• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > কত উচ্চতায় উঠতে পারি আমরা
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: আবীর হাসান
মোট লেখা:১৫০
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১২ - সেপ্টেম্বর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ফিচার
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি বিপ্লব
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
কত উচ্চতায় উঠতে পারি আমরা

আমাদের ছেলেরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে উঠেছে। মেয়েরাও উঠেছে। যদিও আমি এই আক্ষরিক উচ্চতায় ওঠার কথা এখানে বলতে চাচ্ছি না-বলতে চাচ্ছি ‘মেধার উচ্চতায়’ ওঠার কথা। কারণ সাম্প্রতিক কিছু তথ্য আমাদের কিছু ‘হয় না-হবে না!’ এমন ধারণার বাইরে নিয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অর্থাৎ আইএমওতে প্রথমবারের মতো রৌপ্যপদক জিতেছে বাংলাদেশ। এদিকে হিগ্স-বোসন কণা বা ‘ঈশ্বর কণা’র সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি বাঙালি তরুণদের যে আরও কৌতূহলী ও অহঙ্কারী করে তুলেছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ হচ্ছে বোসন কণা যার নামে তিনি একজন বাঙালি গণিতবিদ। যিনি ছিলেন আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পড়াতেই তিনি অণু-পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক একটি গণিতের ভ্রম সংশোধন করেন। আলবার্ট আইনস্টাইন তখন স্বদেশ জার্মানিতে, বসু বিষয়টি তার গোচরে আনলে তেজস্ক্রিয় অতি পারমাণবিক কণা বিষয়ক গাণিতিক প্রমাণটি আইনস্টাইন শুদ্ধভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে রায় দেন। এর নামও তিনি দেন বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। পরে নববইয়ের দশকের মাঝামাঝি অতি পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় কণার সন্ধান পাওয়া গেল, যার নাম হলো বোসন কণা। অণু-পদার্থ বিজ্ঞানীরা বললেন, এই বোসন কণার মধ্যেই রয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির আদিরহস্য। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগ্স আইডিয়াটা যখন দিলেন তখনও তার সঙ্গে জুড়ে রইল সত্যেন বোসের নাম। হিগ্স-বোসন কণাই হলো ঈশ্বর কণা। সুইজারল্যান্ডের সার্নে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে গত জুন মাসে দুটি কণার সংঘর্ষ ঘটিয়ে প্রমাণ করা হলো হিগ্স-বোসন কণার অস্তিত্ব ‘প্রায় প্রমাণিত’। এখন সামনে চলার পালা অর্থাৎ জানা যাবে মহাবিস্ফোরণের রহস্য! জীবনের রহস্য এবং আরও কিছু!

এ পর্যন্ত সংবাদ এখন সবাই জানেন, তবে মাঝখানে আরও কিছু কাহিনী আছে, তা কল্পকাহিনী নয় বা নিছক গাল-গল্পও নয়। কিছুটা আগের কথা অবশ্য। নববইয়ের দশকের শুরুর দিকে। ইউরোপ ও আমেরিকায় পদার্থ বিজ্ঞানীরা বোসন কণা নিয়ে প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাদের সামনে দুটো সমস্যা ছিল। প্রথমত: গাণিতিকভাবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করা এবং বিশাল ল্যাবরেটরির খরচ চালানো। প্রথম সমস্যার সমাধান অনেকটাই করেছিল অত্যাধুনিক কমপিউটার। কিন্তু দ্বিতীয়টি? এর জন্য বিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হতে হলো রাজনীতিবিদদের কাছে-যারা বাজেট করেন-সব কিছুর খরচ মেটান। আর এটি এত বিশাল একটি ব্যাপার যে খরচের যৌক্তিকতা ঠিকমতো তুলে ধরতে না পারলে রাজনীতিবিদেরা মানবেন কেন। তার ওপর ল্যাবরেটরিটি হতে হবে বাইশ মাইল দীর্ঘ একটি টানেলকে নিয়ে আর তাতে স্থাপন করতে হবে বিশাল শক্তির একটি সংঘর্ষ ঘটানোর যন্ত্র। সংঘর্ষ কিসের? খালি চোখে দেখা যায় না এমন ‘বস্ত্তর’ সূক্ষ্ম কণা-প্রোটন। যন্ত্রটার নকশা যখন প্রথম করা হয়, তখন ওটাকে মনে হয়েছিল ভূগর্ভস্থ রেলপথে তৈরির জন্য মাটি খোঁড়ার যন্ত্রের মতো। আর মাটি খোঁড়ার আসল যন্ত্রও সেখানে অবশ্যই ব্যবহার হয়েছিল। বাইশ মাইল লম্বা টানেল। কিন্তু ওটা শুধু সুইজারল্যান্ডের সার্নেই তৈরি হয়নি, ওটার আগেই তৈরি হয়েছিল আটলান্টিকের পশ্চিম পারে-মার্কিন মুল্লুকে। সবাই ভেবেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারেই আগে প্রমাণিত হবে বোসন কণার অস্তিত্ব।

