সাশ্রয়ী মূল্যের দেশী ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ দোয়েল সর্বসাধারণের হাতের নাগালে না পৌঁছলেও এবার ট্যাবলেট পিসি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে টেলিফোন শিল্প সংস্থা তথা টেশিস। পাশাপাশি বাজারজাত করার পূর্ণ প্রস্ত্ততি নিচ্ছে উৎপাদন বন্ধ থাকা প্রাইমারি মডেলের দোয়েল ল্যাপটপ। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় আবারও বাজারে আসছে এই ল্যাপটপটি। তবে এবারের মডেলটি আগের তুলনায় মানসম্পন্ন। আর গুণগত মান বাড়ার কারণে দামও কিছুটা বাড়তে পারে।
টেশিস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ টিমের পরামর্শেই প্রাইমারি মডেলটির উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। এ দলটি বর্তমানে প্রাইমারি মডেলের ল্যাপটপের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। নতুন মডেলে পূর্ণাঙ্গ ল্যাপটপের সুযোগ-সুবিধা সংযোজন করার প্রক্রিয়া চলছে। আগে এতে সিডিরম না থাকলেও এটি ছাড়া আরও কিছু নতুন সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে আগের দামে এ ল্যাপটপ বাজারজাত করা সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ খান জানান, দাম বাড়ানোর ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই বোঝা যাবে দাম বাড়বে কি না। তবে বাজারের কারণে দাম কিছুটা বাড়াই স্বাভাবিক বলে তার অভিমত ।
অপরদিকে ভোক্তাদের কাছে সবচেয়ে আরাধ্য দোয়েল বেসিক মডেলের নেটবুকটির ব্যাটারি সমস্যা সমাধানে এতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষমতার ব্যাটারি যুক্ত করা হচ্ছে। তবে আগের মতোই এতে অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে থাকছে উইন্ডোজ।
দেশী ব্র্যান্ডের দোয়েল ল্যাপটপ উৎপাদক বাংলাদেশ টেলিফোন শিল্প সংস্থা তথা টেশিস ২০১১ সালে স্বল্পমূল্যের তিনটি মডেলের ল্যাপটপ বাজারে আনে। গুণগত মান দুর্বল হওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা প্রাইমারি মডেলের স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ কিনে বেকায়দায় পড়েন। এজন্য ইতোমধ্যে দরপত্রও আহবান করা হয়। গত ১৫ মার্চ দরপত্র খোলা হয়। এই কার্যপত্র দেয়ার আনুষ্ঠানিকতার সব কাজ শেষে দোয়েল ল্যাপটপের চলমান সঙ্কট কমানোর পাশাপাশি শুরু হবে নতুন এ প্রকল্পের কাজ। ফলে আগামী অর্থবছর বা জুলাইয়ের আগে দোয়েল ট্যাবলেট পিসি বাজারে আনা শুরু করা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজারে দোয়েলের আকাল, বিদ্যমান ল্যাপটপগুলোর নানা ত্রুটি, হার্ডডিস্ক সঙ্কটে উৎপাদন বন্ধ থাকা এবং বাজার চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য পদক্ষেপ সম্পর্কে আলাপের সময় এসব কথা জানিয়েছেন টেশিসের মহাব্যবস্থাপক (প্লান্ট) আ আ মো: মোয়াসির। তিনি বলেছেন, বেসিক মডেলের দোয়েল নেটবুকের ব্যাটারি গরম হওয়ার বিষয়টি আমলে নিয়েই এটি বাজারে ছাড়া হয়নি। একইসঙ্গে অভিজ্ঞদের পরামর্শে এটিতে উইন্ডোজের বদলে অ্যান্ড্রয়িড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান টেশিসের দোয়েল ল্যাপটপ প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ ফেরদৌস। তার ভাষায়, দোয়েল ল্যাপটপ গরমের বিষয়ে যতটা অভিযোগ রয়েছে তা পুরোপুরি ঠিক নয়। সব ব্র্যান্ডের ল্যাপটপেই এমনটা হয়ে থাকে। দোয়েল ল্যাপটপের অ্যাসেম্বলিং সিস্টেম দেখানোর ফাঁকে তিনি জানান, মূলত ছোট ও পাতলা আকারের ডিজাইন হওয়ার কারণেই এটি অপেক্ষাকৃত বেশি গরম হয়।
টেশিস ভবনে দোয়েল ল্যাপটপ উৎপাদন কাজ পরিদর্শনের সময় একান্ত আলাপচারিতায় নিজেদের নানা সীমাবদ্ধতা এবং অপারগতার কথা স্বীকার করে মোয়াসির জানান, এমন একটি বৃহৎ প্রকল্পে আমরা একেবারেই নতুন। বাংলাদেশে এর আগে এত বড় পরিসরে প্রযুক্তি খাতে কোনো কাজ হয়নি। ফলে প্রথম পর্যায়ে আমরা অনেক কাজই জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী করতে সক্ষম হইনি। তবে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হয়নি। এজন্য আমরা এ খাতে সবার সহায়তা কামনা করি। আশা করছি চলতি বছরের আমরা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হব।
