লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
সফটওয়্যার রফতানিতে বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন
বাংলাদেশে বিগত সময়গুলোতে সরকার ও ব্যবসায় সমিতিগুলো নীতি ও কর্মপন্থার ক্ষেত্রে সঠিক পথে চলতে পারেনি বলেই এত ঢাকঢোল পেটানোর পরও আমরা আমাদের প্রত্যাশিত সফলতা পাইনি। এমনকি এখনও সফটওয়্যার রফতানি ও দেশীয় শিল্প খাত গড়ে তোলায় নীতি ও কর্মপন্থা সঠিক নয়।
এটি এখন সবারই জানা, বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস তথা বেসিস ২০১৮ সালের মধ্যে সফটওয়্যার ও সেবা খাতের রফতানি এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সংকল্প ঘোষণা করেছে। একই সাথে এক এক করে আরও অনেক খাতে ব্যাপক উন্নয়নের ওয়াদা করেছে। একটি উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে বেসিসের এই স্বপ্নটাকে আমরা সবাই স্বাগত জানাই। বর্তমানে সফটওয়্যার ও সেবা খাতে সরকারিভাবে ১০০ মিলিয়ন ও বেসরকারিভাবে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। এমন একটি অঙ্ককে ১০ গুণ বা ৪ গুণ বাড়িয়ে দেয়াটা কঠিন চ্যালেঞ্জ তো বটেই। এর মাঝে আরও বড় প্রশ্ন হলো- গত বছরে রফতানি আয় খুব সামান্য বেড়েছে। এই হার শতকরা ১৫ ভাগের বেশি নয়। অন্যদিকে বেসিস গত ১৮ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, বাংলাদেশ আউটসোর্সিংয়ের জন্য ২৬তম স্থানে রয়েছে। এর আগে আমরা ৩০তম স্থানে ছিলাম। পাঁচ বছরে মাত্র চার ধাপ এগিয়ে আমরা সেই স্বপ্নটাকে কি সফল করতে পারব?
স্বপ্নের তুলনায় অর্জন উল্লেখ করার মতো নয়। অর্থমন্ত্রীকে দিয়ে ওয়ান বাংলাদেশ সেস্নাগান উদ্বোধন করে যে স্বপ্নটা পুরো জাতির সামনে তুলে ধরা হয়, সেটির প্রথম বছর যেভাবে গেছে এবং যে প্রবৃদ্ধি এই বছরে আমরা পেয়েছি, তাতে কোনোভাবেই এটি মনে করা যায় না, সেটি পূরণ হওয়ার মতো কিছু একটা। যেসব আনুষঙ্গিক উন্নয়ন হওয়ার কথা সেসব খাতেও তেমন কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি। কিন্তু সেটি তো অসম্ভব কিছু নয়। ভাবতে হবে, সম্ভবের কাজটাও সফল হবে না কেন?
গত ১০ সেপ্টেম্বর সকালে এ বিষয় নিয়েই কথা বলতে এসেছিলেন ভারতীয় দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দুইজন পরামর্শক। এদের একজন হলেন এয়ন হিউইটের নেইল শাস্ত্রী এবং আরেকজন হলেন থলনসের রবার্তো কার্লোস এ ফ্লরো। শাস্ত্রী ভারতীয়। ফলে বাংলাদেশ বিষয়ে তার জ্ঞান অনেক পাকা। ফ্লরো পুরো আলোচনায় কথাও কম বলেছেন। সম্ভবত এখনও তাকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে হচ্ছে। ওদেরকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন কমপিউটার কাউন্সিলের জাহাঙ্গীর নামে এক কর্মকর্তা। অনেকক্ষণ আলাপ করার ফাঁকে তারা জানালেন, একটি স্বল্পকালীন রোডম্যাপ তৈরির পরিকল্পনা আছে তাদের। বেসিস সভাপতিসহ অনেকের সাথেই এরা কথা বলেছেন। তাদের পরামর্শ যেরকম ছিল, তারচেয়ে আমার আলোচনাটি বিপরীত মেরুর এমন একটি মন্তব্য আমাকে বিস্মিত করেনি। আমি খুব ভালো করেই জানি, আমার কথাগুলো শ্রুতিমধুর লাগবে না। এমনকি আমাদের শিল্প খাতের নেতারা আমার মতামতকে তেমন সহজভাবে নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। বরাবরই তারা উল্টো পথে চলে আসছেন। গত এক দশকে বেসিস তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেনি- এটি তিক্ত হলেও সত্য।