কিন্তু সত্যেন বোসের গাণিতিক সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করে অনেকে নোবেল পুরস্কার পেলেও সত্যেন বোস যেমন নোবেল পাননি তেমনি এই বোসন কণার ভাগ্যও যেনো বিড়ম্বিতই। হঠাৎ করেই ১৯৯৩ সালে মার্কিন সরকার সিদ্ধান্ত নিল ক্যালিফোর্নিয়ার লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বন্ধ করে দেয়ার। কারণ আয় কিছু নয়-ভয়। একদল বিজ্ঞানী বোঝালেন : দুটি অতি তেজস্ক্রিয় কণার সংঘর্ষে যদি সূর্যের তেজ উৎপন্ন হয়, তাহলে পৃথিবী ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। রক্ষণশীলদের হুশিয়ারিই জিতে গেল, মার্কিন কলাইডার বন্ধ হলো। তবে ইউরোপের সার্নের কাজ এগিয়ে চলল।

কিন্তু সমস্যাও ছিল, কাজে নেমে দেখা গেল অনেক বিজ্ঞানী দরকার আর তাদের জন্য দরকার প্রচুর কমপিউটারের শক্তি। প্রথম অবস্থাতে যখন টপ কোয়ার্ক বা মুক্ত বোসন কণা নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয় তখন অর্থাৎ ১৯৯৮ সাল নাগাদ সার্নের বিজ্ঞানীর সংখ্যা ছিল ১১০০-এর ওপরে। আর এরা এক দেশীয় ছিলেন না। ভারতীয় এবং চীনা বিজ্ঞানীদের সংখ্যাধিক্য ছিল বিস্ময়কর। সময় গডিয়েছে, বিজ্ঞানীর সংখ্যা আরও কিছু বেড়েছে। তবে আইসিটির শক্তি ও ক্ষমতা বাড়ায় সার্নের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বিজ্ঞানী নিজের দেশে বসেই অনেক জরুরি কাজ করেছেন-এখনও করছেন। সার্নের কাজ যে সবসময় নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছে তা নয়। মাঝেমধ্যে কলাইডার বিকল হয়েছে, কখনও কমপিউটার সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কমপিউটারগুলো মেধাবী নিয়ন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে বেশ ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, সার্নে ১১০০ বিজ্ঞানীর পাশাপাশি আরও প্রায় ৩০০ আইসিটি এক্সপার্ট কাজ করেন এখন। খরচ হয় বিলিয়ন বিলয়ন ডলার, যা জোগায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জনগণ।

বোসন কণার কাহিনীকে এ পর্যন্ত রেখে ‘উচ্চতায় ওঠা’র কথায় আসি। নিঃসন্দেহে সত্যেন বোস অতি উচ্চমাত্রায় উঠেছিলেন শুধু কী গণিতে? না সংস্কৃতির এবং রাজনীতিতেও! কিন্তু তারপর বাঙালি মেধার কী হল? সবকিছুকে নেতিবাচক হিসেবে না দেখতে চাইলেও বাস্তবতাটা অনুধাবন করতে হবে-গণিত এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পড়াশোনা যতটা হয়, তাতে মেধার বিকাশ এখানে এখন আর ততটা হয় না।

তাহলে দেশে সমস্যাটা কোথায়? আমরা আইসিটি নিয়েই কথা বলি, কারণ এ যুগটা আইসিটির। অনেকেই বলেছেন ডিজিটাল যুগের পেশার কথা। আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্রমাগত নতুন নতুন পেশার উদ্ভব হতে। আবার অনেক নতুন পেশা এসে পুরনো পেশাকে সরিয়েও দিয়েছে। যেমন আগেকার টাইপিস্ট নামের পেশাটাই এখন আর নেই।

