লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
দেশ ও প্রযুক্তি
নতুন মাত্রায় আইসিটি
মানুষের পেশাগত কাজে আইসিটির অবদান এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আইসিটির অবদান নিয়ে এখনও অনেকে সন্দিহান। কেউ কেউ অবশ্য নিমরাজি হয়ে বলেন, ‘আরো কিছুটা সময় লাগবে।’ কিন্তু যারা আইসিটির সার্বিক বিষয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছেন, তারা কিন্তু বেশ একটু সাবধানী দৃষ্টিতেই দেখছেন। তাদের সাবধানী দৃষ্টির কারণ- কিছু কিছু বিষয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে অতিমাত্রায় প্রভাবিত করা।
০১.
বাণিজ্যিক যোগাযোগের বাইরে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ দ্রুত মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এর আগে আর কোনো কিছুই এতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। যদি ফেসবুকের কথা ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে উদ্ভাবনের সাত বছরের মধ্যে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর এই ৭০ কোটির মধ্যে ৭০ শতাংশই পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর বাইরের ব্যবহারকারী। এর অর্থটা একদিকে যেমন উৎসাহব্যঞ্জক, অন্যদিকে আবার তেমন চিন্তারও। কারণ, এই সামাজিক ওয়েবসাইটের বেশিরভাগই যে ব্যবহার করছে পশ্চিমা মূল্যবোধের বাইরের ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ। সে কারণেই পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের কাছে ফেসবুক বা ইত্যাকার সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো নিছক ভার্চুয়াল সাইট থাকলেও ভিন্ন সংস্কৃতির লোকজনের কাছে তা শুধু ভার্চুয়াল থাকেনি- কিংবা বলা যায় থাকছেও না। বন্ধুত্ব আর মজার মজার শব্দ-বাক্যের বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে এ সাইটকে ব্যবহার না করে আইসিটির নব্য সুবিধাভোগীরা তাদের মত-ভিন্নমতের প্রধান মাধ্যম করে তুলেছেন ফেসবুককে। এবং যত দ্রুত এই কাজটি হয়েছে তাতে করে আইসিটি জগতের প্রযুক্তিবিদেরাও বিস্ময় মানছেন। তাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে বেশ কিছু বিষয়। প্রথমত, ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্নতর মানুষকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? দ্বিতীয়ত, কী ধরনের নতুন সুবিধা এরা চাচ্ছেন এবং তৃতীয়ত, জীবনাচারের পরিবর্তনগুলো ইতিবাচক কি না!
০২.
সম্প্রতি আইসিটিভিত্তিক বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রধান ঘটনাটি ঘটিয়েছে সেই উইকিলিকস। হ্যাঁ, মাইকেল অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস- মার্কিন দূতাবাসগুলোর গোপন নথি ফাঁস করে যারা আলোচনায় এসেছিল। এর আগে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যগুলো সম্পাদনা করে প্রকাশ করত। কিন্তু এবার উইকিলিকস একবারে আড়াই লাখ তারবার্তা ফাঁস করে দিয়েছে কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই।
বিগত এক মাস ধরে বাংলাদেশের দৈনিকগুলোতে প্রতিদিন উইকিলিকসের ফাঁস করা কোনো না কোনো তথ্য থাকছে, যেগুলো নানা সময়ের নানা গুজব এবং রাজনৈতিক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের চরিত্রের বিভিন্ন দিক উন্মোচন করছে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার উইকিলিকসের ফাঁস করা আড়াই লাখ তারবার্তার সবই বাংলাদেশ নিয়ে নয়, সংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৭ নম্বরে। অর্থাৎ অন্য আরো ৩৬টি দেশের বিষয়ে আরও বেশি গোপন তথ্য ফাঁস করেছে উইকিলিকস।
