লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
এ কোন অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা?
গত ১২ সেপ্টেম্বর সরকার ঘোষণা করেছে খসড়া অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১২। এই খসড়া নীতিমালার খবর অনলাইন, ফেসবুক, বিভিন্ন ব্লগ ও অনলাইন নিউজ ব্লগ এবং সেই সাথে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পরপরই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এরই মধ্যে এ নিয়ে চলছে গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর সংগ্রহসহ নানাধর্মী আয়োজন। এসব আয়োজনের মাধ্যমে বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলছে, এ কোন অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা? সরকার কী কারণে ও কোন উদ্দেশ্যে এ ধরনের একটি অপরিপক্ব নীতিমালা তৈরি করতে গেল। মনে হচ্ছে, সরকার এর মাধ্যমে অনলাইনের ওপর এক ধরনের স্বার্থান্বেষী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এই নীতিমালাটি কার্যকর করতে চাইছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো মহল বলছে, এই নীতিমালার নামে সরকার কার্যত ইন্টারনেটকেই নিয়ন্ত্রণ করবে। সেই সাথে এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে নানা ধরনের ফি আদায়ের নামে অনলাইন গণমাধ্যমকেই দুর্বল করে দিতে চাইছে।
আমরা লক্ষ করেছি, প্রকাশিত খসড়া নীতিমালায় লাইসেন্সের জন্য আবেদন ফি, আর্নেস্ট মানি, লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি এসব নানা নামের ফি আরোপের কথা বলা হয়েছে। এসব ফি যে হারে ধরা হয়েছে, তা কোনোমতেই যৌক্তিক নয় এবং তা কার্যত অনলাইন গণমাধ্যম উদ্যোক্তাদের জন্য বড় মাপের আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে। বলা হয়েছে, ২ লাখ টাকার আর্নেস্ট মানি দিয়ে আবেদন করতে হবে লাইসেন্সের জন্য। লাইসেন্স ফি লাগবে ৫ লাখ টাকা। নবায়ন ফি ৫০ হাজার টাকা। প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। তাছাড়া অনলাইন পত্রিকার ক্ষেত্রে পরিচালনাকারীর ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স থাকতে হবে।
খসড়া নীতিমালায় অনলাইন গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের লাগাম পরানোর একটা সুস্পষ্ট প্রয়াস লক্ষণীয়। এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনলাইন গণমাধ্যমে অন্য কোনো দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম লিঙ্ক করতে পারবে না। সম্প্রচারিত বিষয়গুলোর রেকর্ড ৯০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে। বিজ্ঞাপন প্রচার, সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানসহ প্রতিদিনের মোট প্রচার ২০ শতাংশের বেশি হবে না। সরকার অনুমোদিত সেন্সর নীতিমালা সম্পূর্ণ মেনে চলতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বিদেশী অনলাইন গণমাধ্যম সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, টক শো, আলোচনা, সম্পাদকীয় এবং সাময়িকীর ঘটনাবলী নিয়ে অনুষ্ঠান ও মন্তব্য সরাসরি সম্প্রচার বা ধারণ করা বা যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণ একযোগে বিনামূল্যে সম্প্রচার করতে হবে। সরকার ঘোষিত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ দিবসের সংবাদ বা অনুষ্ঠানাদি যথাযথ গুরুত্বসহকারে প্রচার করতে হবে। সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালার প্রতিফলনসহ বিনামূল্যে প্রেসনোট, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের বিষয়ে ক্ষতিকর সংবাদ বা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা যাবে না। অনলাইনে প্রচারিত বিজ্ঞাপন বাবদ পাওয়া মোট আয়ের শতকরা দুই ভাগ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। এভাবে নানা শর্তের ফাঁদে আটকে অনলাইন গণমাধ্যমকে কার্যত একটি সরকারি প্রচারযন্ত্রে পরিণত করতে চাইছে, যা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, সরকার এর মাধ্যমে কার্যত ইন্টারনেটকেই নিয়ন্ত্রণ করবে। এভাবে ইন্টারনেটকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা ভাবাও এক ধরনের পাপ। কিন্তু এ নীতিমালায় সে চেষ্টাই চলেছে।
নীতিমালাটি নানা দিক থেকে অসম্পূর্ণ। এ নীতিমালা অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশের পথকেই রুদ্ধ করে দেবে। অনলাইন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীর কল্যাণের ব্যাপারে কোনো কথা নেই এই নীতিমালায়। অনলাইন গণমাধ্যম বলতে কী বুঝব, এর কোনো সংজ্ঞাও নেই এ নীতিমালায়। গণমাধ্যমের শ্রেণীবিন্যাস, পেশাজীবীর মান, সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের যোগ্য সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে এ নীতিমালায় কিছুই উল্লেখ নেই।
এ নীতিমালা প্রকাশের ব্যাপারে সরকার যেনো এক ধরনের লুকোচুরিতে ব্যস্ত। এ নীতিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অনলাইন সংবাদপত্রের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। অথচ অনলাইন গণমাধ্যমের মৌল অংশই হচ্ছে এই অনলাইন গণমাধ্যম। গত ১২ সেপ্টেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয়ে বাছাই করা কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ডেকে প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালার কপি ধরিয়ে দেয়া হয় এবং এ বিষয়ে ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়। এ ধরনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালার ব্যাপারে মতামত জানানোর মাত্র সপ্তাহখানেক সময় বেঁধে দেয়া কোনোমতেই যুক্তিযুক্ত নয় বলে আমরা মনে করি।