয়েক বছর আগের জনপ্রিয় সাড়াজাগানো ছবি টারমিনেটর। অনেকেই দেখেছেন ছবিতে নায়কের চোখে একটি কমপিউটারসম্বলিত চশমা থাকে। এ চশমার সুবাদেই নায়ক অনেক কাজ সম্পন্ন করেন। ছবিতে নায়কের এ চশমা তখন অনেকের কাছে কল্পনার বস্ত্ত মনে হয়েছিল। আর তখন এ চশমার পেছনে কারসাজি ছিল ছবির পরিচালকের। আদতে সে সময় পৃথিবীতে এমন চশমা তৈরি হয়নি। প্রযুক্তির কল্যাণে টারমিনেটর নায়কের ব্যবহার করা কমপিউটার নিয়ন্ত্রিত চশমা বাস্তবে তৈরি হয়েছে। আর এই চশমা তৈরি করেছে কপিল নামের মার্কিন কোম্পানি। চশমাটির নাম দেয়া হয়েছে গোল্ডেন-আই। প্রায় আড়াই বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় গোল্ডেন-আইয়ের প্রাথমিক সফলতা আসে। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি গোল্ডেন-আইয়ের প্রজেক্ট শুরু করা হয়।
খুব কম ওজনের গোল্ডেন-আই হলো মাথায় আটকানো এক ধরনের যোগাযোগ রক্ষাকারী ডিসপ্লে সিস্টেম, যার মাইক্রো ডিসপ্লে ১৫ ইঞ্চির একটি ডিসপ্লে তৈরি করে। পুরো সিস্টেমটি সাতটি যন্ত্র এবং নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করে। অন্যান্য কমপিউটার সিস্টেমের মতো গোল্ডেন-আইও অনেক যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে গঠিত। এর হেডসেট অন্যান্য যন্ত্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ব্লুটুথ/ওয়াই-ফাই/সেল্যুলার নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে। এটি দিয়ে অনায়াসে সেল্যুলার মোবাইল নেটওয়ার্কে যোগাযোগ গড়ে তোলা যায়। এর চোখের সামনের ডিসপ্লেতে ২৪ বিটের কালার ডিসপ্লে ব্যবহার করা হয়েছে, যা ব্যবহারকারীর চোখ থেকে ১৮-২২ ইঞ্চি দূরে প্রদর্শন করে। এর ডিসপ্লেতে ব্যবহার করা হয়েছে একটি লেন্স। ফলে ডিসপ্লেতে যখন কোনো কিছু দেখা যায়, তখন ব্যবহারকারী মনে করে চোখ থেকে ডিসপ্লেটি ১-২ ইঞ্চি দূরে আছে। তখন ডিসপ্লের আকার হয় ৫-৭ ইঞ্চি। এর কমপিউটারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ সিই ৬.০, যা ভবিষ্যতে উইন্ডোজ ফোন ৭ অপারেটিং সিস্টেম। এটি ৩২ গি.বা. মাইক্রোএসডি কার্ড সাপোর্ট করে। এর ইন্টারনাল ব্যবহারের জন্য রয়েছে ৬ গি.বা. ডিডিআর র্যা ম। গোল্ডেন-আইয়ে প্রসেসর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ৬৫ ন্যানোমিটারের T10MAP মোবাইল ডুয়লি প্রসেসর, যা ৪০০ থেকে ১ গি.বা. ক্লকস্পিডে কাজ করতে পারে। এর পরবর্তী ভার্সনে যুক্ত করা হয়েছে ৪৫ ন্যানোমিটারের প্রসেসর। এই প্রসেসর দুটি ভিন্ন ভিন্ন মাদারবোর্ডে যুক্ত করা হয় এবং মাদারবোর্ড দুটি একটি আরেকটির ওপর থাকে। ফলে অনেক কম জায়গায়ও মাদারবোর্ডটি রাখা যায়। এই প্রসেসরের বড় সুবিধা এটি চালাতে অনেক কম বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। গোল্ডেন-আই এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যেন ব্যবহারকারীর মনে হয় তিনি একটি সানগ্লাস পরে আছেন। এর মূল যন্ত্রাংশ থাকে মাথার পেছনে, ফলে ব্যবহারকারী অন্য কাজ করার সময়ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর হেডফোনটি সরাসরি কানের ভেতর না রেখে কানের ওপর রাখা হয়েছে, যেন ব্যবহারকারী আশপাশের শব্দও শুনতে পারেন। এর মাইক্রোফোনকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা খুব সংবেদনশীল; ফলে ২০০ ও তারচেয়ে বেশি ডেসিবলের নয়েজেও ভালো কাজ করে। ফলে