লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
প্রকৌশলী সালাহউদ্দীন আহমেদ
মোট লেখা:১২
লেখা সম্পর্কিত
ডেবিট কার্ডে দেশী ব্যাংকগুলোর সম্ভাবনা
বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। তথ্যপ্রযুক্তির সেবা নিয়ে যেসব খাত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে ব্যাংকখাত এর মধ্যে অন্যতম। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণেই আমাদের দেশীয় ব্যাংকগুলো এখন অনলাইন ব্যাংকিং সেবা দিতে শুরু করেছে। ব্যাংকগুলোর এই অনলাইন সেবা দেয়ার পর্যায় একদিনে আসেনি। দীর্ঘদিন কমপিউটারাইজড সেবা দেয়ার পর গত এক দশক আগে শুরু হয়েছে অনলাইন ব্যাংকিং সেবা।
অনলাইন সেবা দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে সেগুলো হলো-
০১. দ্রুততম সময়ে সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে,
০২. যেকোনো শাখা থেকে আর্থিক লেনদেনের সুবিধা,
০৩. কেন্দ্রীয়ভাবে হিসাব সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে,
০৪. দ্রুততম সময়ে তথ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে এবং
০৫. দ্রুত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে ইত্যাদি।
অন্যদিকে গ্রাহকেরা যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে সেগুলো হলো-
০১. কাছাকাছি যেকোনো শাখা থেকেই সেবা নিতে পারছে,
০২. দ্রুততম সময়ে হিসাবের যাবতীয় তথ্য খুঁজে পাচ্ছে,
০৩. যেকোনো স্থান থেকে (ATM-এর মাধ্যমে) ক্যাশ উত্তোলন কিংবা ক্যাশ জমা দিতে পারছে (Kiosk-এর মাধ্যমে) এবং
০৪. আইডি’র মাধ্যমে একাধিক হিসাবের তথ্য একই সাথে জানতে পারছে ইত্যাদি।
ঠিক একইভাবে ডেবিট কার্ড অপারেশন ও মেইনটেনেন্সের জন্য অনলাইন ব্যাংকিং বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেন্দ্রীয় ডাটাবেজসম্পন্ন ব্যাংকিং অপারেশনের মাধ্যমে ডেবিট কার্ড নিয়ন্ত্রণ করা বেশ সহজ হয়।
ডেবিট কার্ড ইস্যুরেন্সের জন্য যেসব প্রস্ত্ততি সাধারণত প্রয়োজন হয় সেগুলো হলো-
০১. একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ প্রয়োজন হয়,
০২. কার্ড ইস্যুরেন্সের জন্য সফটওয়্যার প্রয়োজন হয়,
০৩. কার্ড প্রস্ত্তত করার জন্য একটি কার্ড এ্যাম্বোসার প্রয়োজন হয়,
০৪. গেটওয়ে ও তথ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সুইচ প্রয়োজন হয় এবং
০৫. সুইচ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের প্রয়োজন হয়। সর্বোপরি প্রয়োজন হয় কিছু প্রশিক্ষিত বা দক্ষ জনবল।
আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য কার্ড ব্যবসায় নতুন। মোটামুটি আশির দশকের পরপর এই ব্যবসায় আমাদের ব্যাংক খাতে শুরু হয়। যে বিষয়গুলো মাথায় রেখে ব্যাংকগুলো কার্ড ব্যবসায় হাতে নেয়, সেগুলো হলো-
০১. দৈনন্দিন জীবনে ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সহযোগিতা করা,
০২. কোলাটেরলবিহীন লোনের একটি ধারা তৈরি করা,
০৩. তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কিছু অর্থের ব্যবস্থা করা এবং
০৪. ক্যাশ ছাড়া কেনাকাটা করার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
যেসব কারণে একটি ডেবিট কার্ড গ্রাহককে আকর্ষণ করে সেগুলো হলো-
০১. যেকোনো সময়ে ক্যাশ টাকার প্রয়োজন মেটানো সম্ভব,
০২. কেনাকাটার জন্য ডেবিট কার্ড ব্যবহার করা যায়,
০৩. সাথে ইলেকট্রনিক মানি বহনের ঝুঁকি কম এবং
০৪. বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় সব শহর ও উপশহরাঞ্চলে এটিএম মেশিন দেখা যায়। তাছাড়া বড় বড়
বিপণিবিতানে রয়েছে পিওএস মেশিন, যার মাধ্যমে অবাধে পেমেন্ট করা যায়।
