লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
আইকো চিহিরা : অন্যরকম হিউম্যানয়েড রোবট
মিটসুকোশি। জাপানের টোকিও শহরের একটি ডিপার্টমেন্টাল চেইন স্টোর। বারো তলাজুড়ে বিস্তৃত বিশাল এই স্টোর। জাপানে বেড়াতে গেলে অনেকেই ঘুরে আসেন এই দোকানটি। গত এপ্রিলের শেষ দিকে দোকানটিতে ঢোকার সময় অনেকের নজরে পড়ে অস্বাভাবিক এক দোকান কর্মচারী। চোখ টিপটিপ করে ক্রেতাদের অভ্যর্থনা জানায় সে। আসলে এটি একটি হিউম্যানয়েড রোবট। প্রথমে এটি দেখে থমকে যাবেন- এটি মানুষ না রোবটযন্ত্র। প্রায় মানুষরূপী এই হিউম্যানয়েড রোবটটি সেখানে ইনফরমেশন রিসিপশন ডেস্কে দায়িত্ব পালন করছে একজন রিসিপশনিস্টের। সে-ই সবার আগে আপনাকে স্বাগত জানাবে এ দোকানে। এরপর পরিশ্রান্তহীনভাবে আপনাকে জানিয়ে দেবে বারো তলা এ দোকানের বিস্তারিত তথ্য। জানাবে এর আসন্ন ইভেন্টগুলোর কথাও। কিন্তু ওই রোবট ভালো শ্রোতা নয়। এটি জাপানি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারলেও, এমনকি জাপানি সাঙ্কেতিক ভাষা জানলেও শ্রোতার কোনো প্রশ্ন বা কথা এর কানে ঢোকে না। এ ক্ষেত্রে এটি একদম কালা-বোবা। এর কাছে কোনো প্রশ্ন করে উত্তর পাবেন না। বলা যায়, এটি একটি নন-কনভারসেশনাল হিউম্যানয়েড। তোশিবা এই হিউম্যানয়েড তৈরির কথা প্রথম প্রকাশ করে ২০১৪ সালে, জাপানের CEATEC তথা কম্বাইন্ড এক্সিভিশন অব অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস নামের বার্ষিক জাপানি প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে। কিন্তু এটি প্রথমবারের মতো সম্প্রতি কাজে লাগানো হয় এই মিটসুকোশি স্টোরেই।
রোবটটি যখন চোখ-মুখ ও হাত-পা নড়াচড়া করে, তখন নিশ্চয় তা মানুষের মতো সাবলীল হবে, এমনটি আশা করা যাবে না। তবে আইকো চিহিরা দেখতে কিন্তু প্রায় একজন জীবন্ত মানুষের মতো। তার চোখের পাতা নাড়ালে মনে হয় রোবটটি যেন মানুষের চেয়ে বিনয়ী। মনে হয় সব কিছুই যেন সে বুঝে-শুনে সাড়া দিতে সক্ষম, যদিও প্রোগ্রামের বাইরে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই এর। মিটসুকোশি স্টোরের এই রোবট প্রোগ্রাম করা হয়েছে শুধু স্থানীয় জাপানি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজেই নয়, এটি প্রোগ্রাম করা হয়েছে চীনা সাঙ্কেতিক ভাষায়ও। পরে এতে কোরীয় ও অন্যান্য ভাষাও সংযোজিত হবে বলে জানা গেছে। অতএব বলা যায়, এক সময় চিহিরা জাপানি ছাড়া অন্যান্য ভাষায়ও কথা বলতে পারবে। তোশিবার নতুন বিজনেস ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ ম্যানেজার হিতোশি টকুডা বলেন, ‘এটি ভালো হতো, যদি আমরা আইকো চিহিরাকে ভালোভাবে নির্দেশনা দিতে পারি কিংবা বিভিন্ন আদেশ দিতে পারি চীনা ভাষায়। মানুষের প্রত্যাশা, আইকো চিহিরা যদি চীনা ভাষায় কথা বলতে পারত। আমি আশা করছি, তেমনটি ঘটবে।’
এটি একটি ফিমেইল হিউম্যানয়েড। এর গায়ে পরিয়ে দেয়া হয়েছে জাপানের আলখেলস্না জাতীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমনো। এর নাম Aiko Chihira। এই রোবটটি ডেভেলপ করেছে তোশিবা করপোরেশন। এর কোডনেম দেয়া হয়েছে ChihiraAica। এটি মিটসুকোশি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের রিসিপশন ডেস্ক থেকে ক্রেতাসাধারণকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও নির্দেশনা দেয়ার উপযোগী করে প্রোগ্রাম করা আছে। তোশিবার বানানো এই হিউম্যানয়েড রোবটে কিছু তৈরি মন্তব্য প্রোগ্রাম করা আছে। দোকানের গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাতে এই প্রোগ্রাম এই রোবটকে সহায়তা করে। এটি একটি অ্যান্ড্রয়িড রিসিপশনিস্ট। এর মাধ্যমে জাপানি ডিপার্টমেন্টাল চেইন স্টোর মিটসুকোশি এ ধরনের অ্যান্ড্রয়িড রিসিপশনিস্ট ব্যবহারে বিশ্বে প্রথম হওয়ার রেকর্ড গড়ল।