সব সময়ই মার্কিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোপন তারবার্তা পাঠান। এটা তাদের রুটিন কাজ। এসব তারবার্তায় এরা বলতে গেলে প্রতিদিনের কর্মকান্ড, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা, বিভিন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেন। একে অনেকটা তৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বলেও ধরা যায়। হয়তো অনেক কিছুই পরে অন্যভাবে মূল্যায়িত হয়, কিন্তু কোনো ঘটনা ঘটার পরপর সেটাকে কে কিভাবে দেখছেন; কার সম্পর্কে কে কী মন্তব্য করছেন, কোন রাজনীতিবিদ কী ধরনের উচ্চাভিলাষ পোষণ করেন বা সুযোগ কিভাবে কাজে লাগাতে চান তার বিবরণী তুলে ধরেন মার্কিন কর্মকর্তারা। অত্যাধুনিক অনেক প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হলেও এখন পর্যন্ত কিন্তু পুরনো তারবার্তা পদ্ধতিতেই এসব তথ্য পাঠান মার্কিন দূত ও কর্মকর্তারা। তবে সে গোপনীয়তা কোনো হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফাঁস হয়নি বা উইকিলিকসের কাছে যায়নি। যদিও উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল অ্যাসাঞ্জ প্রথম জীবনে হ্যাকারই ছিলেন, কিন্তু মার্কিন এই বিপুল তারবার্তার বান্ডিল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক কর্মকর্তাই তুলে দিয়েছিলেন মাইকেল অ্যাসাঞ্জের হাতে। অ্যাসাঞ্জও প্রথম প্রথম এটি আইসিটির মাধ্যমে প্রকাশ করতেন না, করতেন পত্রিকার মাধ্যমে। কিন্তু কয়েক মাস আগে আকস্মিকভাবেই অসম্পাদিত আড়াই লাখ গোপন তারবার্তা ফাঁস করে দেয় উইকিলিকস। এবার আর পত্রিকার মাধ্যমে নয়, সরাসরি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় এগুলো।
এভাবে প্রকাশের পর যে বিষয়গুলো প্রকটভাবে চোখে পড়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই বাংলাদেশ ও ভারতে ঘটেছে। দেখা গেছে, এ দেশের কিছু নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি যে পত্রিকাগুলোয় উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন তারা এবং ‘সত্য নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন।
আসলে আইসিটি এবং উইকিলিকস সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে প্রতিবাদকারীরা সোচ্চার না হয়ে চুপ করেই থাকতেন। কারণ, উইকিলিকসের পক্ষে বাংলাদেশের কোনো ক্ষমতাধর বা সাবেক মন্ত্রীকে চেনার কথা নয়, মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তার নামে ওই সব ব্যক্তির নামে বানোয়াট কিছু প্রকাশ করাও সম্ভব নয়। তবু যে বাংলাদেশের ওই সব সোচ্চার ব্যক্তি ভারতের রাজনীতিবিদ মায়াবতীর মতো আচরণ করেননি। মায়াবতী তো সরাসরি মাইকেল অ্যাসাঞ্জকে আক্রমণ করেছেন, অ্যাসাঞ্জও তার জবাব দিয়েছেন। বলেছেন- মায়াবতী যদি ব্যক্তিগত জেট বিমান পাঠান, তাহলে তিনি ভারতে যেতে পারেন, মাপ পাঠালে তার জন্য একজোড়া স্যান্ডেল নিয়ে যাবেন।
মায়াবতীর আসলে বোঝা উচিত ছিল তার স্যান্ডেল কিনতে মুম্বাইয়ে ব্যক্তিগত বিমান পাঠানোর তথ্য মাইকেল অ্যাসাঞ্জ তার পেট থেকে বা মাথা থেকে বের করেননি, সেরকম যদি করে থাকেন তাহলে করেছেন কোনো মার্কিন কর্মকর্তা। মাইকেল অ্যাসাঞ্জ কর্ম বা অপকর্ম যা-ই করে থাকুন- তার দায়িত্ব ফাঁস করা পর্যন্ত।
তবে এসব ঘটনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আইসিটি এবং এর ব্যাপ্তি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অভাব রয়েছে কা জ্ঞানের এবং স্বচ্ছতারও।
শেষ কথা
সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি ফেসবুক-টুইটার ধরনের সামাজিক ওয়েবসাইটগুলো মানুষকে নানাভাবে ক্ষমতাধর করে তুলছে। ভাবজাগতিক বিষয় থেকে বাস্তবতার মধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে অনেক সামাজিক বঞ্চনার তথ্যেরই রূপান্তর ঘটেছে রাজনীতিতে। এ ধারা থামবে এমন মনে করা হবে প্রচুর ভুল, কারণ থামাবে কে? মাইকেল অ্যাসাঞ্জ কি থামবেন? এক মাইকেল অ্যাসাঞ্জ থামলেও আরও কেউ আসবেন না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? রাজনীতিবিদরা যদি মাইকেল অ্যাসাঞ্জদের জন্ম ঠেকাতে চান তাহলে রাজা হেরাল্ডের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের। কিন্তু রাজা হেরাল্ড যেমন জিসাসের জন্ম ঠেকাতে পারেননি, তেমনি রাজনীতিবিদেরা অ্যাসাঞ্জদের উত্থান ঠেকাতে পারবেন না। সে জন্য তাদেরকে আইসিটি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সবাইকেই একথা মনে রাখতে হবে, একবিংশ শতাব্দীতে আইসিটিকে সব কর্মের কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বলে বিশ্বাস না করলে চলবে না; অদূর ভবিষ্যতে আইসিটিই নিয়ন্ত্রণ করবে সব কিছু। সে জন্য একে কিভাবে ভালো কাজে লাগান যায় তার উদ্যোগ নেয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com