তারপরও বলব, এ দেশে ডেবিট কার্ডের বিস্তার ততটা ঘটেনি। কারণ, ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে নিজের টাকাই খরচ করতে হয়। আর অন্যদিকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণের টাকা খরচ করা যায় ও একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেমেন্ট করে দিলে বাড়তি সুদ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং ঋণের টাকা খরচ করেও সুদবিহীন পেমেন্টের সুবিধা থাকায় ক্রেডিট কার্ড এ দেশের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে ক্রেডিট কার্ড প্রকৃতপক্ষে আমাদের খরচের হাতকে বাড়িয়ে দেয়। নিজের সঙ্গতি না থাকা সত্ত্বেও খরচের একটি সুযোগ ক্রেডিট কার্ড তৈরি করে দেয়, যা আমাদের সার্বিক জীবনযাপনের খরচ নির্বাহের ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক। এই কারণে অনেক সাশ্রয়ী বা মিতব্যয়ী লোক সারাজীবনই ক্রেডিট কার্ড এড়িয়ে চলেন। যাই হোক আমাদের আলোচনার বিষয় ডেবিট কার্ড। সুতরাং ডেবিট কার্ডের নানা বিষয় নিয়ে আমরা ব্যবচ্ছেদ করব।
আমাদের দেশের লোকজনের মধ্যে সচেতনতার অভাব প্রবল। তাই ডেবিট কার্ডে কাজ করতে গিয়ে ব্যাংকারেরা হিমশিম খায়। তার কিছু কারণ হলো-
০১. কার্ড ও পিনের (৪ ডিজিটের একটি গোপন নম্বর) সিকিউরিটি সম্পর্কে গ্রাহকেরা একেবারে আনাড়ি। অনেক সময় গ্রাহকের অসাবধানতা বা খামখেয়ালিপনার কারণে একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যজন অসাধু উপায়ে টাকা তোলার সুযোগ পায়;
০২. অনেক গ্রাহক গোপন নম্বরটি (পিন নম্বর) নিজের ডায়রি, মোবাইল ফোন ইত্যাদি স্থানে সংরক্ষণ করে থাকে। ফলে সহজেই তা অন্য যেকোনো কারো নজরে চলে আসে ও পরে দেখা যায়, এই নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তি তুলে নিয়ে যাচ্ছে;
০৩. গ্রাহকদের বলা আছে, প্রয়োজনে তারা এটিএম বুথের ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারেন। ফলে তারা খুব দ্রুত সর্বপ্রথমেই ব্যাংকের কাছে ভিডিও ফুটেজ চেয়ে বসেন। এতে ব্যাংকের কাছে একই সাথে অনেক ভিডিও ফুটেজের জন্য আবেদন চলে আসে যা ম্যানেজ করতে ব্যাংকারদের হিমশিম খেতে হয় এবং
০৪. তাছাড়া এটিএম অপারেশনের বিষয়গুলো বিস্তারিত না জানার কারণে গ্রাহকেরা প্রায়ই ঝামেলায় পড়ে ও সাহায্যের জন্য ব্যাংকের হেল্প ডেস্কে ফোন দিতে থাকে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে এটিএম সার্ভিস হলো ডেবিট কার্ড অপারেশনের মূল চালিকাশক্তি, সেটাকে ঠিক রাখার জন্য ব্যাংকের একটি হেল্প ডেস্ক থাকা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে ডেবিট কার্ড গ্রাহকরা ২৪/৭ সেবা পেয়ে থাকে। এই হেল্প ডেস্ক সাধারণত কলসেন্টারে কাজ করা প্রশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কাজ করে থাকে। হেল্প ডেস্ক সামলানোর জন্য একজন কর্মীকে যেসব কাজ করতে হয় তা হলো-
০১. অবশ্যই যে গ্রাহক ফোন কল করেন তার সমস্যাগুলো ধৈর্যসহকারে শুনতে হয় ও তা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হয়;
০২. সমস্যাটি একটি রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করতে হয়;
০৩. গ্রাহক যেন তাৎক্ষণিকভাবে এটিএম থেকে কার্ডের মাধ্যমে টাকা পেতে পারে সে জন্য তাকে সাহায্য করতে হবে অর্থাৎ তার কর্তব্যকাজের জন্য উপায় বাতলে দিতে হবে এবং
০৪. আর যদি সমস্যাটি তাৎক্ষণিক সমাধান না করা যায়, তাহলে তার যোগাযোগের নম্বরটি টুকে রেখে যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাটির সম্ভাব্য সমাধান তাকে ফোন কল করে পরে জানিয়ে দিতে হবে।
এজন্য একজন হেল্প ডেস্ক সাহায্যকারীর অবশ্যই কতগুলো গুণ থাকতে হবে-
০১. খুব খেয়াল করে গ্রাহকের সমস্যা শোনা,