রোবটটির চেহারা তৈরি করা হয়েছে জাপানি অপেরা সিঙ্গার সকো ইওয়াশিতার চেহারার মতো করে। তার সাথে এটি পারফর্ম করেছে, গায়িকার সাথে কথা বলেছে, এমনকি গানে ঠোঁট মিলিয়েছে। চিহিরা বলেছিল, ‘আই উড লাইক ইউ টু লিসেন টু দ্য সং দেট আই হেভ পুট অ্যা লট এফর্ট ইনটু।’
তোশিবার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সহায়তা করে একটি রোবটকে চলাচল করতে ও একই সাথে এর কথা বলার সাথে সাথে এর ঠোঁট নাড়ানোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে। ওশাকা ইউনিভার্সিটি ইন্টেলিজেন্ট রোবটিকস ল্যাবরেটরির অ্যান্ড্রয়িড পাইওনিয়ার কিরোশি ইশিগুরোর প্রযুক্তিও এ রোবটে ব্যবহার হয়েছে। এক সময় এই রোবটটিকে মিটসুকোশি স্টোরের রিসিপশন থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ষষ্ঠ তলায়, সেখানে গত ৫ মে পর্যন্ত এটি দায়িত্ব পালন করে একজন গাইড হিসেবে।
তোশিবা এই অ্যান্ড্রয়িড রোবট উন্মোচন করে গত জানুয়ারিতে লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত কনজ্যুমার ইলেকট্রনিকস শো তথা সিইএসে। প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে, এ রোবটটি বয়স্ক লোকদের যত্ন নেয়ার কাজেও ব্যবহার করা যাবে। তোশিবার দাবি, এই রোবটের মুখের প্রকাশভঙ্গি অন্য যেকোনো অ্যান্ড্রয়িড রোবটের তুলনায় অধিকতর বাস্তবভিত্তিক। রোবটটি যাতে প্রায় মানুষের মতোই চলাফেরা করতে পারে, সেজন্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে ৪৩টি নিউম্যাটিক অ্যাকচুয়েটার। এর মধ্যে ২৪টি রয়েছে চিহিরার বাহু, কাঁধ ও হাতে। অপরদিকে মুখে রয়েছে ১৫টি।
এর কাজকর্মে এখনও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখনও এমন প্রোগ্রামের বাকি, যাতে এটি গ্রাহকদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। তোশিবার তাইহি ইয়ামাগুচি একটি সংবাদ সংস্থার রিপোর্টের মাধ্যমে জানিয়েছেন, চিহিরা এখনও এ কাজটি করতে পারছে না। তবে তোশিবা এ ব্যাপারে কাজ করছে। তিনি তোশিবার গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে কাজ করেন। ইয়ামাগুচি জানিয়েছেন, ৩২ বছরের এক তরুণীসদৃশ চেহারার অধিকারী চিহিরা শুধু রিসিপশনিস্টের কাজই করবে না, এরা এটি সামাজিক শুশ্রূষা প্রতিষ্ঠানের কাজেও ব্যবহার করতে পারবেন। ভবিষ্যতে এই রোবট সেখানে বয়স্ক লোকদের সাথে কথা বলবে, তাদের যত্ন নেবে, দেখাশোনা করবে। এছাড়া এটি ডেভেলপ করা হবে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকে ব্যবহারোপযোগী করে।
আইকো চিহিরা বিশ্বের প্রথম অ্যান্ড্রয়িড রিসিপশনিস্ট হিউম্যানয়েড হলেও এর আগে অন্য রিসিপশনিস্ট হিউম্যানয়েড রোবট ব্যবহার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম রিসিপশনিস্ট রোবট ব্যবহার করে নেসলে। সে রোবটটির নাম পিপার। এটি এর কফি উৎপাদককে বিক্রির কাজে সহায়তা করেছে। পিপার জাপানের অ্যাপ্লায়েন্স স্টোরে ব্যবহার হয় গত বছর। সমালোচকেরা বলছেন, এই হিউম্যানয়েড নতুন কিছু নয়। আর এটাই শেষ হিউম্যানয়েড রোবট নয়। আমরা আরও অনেক উন্নত রোবট ভবিষ্যতে পাব