নতুন পেশার মধ্যে বলা যায় অনেকগুলোর কথা-হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়্যার রাইটিং, ডাটা অ্যানালিস্ট, ওয়েব হোস্টিং, কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে বড় দাগের পেশা। এসবের সাথে জড়িয়ে উদ্ভব ঘটেছে আরো নানা ধরনের মাঝারি ও ছোটখাটো পেশার। এক ওয়েবেই তো কত কিছু হচ্ছে। বহুমাত্রিক ব্যবহার পেশার বিচিত্র এবং নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো রচনা বা প্রস্তাবনায় আমরা যেসব উদাহরণ তুলে ধরি সেগুলোর বেশিরভাগই বিদেশি। দেশি কিছু কিছু সাফল্য (সবচেয়ে সফল সম্ভবত গণমাধ্যম) তুলে ধরতে পারলেও বৃহত্তর পরিসরে সব ক্ষেত্রেই ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে। পেশাগত কাজকর্মে উপযুক্ত লোকবল পাওয়া যাচ্ছে, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। বিশেষত উচ্চতর পর্যায় বলে যেন আমাদের দেশে কিছু নেই। মূল সমস্যাটার সমাধান যেন সার্বিকভাবে হচ্ছে না।

এ দেশে আইসিটি নিয়ে পলিসি লেভেলে কথা বলতে গেলেই যে সমস্যাগুলো নিয়ে মূলত আলোচনা হয়, সেগুলো হলো-
০১. কম দামে কমপিউটার,
০২. ব্যান্ডউইডথ,
০৩. তৃণমূল পর্যায়ে কমপিউটার ও ইন্টারনেট পৌঁছানো,
০৪. ভিওআইপি এবং
০৫. থ্রিজি সার্ভিস।
অর্থাৎ পাঁচটি প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে আমাদের আবেগতাড়িত করে বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ে কমপিউটার আর ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো যেন অনেকটাই পরমার্থের সমার্থক হয়ে উঠেছে।

আইসিটির যে উচ্চতর একটা পর্যায় আছে এবং সেই পর্যায়ে গণিত সম্পর্কিত এবং সাইবারনেটিক্স সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা আছে, তা যেন আমরা বিস্মৃতই হই। ভাবিনা পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর সিএসই, ইইই ইত্যাদি ডিসিপ্লিনের যে গ্র্যাজুয়েটেরা বেরুচ্ছে তাদেরকে কী কাজে লাগানো হবে। যে পেশাগুলো প্রচলিত বা সাধারণ অর্থে প্রথায় পরিণত হয়েছে সেগুলোতে কিছু ছেলেমেয়ে যাবে, কিন্তু তাদের সংখ্যার বিপরীতে একটা ক্ষুদ্র আনুপাতিক সংখ্যা আছে, যেটা কোনো বছর ২ শতাংশ, কোনো বছর ৫ শতাংশ হয়ে যায় তাদেরকে কোথায় জায়গা দেবেন? এ ছাড়া গণিতের স্নাতকদের জন্যইবা কী সুযোগ আছে?

আর একটা প্রাসঙ্গিক কাহিনী বলি। না এটাও কল্পকাহিনী নয়-২০০৯ সালের কথা। সে বছরের মাঝামাঝি সিঙ্গাপুরে একটি গণিত অলিম্পিয়াড হয়েছিল অনূর্ধ্ব-১৫’র। সেখানে মার্কিন ছাত্রছাত্রীরা পেয়েছিল ৩১তম স্থান। নড়েচড়ে বসেছিল মার্কিন প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বয়ং বিষয়টি নিয়ে পড়লেন-জানতে চাইলেন শিক্ষকদের কীভাবে নিয়োগদান, প্রশিক্ষণ আর দক্ষতা যাচাই হয়। দেখা গেল প্রায় সব অঙ্গরাজ্যের স্কুলই শিক্ষকদের ৯৯ শতাংশকেই বছর শেষে সন্তোষজনক বলে সনদ দিচ্ছে রাজ্যগুলোর শিক্ষা মন্ত্রণালায়। ওবামা ও শিক্ষামন্ত্রী আরনে ডানকান মার্কিন শিক্ষকদের বৃহত্তম সমিতি এনইএ তথা ন্যাশনাল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনকে বললেন-বেশিরভাগ সিনিয়র শিক্ষককে দক্ষ ও ভালো বলে আমরা জানি, কিন্তু আমাদের সন্তানদেরকে আমরা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারি না। শুধু তাই নয়, এখন পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটাই ঢিলেঢালা নীতির জন্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।