০২. কোথাও না বুঝলে বারবার জিজ্ঞেস করে সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বুঝে নেয়া,
০৩. গ্রাহক অনেক সময় অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বললেও কোনো ধরনের বিরক্তি বা বাজে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করা,
০৪. গ্রাহকের সমস্যা শুনে তার সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা এবং
০৫. কথা বলার পর গ্রাহক যাতে সার্ভিস বা সেবা পেলেও অখুশি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা ইত্যাদি।
আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোতে মানবসম্পদ উন্নয়ন বা প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় খুবই সীমিত। ফলে প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাব সর্বদাই একটা সমস্যা হিসেবে থাকে ব্যাংকগুলোতে। তবে ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড অপারেশনের জন্য একটি সুদক্ষ হেল্প ডেস্ক টিম থাকা দরকার, যার মাধ্যমে গ্রাহকদের ২৪/৭ সেবা নিশ্চিত করা দরকার। নতুবা গ্রাহক ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ, ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি খুবই প্রতিযোগিতাময় একটি খাত। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অবশ্যই প্রত্যেক কার্ড ব্যবসায়ে নিয়োজিত ব্যাংকের ভালো সাপোর্ট টিম থাকতে হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন পত্রিকায় দেখা যায় ডেবিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন হিসাব থেকে টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে। এর পেছনে যেসব কারণ থাকতে পারে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
০১. একশ্রেণীর অসাধু চক্রের মাধ্যমে নকল কার্ড তৈরি।
০২. গ্রাহকের কার্ড ও পিন চুরি করে ব্যবহার করা।
০৩. অথবা ব্যাংক থেকেই ভুল গ্রাহকের কাছে কার্ড ডেলিভারি হওয়া ইত্যাদি।
তবে অনেক গবেষণা করে ও বাস্তব ঘটনায় দেখা গেছে এই বিষয়টি প্রায় সম্পূর্ণই জালিয়াতি চক্রের কারবার। ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর এর সাথে কোনো সংযোগ বা যোগাযোগ নেই। কারণ, সততাই ব্যাংকের সবচেয়ে বড় পুঁজি। ব্যাংক যদি অসৎ উপায়ে গ্রাহকের অর্থ হাতাতে পারত, তাহলে কেউই ব্যাংকে টাকা রাখতে পারত না। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেখা গেছে ব্যাংকই সাধারণ মানুষের কাছে অর্থ সংরক্ষণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারাবার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ভিত্তিতে এবং যুগ যুগ ধরে ব্যাংক এই বিশ্বাস রক্ষা করে চলেছে বিশ্বজুড়ে। এ দেশেও কখনই এর ব্যতিক্রম ঘটবে না এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে প্রচলিত ডেবিট কার্ডগুলোর মধ্যে মোটামুটি দুটি ভাগ দেখা যায়। একটি নিজস্ব ডেবিট কার্ড আর অন্যটি ব্র্যান্ডেড কার্ড (যেমন- মাস্টার কার্ড, ভিসা কার্ড ইত্যাদি)। এখন পর্যন্ত এ দেশে প্রচলিত ব্যাংকের নিজস্ব কার্ডের মধ্যে এটিএম কার্ডই প্রধান। এটিএম কার্ডটি মূলত এটিএম মেশিনে ব্যবহারের জন্যই ইস্যু করা হয়। আর যেটি সম্পূর্ণ ডেবিট কার্ড সেটি এটিএম এবং পিওএস- এই দুটিতে সমানভাবে ব্যবহার করা যায়। পিওএসে ব্যবহার করার সুবিধা থাকার কারণে তাই মাস্টার কার্ড ও ভিসা কার্ড ডেবিট কার্ড হিসেবে আমাদের ব্যাংকগুলো ব্যাপকভাবে ইস্যু করছে। এই কার্ডগুলো ব্যবহারের জন্য সাধারণত গ্রাহককে একটু বেশি Issuing charge ও বার্ষিক সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। তবে এর সবই সুন্দরভাবে পিওএসে ব্যবহার করা যায়।
কজ ওয়েব