মুখে কোনো শব্দ করলে বা আশপাশে শব্দ হলেও কোনো নয়েজ কানে শোনা যায় না। পাশাপাশি আশপাশে যদি বেশি নয়েজ তৈরি হয়, তখন এর ভার্চুয়াল ফোন অপশন আশপাশে এমন পরিবেশ তৈরি করে, যেন অনেক আসেত্ম কথা বললেও তা অন্য প্রান্তে স্পষ্ট শোনা যায়। এর মাথার পেছনের মূল যন্ত্রে আছে একটি মিনি ইউএসবি পোর্ট, মাইক্রোএসডি কার্ড স্লট, একটি ১২০০ মিলি অ্যাম্পিয়ার লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। এই ব্যাটারি দিয়ে পুরো যন্ত্রটি ৮-১০ ঘণ্টা ব্যবহার করা যায়। এর মাদারবোর্ডটির সাইজ ৩৫x৫৫ মিলিমিটার। এই মাদারবোর্ডটির সাথে যুক্ত করা হয়েছে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির রেডিও। যার মাধ্যমে বিভিন্ন স্টেশন শোনা ও রেডিও যোগাযোগ গড়ে তোলা যায়। গোল্ডেন-আইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে Vocom 3200 স্পিচ রিকগনিশন সফটওয়্যার। যার মাধ্যমে কমপিউটারকে মুখে বলে কমান্ড করা যায়। এই স্পিচ রিকগনিশন সফটওয়্যারের জন্য Xenolinguistic অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে। এই সফটওয়্যার প্রায় ৯৫% সঠিকভাবে কমান্ড নিতে পারে। এর ডিসপ্লেটি অত্যন্ত চমৎকার। এই SVGA রেজ্যুলেশনের ডিসপ্লেটি একটি অ্যাডজাস্টেবল বাহুর সাথে যুক্ত থাকে। এর অপটিক পড UV/IR-Camera জেনারেটেড ডিসপ্লে দেখাতে পারে। অপটিক পডের ভেতর একটি লাইট থাকে, যা দিয়ে সাদা-লাল আলো তৈরি করা যায়। এই লাইট অন্ধকার ও আলোতে ডিসপ্লেকে আরও উজ্জ্বলভাবে প্রদর্শন করতে পারে। এর অপটিক পডটি বাম-ডান চোখে দেখার সুবিধামতো সরানো যায়। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন চোখ ও মুখের মাঝামাঝি অবস্থান করে। ফলে ব্যবহারকারীর সামনে দেখতে কোনো অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে কথা বললে পেছনের শক্তিশালী মাইক্রোফোনে সহজেই তা ধারণ করতে পারে। এর অপটিক পডে আছে শক্তিশালী আই সেন্সর, যা চোখের ও আশপাশের আলো অনুযায়ী এর ডিসপ্লের আলো পরিবর্তন করে। ফলে ম্যানুয়ালি ডিসপ্লের ব্রাইট কমানো-বাড়ানোর দরকার হয় না। গোল্ডেন-আইয়ে ব্যবহৃত সফটওয়্যারকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, আপনি ইচ্ছে করলে আপনার চোখ দিয়ে একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এতে সাহায্য করে ডিসপ্লে সেন্সর। যেমন আপনি কোনো বড় ডকুমেন্টস পড়বেন সেক্ষেত্রে চোখকে নিচের দিকে একটু নামালেই ডিসপ্লেতে ডকুমেন্টস উপরে উঠতে থাকে। এতে সেল্যুলার যোগাযোগ ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ায় বাড়তি সুবিধা হিসেবে আলাদা মোবাইল ব্যবহারের দরকার পড়ে না। এর মধ্যে থাকা মোবাইল যোগাযোগ শুধু আমেরিকান কোম্পানিগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি যোগ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক আসা এর সর্বশেষ ভার্সনে যুক্ত হয়েছে আধুনিক ক্যামেরা। আর হেডসেটে ক্যামেরা যুক্ত হওয়ায় আপনার পেছনে কী ঘটছে তা আপনি আপনার চোখের ডিসপ্লেতে দেখতে পারবেন।
গোল্ডেন-আইয়ের এত সুবিধা দেখে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। পাশাপাশি মটোরোলা ও সিমেন্সের মতো বড় বড় মোবাইল কোম্পানি গোল্ডেন-আইয়ের আদলে মোবাইল ফোন বানানো শুরু করেছে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : minitohid@yahoo.com