গত ৩ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হলো ২০তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এ নিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়েছে এ দিনটি। বাংলাদেশও যথাযোগ্য গুরুত্বের সাথে দিনটি পালন করে।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদের ব্যক্তিগত আগ্রহে আমাকে ছুটে আসতে হয় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়। কারণ প্রধানমন্ত্রী সমীপে উপস্থাপন করতে হবে প্রতিবন্ধী মানুষ, বিশেষ করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ কী করে কমপিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে। আমার সাথে ছিল আমার প্রিয় নেটবুক, মাল্টিমিডিয়া। প্রধানমন্ত্রীর যাতে শুনতে অসুবিধা না হয় সেজন্য ছোট একটি সাউন্ড বক্স। পাঠকদের বোঝার জন্য বলে রাখি-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কমপিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য আছে স্ক্রিন রিডিং সফটওয়ার, যা শব্দের মাধ্যমে কমপিউটার স্ক্রিনে থাকা সবকিছু পড়ে শোনায়। আর এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে অন্যদের মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা কমপিউটার ব্যবহার করতে পারে। গত দশ বছরে প্রতিবন্ধী ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি আমি। আর ভাবনা, এক কোটি পঞ্চাশ লাখ প্রতিবন্ধীর তথ্য ও যোগাযোগের প্রযুক্তিতিতে অংশ নেয়ার অধিকারের দাবি তুলে ধরা।
প্রধানমন্ত্রী এলেন। আমি দ্রুত আমার উপস্থাপনা শুরু করি। প্রথমেই উপস্থাপন করি বাংলাদেশ জাতীয় ওয়েব পোর্টাল- www.bangladesh.gov.bd
বিভিন্ন লিঙ্ক ভিজিট করে আমি প্রধানমন্ত্রীকে দেখাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে বললাম, দেখুন এটিই বাংলাদেশের ম্যাপ। মনে হলো প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন না। আমি চোখে দেখতে পাই না। বললাম, আমি কিন্তু দেখতে পাই না। সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন-‘এটি যে বাংলাদেশের ম্যাপ তা কিভাবে বুঝলে?’ পাঠকদের জন্য বলে রাখি, জাতীয় ওয়েব পোর্টালের নিচের দিকে বাংলাদেশের ম্যাপ আছে, যা আমার স্ক্রিন রিডার আমাকে পড়ে শোনাচ্ছিল। আমি বারবার প্রধানমন্ত্রীকে তাই শুনাচ্ছিলাম ‘ম্যাপ অব বাংলাদেশ’। সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীকে জানাই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত এটুআই প্রোগ্রাম কিভাবে প্রতিবন্ধী মানুষকে তাদের সেবার কাজে লাগানো যায়। এক ফাঁকে এও জানাই, স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান ইপসা এটুআই কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছি। প্রধানমন্ত্রীকে বলি, জাতীয় তথ্যকোষটি প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যবহারোপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে-www.infokosh. bangladesh.gov.bd। এ ছাড়া জাতীয় তথ্যকোষে রয়েছে অডিও, ভিডিও, অ্যানিমেশন ই-টেক্সট। এগুলো বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীকে তথ্য পাওয়ায় সহায়তা করবে। প্রধানমন্ত্রী বললেন-আমি আনন্দিত, আরো বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষ যাতে ডিজিটাল বাংলাদেশের সেবা পায় নিশ্চিত করতে হবে।
দ্রুত উপস্থাপন করি কিভাবে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ই-মেইল ব্যবহার করে। বললাম, আমরা অন্য সবার মতোই ই-মেইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করি। এজন্য একমাত্র বাধা হলো, আমাদের সবকিছু ইংরেজি করতে হয়। কেননা এখনও বাংলা স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার তৈরি হয়নি। তবে এজন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে উদ্যোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি জানি’।
এরপরই উপস্থাপন করি ডেইজি ডিজিটাল টকিং বুক। তথা ডেইজি ডিজিটাল অ্যাকসেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম যা কমপিউটারভিত্তিক বহুমাত্রিক মাধ্যমের জন্য একটি উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক মানদন্ড।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি Full text Full Audio (They think I works in Garments) বইটি উপস্থাপন করি। প্রধানমন্ত্রী এই বইটি পড়তে ও শুনতে পান। আমি ডিজিটাল টকিং বুকের বিস্তারিত তুলে ধরি। তাকে বলি, ছাপানো বইয়ের সব সুবিধা ডিজিটাল টকিং বুকে পাওয়া যায়। এই বইয়ে হেডিং সাব হেডিং, পৃষ্ঠা লাইন, বে লাইন পাওয়া যায়। আবার পড়া যায়, বুকমার্ক করা যায়, বইয়ের পড়ার গতি কমানো-বাড়ানো যায় এবং এই ডিজিটাল টকিং বুক সবার উপযোগী। পুরো উপস্থাপনাটি খুবই আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
উপস্থাপনের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীকে বলি হুইল চেয়ার আর সাদাছড়ির পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ল্যাপটপ কি দেয়া যায় না? প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, ‘ভালো কথা-অবশ্যই আগামীতে ল্যাপটপ দেয়া হবে।’
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় একটি আইন করা হচ্ছে। সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তাদের এগিয়ে নিতে সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে। সমাজ ও পরিবারের কছে প্রতিবন্ধীরা বোঝা হবে না। এরা হবে সম্পদ। তাদের এগিয়ে নিতে আমরা সব ধরনের সহায়তা করব।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি দেখে আসলাম একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি কত দক্ষতার সাথে কমপিউটার ব্যবহার করছে।’ এই লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের সময়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিবন্ধীকে সরকারি চাকরি দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাকরির বয়সসীমা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কিছুটা শিথিল করে প্রতিবন্ধীদের চাকরির ব্যবস্থা করছি।
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এবারের প্রতিবন্ধী দিবসের পতিপাদ্য-‘উন্নয়নে সম্পৃক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি : সবার জন্য সুন্দর এক পৃথিবী।’
অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্ব শুরুর আগেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দশজন প্রতিবন্ধীর মধ্যে দশটি হুইল চেয়ার এবং পাঁচটি শ্রবণযন্ত্র বিতরণ করা হয়। অন্যদের মধ্যে সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সভাপতি খন্দকার জহিরুল আলম এবং সমাজকল্যাণ সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। পরে প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের পরিবেশনায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
এ শতাব্দীর প্রথম মানবাধিকার দলিল জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদের সাম্প্রতিক অগ্রগতি। এই সাম্প্রতিক অগ্রগতি হলো বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা। এই সনদ অনুস্বাক্ষর করায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমঅধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই সনদের ভূমিকায় শরিক রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও সুনির্দিষ্ট ধারায় (ধারা ৯) আইসিটির সুযোগ পাওয়া ও ব্যবহারের অধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। (ww.un.org/esa/socdev/enable)
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : vashkar79@hotmail.com