তোলপাড় শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে, শিক্ষকদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ হলো কিছু। তদন্তও হলো, দেখা গেল শিক্ষক প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে গলদ আছে, যার ফলে মাত্র ৩০ শতাংশ শিক্ষক নতুন পদ্ধতি অনুধাবন করতে পারেন। আরও দেখা গেল কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের মাত্র ২৩ শতাংশ আসে শিক্ষকতা পেশায়। এসব সমস্যা সামনে রেখে ওই বছরই চালু করা হলো ‘নিউ টিচার্স প্রোগ্রাম’। সংস্কার শুরু হলো। আনা হলো এলিমেন্টারি অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন বিল। রিপাবলিকানরাও সমর্থন দিল এতে, ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামা আর ডানকানের প্রস্তাবে শুধু ‘শিক্ষিত’ নয়, জ্ঞানী শিক্ষকদের যোগ্যতা যাচাই প্রথা চালু হলো। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ভালো শিক্ষকদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা নেয়া হলো, মন্দদের ছাঁটাই করার ব্যবস্থা করা হলো। এসব কাজ শেষ হয়েছিল ছয় মাসেরও কম সময়ে। কিশোরদের একটি গণিত প্রতিযোগিতার সূত্র ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা সংস্কারের এই বিষয়টি যেকোনো দেশের জন্যই উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। আসলে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে ‘উচ্চতায় ওঠার’ আশা করলেই হয় না, উচ্চতায় ওঠানোর জন্য সার্বিক একটা চেষ্টাও লাগে। চেষ্টা যে এ দেশে একেবারে নেই তা বলা যাবে না, তবে চেষ্টার ফল কেন আশানুরূপ হয় না সেটাই প্রশ্ন। অর্থও তো বেশ ভালোই ব্যয় হয়-অন্তত আমাদের সঙ্গতির নিরিখে।

আমরা যে রাষ্ট্রীয়ভাবে-সামাজিকভাবে কী চাই এবং আশাটাইবা কী সেটা অনির্ধারিতই রয়ে গেছে এখন পর্যন্ত। আমরা ঢালাওভাবে বলি-‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থাকবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে।’ কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়বে কারা? নীতিগতভাবেই আমরা মেধার বিষয়টাকে এড়িয়ে যাই। আমাদের প্রধান ঝোঁকটাই তৃণমূলের দিকে এবং বাণিজ্যিক ফায়দা ওঠানোর দিকে। কখনও কখনও শিক্ষার মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে যায়। শিশুরা কমপিউটার খোলা-বন্ধ আর গেমিংয়ে অভ্যস্ত হলে আমরা পুলকিত হই। কিশোর-কিশোরীরা ফেসবুক ব্যবহার করতে পারলেই তাদেরকে স্মার্ট ভেবে বসি। মনে করি ই-লিটারেসি ভালোই বাড়ছে।

আসলে আমাদের সামনে বোধহয় কোনো সুনির্দিষ্ট মানদন্ড নেই। জ্ঞানের পরমটা কতদূর বা কত উচ্চতার সে সম্পর্কে দন্ড-মুন্ডের কর্তাদের সম্যক ধারণা নেই। সে জন্যই এখন পর্যন্ত গণিত-মেধাবীদের নিয়ে যা কিছু হয় সবই বেসরকারিভাবেই, রাষ্ট্র এসবের পৃষ্ঠপোষকতায় দায় অনুভব প্রায় করেই না।

সামনে কোনো রোল মডেল থাকলেও তার সম্যক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে কষ্ট হয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর একটি বক্তব্যে। হিগ্স-বোসন কণার সন্ধান পাওয়ার খবর যেদিন পাওয়া গেল তার ক’দিন পর সংসদে বাজেট অধিবেশনের শেষ দিকে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিচ্ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি এ দেশের শিক্ষার ঐতিহ্যের উদাহরণ দিতে গিয়ে ‘ঈশ্বর কণার’ কথা বললেন ঠিকই, কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামটি মনে আনতে পারলেন না-উচ্চারণও করতে পারলেন না।