এ জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করছি আগামী জুলাই মাস নাগাদ আমরা ল্যাপটপের চেয়েও কম মূল্যে ট্যাবলেট পিসি বাজারে ছাড়তে সক্ষম হব। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে।
দোয়েল ট্যাবলেট পিসির দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশা করছি এগুলোর দাম ১০০ ডলার কিংবা ৯ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু দোয়েল ল্যাপটপই তো এখনও সর্বসাধারণের হাতের নাগালে পৌঁছেনি, এমন পরিস্থিতিতে আবার ট্যাবলেট পিসি উৎপাদনে যাওয়াটা কি প্রহসন নয়- এমন প্রশ্নের জবাবে টেশিস মহাব্যবস্থাপক (প্লান্ট) বলেন, দোয়েল ল্যাপটপ সাধারণ মানুষের হতে পৌঁছে দিতেই টেশিস উৎপাদন কারখানা ছাড়াও ইতোমধ্যে আমরা বিটিসিএল এক্সচেঞ্জ ক্যাম্পাস রমনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের দ্বিতীয় তলায় একটি সেলস সেন্টার চালু করেছি। আগামী মাসে শেরেবাংলা নগর টেলিফোন ভবন থেকেও এর বিক্রির কাজ শুরু হবে। একই সাথে ঢাকার বাইরেও বিক্রি শুরুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
টঙ্গী এবং রমনা বিক্রয় কেন্দ্রের কোথাও তো দোয়েল প্রাইমারি মডেলের ল্যাপটপ পাওয়া যাচ্ছে না- এমন অভিযোগ স্বীকার করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই কেউ কেউ হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়ে লিখেছেন, দোয়েল ল্যাপটপ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। আসলে উৎপাদনের কাজ বরাবরই সচল রয়েছে। মূলত সংসদীয় কমিটির সুপারিশের কারণেই সাময়িকভাবে প্রাইমারি মডেলের দোয়েল ল্যাপটপ বাজারজাত না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। আর ল্যাপটপটি অ্যান্ড্রয়িড অপারেটিং সিস্টেম হওয়ায় এবং এটা আমাদের দেশে ব্যবহারবান্ধব না হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, ১০ হাজার টাকার ল্যাপটপে (প্রকৃত দাম ১০ হাজার ৮০০ টাকা) বেশি সমস্যা দেখা দেয়ায় এটির উৎপাদন ভবিষ্যতেও আর করা হবে না। অবশ্য এ বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে টেশিসের মহাব্যবস্থাপক জানান, টেশিসের বোর্ডসভায় ২৩ হাজার পিস হার্ডডিস্ক কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি এখন দরকষাকষির পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই এ বিষয়ে বোর্ড মিটিংয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে। অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সঙ্কট মেটাতে ৭ হাজার পিস হার্ডডিস্ক কেনা হচ্ছে।
সূত্রমতে, সাড়ে ১৩ হাজার টাকা দামের সেকেন্ডারি মডেলের জন্য ৫ হাজার এবং ২৬ হাজার ৮০০ টাকা দামের অ্যাডভান্স মডেলের জন্য ২ হাজার হার্ডডিস্ক কেনা হবে। বোর্ডসভায় সেকেন্ড অ্যাসেম্বলিং লাইন (কনভেয়ার বেল্ট) কেনারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব শিগগির কনভেয়ার বেল্ট এলে ল্যাপটপের উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে টেশিস কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, গত বছর থাইল্যান্ডের বন্যায় সে দেশের হার্ডডিস্ক শিল্পকারখানায় পানি ঢুকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিশ্ববাজারে হার্ডডিস্কের সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ টেলিফোন শিল্প সংস্থা তথা টেশিসের দোয়েল ল্যাপটপ উৎপাদন কাজেও প্রভাব পড়েছিল। দোয়েল ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা চীনা কোম্পানি ইয়াং মিল ওয়ার্ল্ড টেকনোলজি সম্প্রতি স্বল্পসংখ্যক হার্ডডিস্ক পাঠিয়েছে। উৎপাদন কাজ ১৫ থেকে ২০ দিন বন্ধ থাকার পর গত ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই পূর্ণোদ্যমে সংযোজনের কাজ চলছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রথম স্লটে ১০ হাজার ৭০০ হার্ডডিস্ক আমদানি করা হয়। ওই হার্ডডিস্কের মজুদ শেষ হয়ে গেলে চীনা প্রতিষ্ঠানের ৪ হাজার ৫০০ হার্ডডিস্ক পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পাঠিয়েছে ১ হাজার ৭০০ পিস হার্ডডিস্ক। টেশিস এই সংখ্যক হার্ডডিস্ক গ্রহণ করবে কি করবে না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে। অবশেষে এই সংখ্যক হার্ডডিস্কই ছাড় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মডেমের বিষয়ে তিনি বলেন, এর সফটওয়্যারে সমস্যা আছে। আমরা গ্রামীণফোনের সাথে আলাপ করেছি। এটার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি জানান, আমরা দোয়েলের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি। শিগগিরই এসবের সমাধান করা সম্ভব হবে।
তারপরও দেশী ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ ‘দোয়েল’ নিয়ে দেশের সাধারণ প্রযুক্তিপ্রেমীদের প্রত্যাশা বাড়ছেই। বাস্তবে এ ব্র্যান্ড নিয়ে তৈরি হয়েছে গ্রাহক হতাশা। চারটি মডেল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এরই মধ্যে সবচেয়ে কমমূল্যের ‘দোয়েল-২০১২’ মডেল কার্যত বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে। শুধু উদ্বোধনের জন্য এই মডেলের হাতেগোনা ১০টি স্যাম্পল পিস তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ৫টি বণ্টন করা ছাড়া একটিও আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রি করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে টেশিস।
কিন্তু দোয়েল উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ সংস্থা টেশিস দোয়েল বিক্রির জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া না হলেও প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জববারের স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠান আনন্দ কমপিউটার্সের মাধ্যমে বাজারে টেশিস ছাড়াও দোয়েল বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগের পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিজেদের দায় স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর থেকে সরকারের নির্ধারিত দুটি আউটলেট থেকে দোয়েল ‘অ্যাডভান্সড-১৬১২’ মডেল ২৬ হাজার ৮০০ টাকায় (কালো রং) এবং দোয়েল ‘স্ট্যান্ডার্ড-২৬০৩’ মডেল ২০ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি মডেলেরই রয়েছে লাল রংয়ের ক্যাসিংসম্পন্ন আরেকটি সংস্করণ। রংয়ের ভিন্নতার কারণে এগুলোর দাম ৩০০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোয়েল ল্যাপটপের বিপণন কার্যক্রম উদ্বোধন করার পরপরই ১০ হাজার টাকায় স্বল্পসংখ্যক নেটবুকের বিতরণ শুরু হলেও কার্যত এর নাগাল পায়নি সাধারণ মানুষ। আর এর জন্য নিজেদের সব সক্ষমতা থাকলেও চলতি মূলধনের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না। এ মুহূর্তে প্রতিদিন টেশিসের এই প্লান্টটিতে বিভিন্ন মডেলের প্রায় ২০০ পিস ল্যাপটপ তৈরি হচ্ছে।
সূত্রমতে, এই প্লান্টটিতে উৎপাদন ক্ষমতা মাসে ৩০ হাজার থাকলেও ১০ থেকে ১৫ হাজারে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০ হাজার ৫০০ পিস কোরআই৩ দোয়েল ল্যাপটপের উৎপাদনের কার্যপত্র পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে এ মুহূর্তে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে টেশিসের দোয়েল ল্যাপটপ উৎপাদন কার্যক্রম।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টেশিস ভবনের তৃতীয় তলার এই প্লানটিতে এখন এসকেডি তথা সেমি নকড ডাউন পদ্ধতিতে উৎপাদনের কাজ চলছে। সাতটি ভিন্ন ভিন্ন সেকশনে বিভক্ত হয়ে ৭৬ জন তরুণ বিভিন্ন কম্পোনেন্ট জোড়া দিয়ে তৈরি করছেন দোয়েল ল্যাপটপ। এই কারিগরি কাজের দেখভাল করছেন মালয়েশিয়ার নাগরিক দোয়েল ল্যাপটপ প্লান্টের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক জোসেন ইউ। তিনি জানান, এই প্লানটিতে কর্মরত প্রত্যেকেই দারুণ নিষ্ঠাবান। তাদের কাজ শেখার প্রতিও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। তাই একেবারে অভিজ্ঞতাহীন একঝাঁক তরুণকে নিয়ে কাজ শুরু করলেও আমরা বেশ ভালোভাবেই কাজ করতে পারছি।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : netut@gmail.com