তথ্যপ্রযুক্তির অন্যতম পথিকৃৎ বিশ্বখ্যাত কমপিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস আর নেই। ৫ অক্টোবর ২০১১ ৫৬ বছর বয়সে এ বিশ্বমায়া ছেড়ে না ফেরার জগতে চলে যান প্রযুক্তির এই দিকপাল। সৃজনশীলতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জবসের অসামান্য দক্ষতায় অ্যাপল বিশ্বের অন্যতম প্রধান কমপিউটার প্রস্ত্ততকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
গত বুধবার অ্যাপলের ওয়েবসাইটে তার মৃত্যুর খবর জানানো হয়। অ্যাপলের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, স্টিভ জবসের মেধা, ভালোবাসা উদ্যমই ছিল অসংখ্য উদ্ভাবনের নেপথ্যে, যা আমাদের সবার জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। স্টিভের জন্যই বিশ্ব আজ অনেকটা উন্নত। অ্যাপলের এই স্বপ্নদ্রষ্টার সম্মানে তাদের ওয়েবসাইটে স্টিভের সাদা-কালো একটি বড় ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে স্টিভ জবস ১৯৫৫-২০১১। প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতরের বাইরে তাদের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারে ভুগছিলেন এই কমপিউটার প্রকৌশলী ও উদ্যোক্তা। ম্যাক আইফোন, আইপ্যাড ইত্যাদির মতো বিভিন্ন প্রযুক্তিগত বিস্ময়ের উদ্ভাবক ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান নির্বাহী ও বর্তমান বোর্ডের চেয়ারম্যান স্টিভ জবস।
অ্যাপলের ওয়েবসাইটে তার মৃত্যুসংবাদ জানানোর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এ তালিকায় আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতৃবর্গ ও আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির সংশ্লিষ্টজনেরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্টিভ জবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবক বলে অভিহিত করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, জবসের মতো মানুষ আমাদের পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন। অ্যাপলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘পৃথিবী এক বিরল ব্যক্তিত্বকে প্রত্যক্ষ করেছে। আগামী অনেক প্রজন্ম তাকে স্মরণ করবে। আমরা যারা তার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, তারা সত্যিই ভাগ্যবান এবং নিশ্চিতভাবেই এক বিশাল সম্মানের বিষয়।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ স্টিভ জবসের মৃত্যুতে শোক জানাতে গিয়ে বলেন, ‘স্টিভ, ধন্যবাদ তোমাকে আমাদের বিজ্ঞ পরামর্শদাতা এবং বন্ধু হওয়ার জন্য। ধন্যবাদ তোমার সৃষ্টির জন্য, যা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। আমরা তোমার অভাব বোধ করব।’
শারীরিক অসুস্থতার কারণেই অ্যাপলের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত স্টিভ জবস চলতি বছরের ২৪ আগস্ট অ্যাপলের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে নিজ হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদটি কিছুদিন আগে ছেড়ে দেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন অ্যাপলের চিফ অপারেটিং অফিসার টিম কুক।
১৯৭৬ সালে বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াককে নিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপল ইনকর্পোরেটেড নামের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বের শীর্ষ কমপিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। স্টিভ জবস তার মেধা, মনন ও প্রতিভার মাধ্যমে এক বিস্ময়কর জগৎ আমাদেরকে উপহার দিতে সমর্থ হন। কমপিউটারকে বিশেষ নকশায় হাজির করতে এবং এর ব্যবহার সহজ করতে সারা জীবন কাজ করে গেছেন।
মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সালে স্টিভ জবসের সম্পদের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৬১০ কোটি ডলারে। মার্কিন ধনীদের তালিকায় ৪২ নম্বরে জবসের ঠাঁই হয়।
স্টিভ জবস ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি সত্যিকার অর্থে আইটি শিল্পকে বদলে দেন কয়েকভাবে। বস্ত্তত তিনি বিভিন্নভাবে বিশ্বের মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারাকে বদলে দেন তার অনবদ্য প্রযুক্তিপণ্যের সৃষ্টির মাধ্যমে। স্টিভ জবস যেসব প্রযুক্তিপণ্য উদ্ভাবন করে বিশ্বকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন তার কালক্রম নিম্নরূপ :
১৯৭১ : স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াকের হাত ধরেই অ্যাপলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু।
১৯৭৭ : অ্যাপল ইনকর্পোরেটেড প্রতিষ্ঠা হয় অ্যাপল কমপিউটার ইঙ্ক হিসেবে।
১৯৭৭ : অ্যাপল চালু করে বিশ্বে প্রথম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত পার্সোনাল কমপিউটার অ্যাপল টু।
১৯৮০ : অ্যাপল চালু করে অ্যাপল থ্রি।
১৯৮০ : অ্যাপল শেয়ারবাজারে আসে এবং প্রথম দিনের ট্রেডিংয়ে শেয়ারমূল্য ২২ ডলার থেকে ২৯ ডলারে উন্নীত হয়।
১৯৮৩ : অ্যাপল প্রথম মাউস নিয়ন্ত্রিত কমপিউটার ‘লিসা’র ঘোষণা দেয়।
১৯৮৫ : অ্যাপল প্রথম গ্রাফিক্যাল সুবিধার ইন্টারফেসসমৃদ্ধ ছোট কমপিউটার বাজারে ছাড়ে।
১৯৮৫ : অ্যাপলের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন স্টিভ এবং সাত কোটি ডলার মূলধন নিয়ে চালু করেন নেক্সট কমপিউটার নামের প্রতিষ্ঠান।
১৯৮৬ : বিখ্যাত অ্যানিমেশন স্টুডিও পিক্সার কিনে নেন স্টিভ জবস।
১৯৮৯ : চালু করেন নেক্সট কমপিউটার, যা দি কিউব হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৯৫ : প্রিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিও থেকে মুক্তি পায় জনপ্রিয় অ্যানিমেশন ছবি টয় স্টোরি, যা আয় করে ১৯ কোটি ডলার।
১৯৯৬ : অ্যাপল নেক্সট কমপিউটার কিনে নেয়।
১৯৯৭ : স্টিভ জবস অ্যাপল কমপিউটার ইঙ্কের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান নির্বাহী এবং চেয়ারম্যান হন।
১৯৯৮ : অ্যাপল অবমুক্ত করে অল-ইন-ওয়ান আইম্যাক, যার লক্ষাধিক ইউনিট বিক্রি হয়।
২০০১ : আ্যাপল গান শোনার জন্য ম্যাক ব্যবহারকারীদের জন্য চালু করে আইটিউন সুবিধা।
২০০১ : আ্যাপল চিতা কোড নামে প্রথম ম্যাক ওএসএক্স অপারেটিং সিস্টেম চালু করে।
২০০৩ : স্টিভ জবস ঘোষণা দেন আইটিউন মিউজিক স্টোরের, যা বিক্রি করে এনকোডেড গান ও অ্যালবাম।
২০০৭ : স্টিভ জবস ঘোষণা দেন আইফোনের। এটি হলো কীবোর্ড ছাড়া প্রথম স্মার্টফোন।
২০০৯ : স্টিভ জবসের লিভার বদল করা হয়।
২০১০ : অ্যাপল ঘোষণা দেয় আইপ্যাড ট্যাবলেট কমপিউটার তৈরির।
কজ ওয়েব