দুঃখজনক উদাহরণ হিসেবে এ ধরনের ঘটনাকে ভোলা বা উপেক্ষা করা যাবে না, তবে ব্র্যাকেটিং করেই রাখতে হবে। কারণ দৃষ্টি রাখতে হবে সামনের দিকে। অতীতের ঐতিহ্যের ওপরই বর্তমানের চলিষ্ণুতা আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার বিষয়গুলো নির্ভরশীল। সবচেয়ে খারাপ লাগে মেধাবীদের কর্মকান্ডের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীরবতায়। এই যে আর্জেন্টিনার মারডেল প্লাটায় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রথম রৌপ্যপদক অর্জন করল বাংলাদেশের ছেলেরা-এদেরকে সরকার কতটা সহায়তা করেছে কিংবা মূল্যায়নইবা কতটা করেছে। আর এটাই তো প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা আশাতীত ভালো ফল করেছে, কিন্তু রাষ্ট্রের কোথাও কিছু নড়েনি। ক্রিকেটারদের উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি এই মেধাবীদেরও উৎসাহ দেয়াটা জরুরি। জরুরি পুরস্কার প্রদানও।

তবে আগে কিছু হয়নি বলে এখন বা ভবিষ্যতে কিছু হবে না, করা যাবে না-এমন তো কথা নেই। এখন কিন্তু আমাদের জানা হয়ে গেছে আমাদের পরম উদ্দীষ্টটা কী। এ লেখাটি হিগ্স-বোসন কণার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করার কারণও এটাই। আমাদেরকে সম্মিলিতভাবেই চেষ্টা করতে হবে সত্যেন বসু ধরনের জ্ঞান অর্জনের। সম্ভাবনাময় মেধাবীদের বিকশিত করতে হবে। আর তা গণিত জ্ঞানভিত্তিকই হতে হবে। এই সত্যেন বসু মানের জ্ঞানের উচ্চতা যে এভারেস্টের চেয়ে অনেক বেশি তা কী আমরা বুঝতে পারছি? সত্যি যদি ‘ঈশ্বর কণা’কে কাজে লাগানো সম্ভব হয় তাহলে মানবসভ্যতাই নেবে নতুন মোড়। আমাদের বসুকে নিয়ে উচ্ছ্বাসকে আমরা আরও গুণান্বিত করতে পারি যদি আমাদের নতুন প্রজন্মের গণিতবিদরা তাদের বিকশিত মেধা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। এটা হতে পারে এবং অবশ্যই হতে পারে যদি এ যুগের কর্ম ও জ্ঞানের হাতিয়ার আইসিটিকে আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি। এ জন্য প্লাগ অ্যান্ড প্লে, গেমিং আর ফেসবুকের উল্লাসের বাইরে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে রাষ্ট্রকে। গণিতভিত্তিক জ্ঞানই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এ দেশের।

হিগ্স-বোসন কণার সাফল্য আমাদেরকে আইসিটি ব্যবহারের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। একটা কথা মনে রাখা দরকার দ্রুত ও নির্ভুল গাণিতিক সমাধানের উপায় বাতলাচ্ছে আইসিটি। এর আগেও আমরা দেখেছি হিউম্যান জেনম প্রজেক্টে জিনসিকোয়েসিং সম্ভব করেছিল আইসিটিই। সামনে আরও কাজ আছে। ডার্ক ম্যাটার নিয়ে গবেষণা শুরু হবে সার্নে। চলছে ন্যানোটেকনোলজি নিয়ে গবেষণাও। রোবটিক্সকেও বাদ রাখা যাবে না তালিকা থেকে। কাজেই উচ্চতর গাণিতিক জ্ঞান অর্জন ও চর্চায় আইসিটি ব্যবহারের একটা নতুন পরিবেশ দেশে সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। তৃণমূল পর্যায়ে যা করা হচ্ছে তা চলুক। পাশাপাশি ‘গণিতের জন্য বিশেষ উচ্চতর কাউন্সিল’ গড়ে তোলা হোক, গণিত ও আইসিটিতে গ্র্যাজুয়েটদের মধ্য থেকে মেধাবীদের বেছে নিয়ে গবেষণার সুযোগ দেয়া হোক। নতুন যুগের উপযোগী শিক্ষক তৈরির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটও এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। এখনই হয়ত আমরা এভারেস্টসম অতিউচ্চতায় উঠতে পারব না। তবে বেস ক্যাম্প তৈরি করে নেয়ার মতো সক্ষমতা যে আছে তা নিশ্চিত করেই বলতে পারি।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক :abir59@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস