স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবটুকুই যেনো আমাদের জন্য বরাবরের। ফলে জাতি হিসেবে অভাব আমাদের পায়ে পায়ে। পরনির্ভরশীল আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। অথচ দুঃসহ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটা পথ আমাদের জন্য বরাবর খোলা ছিল। সে পথ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথ। সে পথ তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়ক। কিন্তু আমরা সে পথে পা রাখিনি। সে মহাসড়ক ধরে চলবার দূরদর্শিতা দেখাতে পারিনি। ফলে আমাদের জাতীয় অগ্রগমন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঘটেনি। বিষয়টি যেকোনো সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য পীড়াদায়ক। তেমনি একজন মানুষ ছিলেন মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি জগতের প্রেরণাপুরুষ অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদের। তার সম্যক উপলব্ধি ছিল বাংলাদেশকে দ্রুত সামনে এগিয়ে নিতে হলে মোক্ষম হাতিয়ার হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো গত্যন্তর নেই।
সে উপলব্ধিতাড়িত হয়েই তিনি আজ থেকে একুশ বছর আগে ১৯৯১ সালের মে মাসে সূচনা করেন মাসিক কমপিউটার জগৎ প্রকাশনা। এর প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রথম সাময়িকীরই শুধু সূচনা করেননি, সেই সাথে সূচনা করেন একটি আন্দোলনের। এ আন্দোলন এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে সামনে এগিয়ে নেয়ার আন্দোলন। কমপিউটার জগৎ-এর চলতি সংখ্যাটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কার্যত আমরা উদযাপন করছি এর একুশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। এটি আমাদের সবার জন্য এক আনন্দের বিষয়। আজকের এই আনন্দের দিনে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমাদের প্রতিষ্ঠাতা ও এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের প্রেরণাপুরুষ অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদেরকে। সেই সাথে কামনা করছি তার আত্মার মাগফিরাত। প্রার্থনা জানাই আল্লাহ তার সহায় হোন।
এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট সবাই জানেন এবং অকপটে স্বীকার করেন মরহুম আবদুল কাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে অসমান্তরাল অবদান রেখে গেছেন। তার অবদানসূত্রেই তিনি বাংলাদেশে সব মহলে অভিহিত হচ্ছেন ‘বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক’ অভিধায়।
মরহুম আবদুল কাদের মনে করতেন বরং বলা ভালো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মাসিক কমপিউটার জগৎ শুধু একটি পত্রিকা নয়, একটি আন্দোলনের নামও। একটি পত্রিকা হতে পারে আন্দোলনের বাহন। আর সে বিশ্বাসের ওপর ভর করেই তিনি কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম করেন- ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’। এ দাবিধর্মী প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের মাধ্যমেই কার্যত তিনি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নেয়ার আন্দোলনের সূচনা করেন। সেই যে শুরু, আমৃত্যু ছিলেন সে আন্দোলনের সাথেই। আমরা যারা এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম, তাদের তিনি ছিলেন প্রেরণাপুরুষ। সামনের সারিতে এসে নিজেকে প্রকাশ্যে নয়, পেছনে থেকে অন্যদের প্রতি প্রেরণা আর সাহস জোগানোতেই তার আগ্রহ ছিল সমধিক। কারো কারো মতে, এ ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল নেপথ্য-নায়কের।
ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে নির্মোহ এই অধ্যাপক আবদুল কাদেরের জন্ম ঢাকায়, ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তিনি আমাদের ছেড়ে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ২০০৩ সালের ৩ জুলাই। বাবা মরহুম আবদুস সালাম। সরল জীবনযাপন আর উঁচু মাপের চিন্তা-চেতনার ধারক এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন অধ্যাপক কাদের। লেখাপড়ার শুরু ঢাকার নওয়াবগঞ্জের নবাববাগিচা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৪ সালে ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল থেকে এসএসসি। ১৯৬৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে বি.এসসি এবং ১৯৭০ সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিষয়ে এম.এসসি। তিনি বেশ কিছু প্রশিক্ষণ কোর্সও সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে আছে- ঢাকা বিএমডিসি থেকে পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট কোর্স এবং ঢাকার সাভারের বিপিএটিসি থেকে উন্নয়ন প্রশাসন কোর্স। এ ছাড়া নিয়েছিলেন কমপিউটারবিষয়ক ২০টি অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামের ওপর প্রশিক্ষণ। শিখেছিলেন বেশ কয়েকটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজও।
কর্মজীবন শুরু ১৯৭২ সালের ১ অক্টোবরে সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রভাষক হিসেবে। পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এ কলেজে ছিলেন ১৯৯৫ সালেস ২ আগস্ট পর্যন্ত। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে চলে যান সরকারি পটুয়াখালী কলেজে। সেখান থেকে তাকে নবায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-পরিচালক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের কমপিউটার সেলের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়। সেখানে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত। এরপর তিনি দায়িত্ব পান এই অধিদফতরের নির্বাচিত সরকারি কলেজে কমপিউটার চালুকরণ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে। ২০০০ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি অসুস্থতার জন্য ছুটি কাটান। ছুটি শেষে এ অধিদফতরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ দায়িত্ব হিসেবে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন এ অধিদফতরের প্রশিক্ষণবিষয়ক উপপরিচালক।
কজ ওয়েব