আমার যে বক্তব্যটি কেউ সহজে গ্রহণ করতে পারে না, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশে বিগত সময়গুলোতে সরকার ও ব্যবসায় সমিতিগুলো নীতি ও কর্মপন্থার ক্ষেত্রে সঠিক পথে চলতে পারেনি বলেই এত ঢাকঢোল পেটানোর পরও আমরা আমাদের প্রত্যাশিত সফলতা পাইনি। এমনকি এখনও সফটওয়্যার রফতানি ও দেশীয় শিল্প খাত গড়ে তোলায় নীতি ও কর্মপন্থা সঠিক নয়। এ ব্যাপারে কয়েকটি মোটা দাগের বিষয়ে কথা বলা যায়।
অভ্যন্তরীণ বাজার
সরকার ও বেসিস দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে চরমভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। দুই পক্ষেরই ধারণা- দুবাই, নিউইয়র্ক, লন্ডন, জার্মানি ঘুরলেই সফটওয়্যার রফতানি বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এরা কোনোদিন হিসাব করে দেখে না যে রফতানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ একেবারে কম নয়। শুধু অর্থ খাতে বাংলাদেশ যে পরিমাণ সফটওয়্যার ও সেবা আমদানি করে, সেই পরিমাণ রফতানি কি আমরা করি? অথচ ইচ্ছা করলেই আমরা বিদেশ-নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারি। হতে পারে আমরা অপারেটিং সিস্টেম বা বড় ধরনের ডাটাবেজ সফটওয়্যার বানাতে পারব না, কিন্তু আমরা কি অ্যাকাউন্টিং সফটওয্যার বা ইআরপিও বানাতে পারি না? দেশীয় সফটওয়্যার শিল্প খাত গড়ে তোলার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল, সেগুলো তো করা হচ্ছেই না, বরং যেসব পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ বাজার ও রফতানি দুই খাতেই সহায়ক হবে, সেসব কাজও আমরা গুছিয়ে করি না। কেমন করে বেসিস ও সরকারের এমন ধারণা হয়েছে- তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক আন্তর্জাতিক মেলায় অংশ নিলেই দেশ সফটওয়্যার রফতানিতে বিপুল অগ্রগতি সাধন করতে পারবে। সেজন্য কমডেক্স ফল থেকে সিবিট পর্যন্ত সব মেলাতেই আমাদের অংশগ্রহণ হয়েই চলেছে। দেশের ভেতরেও যেসব মেলার আয়োজন হয়, তাতে নানা পুরস্কার আর ঢাকঢোলে সময় যায়, কাজের কাজ তো কিছুই হয় না। বাজার তৈরির কোনো প্রচেষ্টাই চোখে পড়ে না।
অন্যদিকে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হলো, বেসিস বা সরকার কেউই অবকাঠামোর কথা মোটেই ভাবে না। সেই ’৯৭ সালে বরাদ্দ দেয়া কালিয়াকৈরের হাইটেক পার্ক এখনও চালু হয়নি। ওখানে ভবন আছে গরু-ছাগল বসবাস করার জন্য। ইদানীং শুনছি সেখানে ডাটা সেন্টার হচ্ছে। কিন্তু কবে যে ওখানে আইসিটির লোকজন বসে কাজ করা শুরু করবেন সেটি কেউ বলতেই পারেন না। ঢাকার জনতা টাওয়ার এখনও পরিত্যক্ত বাড়ি। কারওয়ান বাজারের ইনকুবেটর মূলত ভাড়ার বাড়ি। সেই যে কবে বড় বড় কোম্পানি সেখানে ঢুকেছিল আর বের হওয়ার কথা ভাবে না- নতুন উদ্যোক্তাদের প্রবেশ তো দূরের কথা। সেই অবস্থাটি বেসিসেরও। ওখানে সদস্য ও ভর্তি ফি বাড়িয়ে ছোট কোম্পানিগুলোর প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এবার অর্ধেক প্রতিষ্ঠান ভোটার হতে পারেনি।
অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে তোলার জন্য সরকার ও ট্রেড বডির গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল মেধাসম্পদের ওপর। কিন্তু বেসিস ১৭ বছরে একবারও মেধাসম্পদ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। বরং উৎসাহিত করেছে মেধাসম্পদ লঙ্ঘনকারীকে। একই সাথে বেসিস বাণিজ্যিক সফটওয়্যারকেও উৎসাহিত করেনি। সরকারের একটি মহলের সাথে হাত মিলিয়ে তারাও এখন ফ্রি সফটওয়্যারের রাজ্যে বিচরণ করছে। আমি এটি বুঝি না যে শুধু ফ্রি সফটওয়্যার বা সেবায় একটি শিল্প খাত কেমন করে গড়ে উঠবে। আমরা ভাবছি সবাই ফেসবুক বা গুগল হবে। কেউ মাইক্রোসফট বা অ্যাপল হবে- এমন ধারণাটি কারও কাজ করে না। বেসিস তো এসব বিষয়ে পুরোই নীরব। মেধাসম্পদ আইন নিয়ে কথা হয় না। কেউ কথা বলে না মেধাসম্পদ আইনের প্রয়োগ নিয়ে। কাজ করার পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন নেই। বছরের পর বছর ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের কোনো সভা হয় না। আইসিটি নীতিমালা নবায়ন হওয়ার কথা ২০১১ সালে। সেটির দিকে কেউ তাকায়ও না। যেসব কাজ করা হয়েছে, তার প্রায় সবই আদা-খেচড়া টাইপের। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ সেস্নাগান দিলেও ডিজিটাল সরকার গঠনে বড় কোনো কাজ করেনি। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কাজে নেই কোনো সমন্বয়।
সব কিছুর ঊর্ধ্বে যে কথাটি, তা হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার সরকার গঠন করেন, তখন তিনি বছরে ১০ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রগতি হচ্ছিল। কিন্তু মাঝখানে সাত বছরের বিএনপি-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে এই স্বপ্ন ধুলায় লুটিয়েছে। এরপরও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর একটি মাইলফলক কাজ করা হয়েছে। বিষয়টি হচ্ছে- সরকার স্কুল-কলেজ স্তরে কমপিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে।
এখন ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্য করা হয়েছে। কিন্তু এই কাজটি চরম বিশৃঙ্খলভাবে করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সচেতনতা তৈরির জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপিউটার ল্যাব তৈরি করা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ তথাকথিত সচেতনতা কর্মসূচির চেয়ে অনেক জরুরি কাজ ছিল কমপিউটার ল্যাব গড়ে তোলা। দেশের প্রায় তিন কোটি ছাত্র-ছাত্রীকে বাধ্যতামূলক কমপিউটার শেখানোর কর্মসূচি হাতে নিয়ে এই পদে যদি শিক্ষক নিয়োগ না দেয়া হয়, যদি কোনো প্রশিক্ষণ না দেয়া হয়, যদি কমপিউটার ল্যাব তৈরি করা না হয়, তবে সেই বিষয়টি কেমন করে ছাত্র-ছাত্রীরা আত্মস্থ করবে। আমি লক্ষ করেছি, এরই মাঝে এসব বিষয়ে গাইড বই বাজারে এসেছে। চলতি বছর এমন গুজব ছড়ানো হয়েছে যে এই বিষয়টি বাতিল করা হবে। ফলে বছরের শুরুতে এই বিষয়টি পড়েইনি। এখন বছরের শেষ প্রান্তে এসে ওদেরকে কোচিং করতে হচ্ছে। আমি জেনে খুব কষ্ট পেয়েছি, এমনকি শিক্ষকদেরকে ঘুষ দিয়ে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর বইপাঠ্য করা হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কমপিউটার ল্যাব গড়ে তুলছে না। এমনকি ল্যাব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। আমি দেখেছি একটি স্কুলে পঞ্চম-দশম স্তরে ১১৫৪ ছাত্র-ছাত্রী আছে। ওদের জন্য কমপিউটার আছে পাঁচটি। এই অদ্ভুত তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা কার কোন কাজে লাগবে, সেটি কাউকে বোঝানো যায়নি। পাঠক্রমের পশ্চাৎপদতার পাশাপাশি দিনে দিনে উচ্চশিক্ষায় এই বিষয় অধ্যয়ন করার ক্ষেত্রেও কোনো সঠিক পরিকল্পনা নেই। ছাত্র-ছাত্রীরা দিনে দিনে এই বিষয় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com