বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী রোবট নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় যথেষ্ট সাফল্যও ধরা দিয়েছে তাদের ঝুলিতে। এক সময় সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীতে যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট বা যন্ত্রমানবের দেখা মিলতো, তা এখন আর কল্পনা নয়। বলা চলে বাস্তবেই তাদের দেখা মিলছে। এতে কেউ অবাকও হচ্ছে না। বরং দৈনন্দিন জীবনে তাদের অনেকটাই আপনজনে পরিণত করা হয়েছে। ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটেরা যেনো এখন আর যন্ত্র নয়। সহযোগী কিংবা বলা যায় ঘনিষ্ঠ সঙ্গী।
কল্পবিজ্ঞানের মতো করেই বিজ্ঞানীরা নানা কাজে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্য অনেক কিছুর মতো ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে খেলোয়াড় রোবট। এসব রোবট ফুটবল খেলতে পারে মানুষের মতোই। তাদের নিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা। মানুষের ফুটবল বিশ্বকাপের মতো করেই হয় এ আয়োজন। প্রতিযোগিতার নাম রোবোকাপ। এবারের রোবোকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে গত ৫ থেকে ১২ জুলাই। আর তাতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চীনের রোবট ফুটবল দল। বিশ্বকাপ ফুটবলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন স্পেন, আর রোবোকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়নশিপ গেছে চীনের ঘরে। রোবট গবেষকরা আশা করছেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে রোবটকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে যাতে করে তারা ২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের সাথে ফুটবল খেলতে পারবে এবং নিশ্চিত চ্যাম্পিয়ন হবে!
চায়না ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির রোবট ফুটবল দলটির নাম ছিল ‘ব্লু ঈগল’। তারা অপরাজিত দল হিসেবে জয় করে ১৫তম রোবোকাপ ওয়ার্ল্ড কাপ। এই ফল চীনের রোবট গবেষণায় তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতিরই পরিচয় বহন করে। ব্লু ঈগল টিম প্রকল্প শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে প্রথম চীনা দল হিসেবে তারা অংশ নেয় রোবোকাপ রোবট ওয়ার্ল্ড কাপ প্রতিযোগিতায়। এরপর থেকে নানাভাবে রোবট দলকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত করা হয়েছে। জাপান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্স দল হয়েছে রানারআপ।
পুরো আয়োজনে অংশ নেয় ৪৩টি দেশ বা অঞ্চলের ২৮০০-র মতো প্রতিনিধি। তারা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করে। অন্যদিকে কিড সাইজ এবং অ্যাডাল্ট সাইজ উভয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেকের টিম ডাউইন।
১৯৯৭ সালে রাশিয়ার গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবধারী দাবাড়ু গ্যারি ক্যাসপারভ সুপার কমপিউটার আইবিএমের ডিপ ব্লু-র কাছে হেরে যান। সেখান থেকে উৎসাহিত হয়ে ফুটবল মাঠেও নেমে যায় রোবট ফুটবলাররা। তখন থেকেই শুরু হয় রোবোকাপ। এবারের রোবোকাপের আয়োজক সেটিন মেরিসলি জানান, এবারের আসরের রোবটগুলো অন্য যেকোনো বারের চেয়ে আরো বেশি উন্নতমানের। এরা নিজেরাই নিজেদের বেশ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ রোবটদের এই মিলনমেলায় এবার আগের চেয়ে বেশি দল অংশ নেয়। নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগা এবারের ফুটবলার রোবটগুলো ছিল খুবই চৌকস। সামনের যেকোনো বাধা-বিপত্তি এড়ানোর ক্ষমতা ছিল এদের। একে অন্যের সাথে সংঘর্ষ এড়ানোর মতো বিবেচনা বোধ এবং একসাথে কাজ করার মতো মানবিক গুণাবলীরও সমন্বয় করা হয় রোবটদের মধ্যে। মাঠটিও ছিল আগের যেকোনো বারের চেয়ে বড়।
আয়োজকরা দাবি করেছেন, রোবটদের এই কর্মতৎপরতা মানুষকে মুগ্ধ করেছে। যুক্তরাজ্যের স্কুল অব ইনফরমেটিক্সের অধ্যাপক সুব্রামানিয়ান রামামোরথি বলেন, আমরা এমন একটি দল গঠন করব, যেটি ২০৫০ সালে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল-জয়ীদেরও হারিয়ে দেবে। এবারই প্রথম পূর্ণাঙ্গ দল নিয়ে মাঠে নামে যুক্তরাজ্য।
বিশ্বব্যাপী নতুন ধরনের রোবটদের নিয়ে আয়োজিত রোবোকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আয়োজন করা হয় আরো কয়েকটি ক্যাটাগরির প্রতিযোগিতা। সেখানে রোবটদের নানা ধরনের কার্যক্ষমতা নিয়ে পরীক্ষা চলে। এবারের রোবোকাপে প্রদর্শিত হয়েছে এমন কিছু রোবট যারা নানা গৃহস্থালির কাজ করতে সক্ষম। তাদের কর্মতৎপরতা এতটাই অসাধারণ যে হয়তো মনে হবে ভবিষ্যতে গৃহস্থালির কাজে মানুষের আর প্রয়োজন হবে না। গৃহকর্মীর সব কাজই তারা করে দেবে এবং কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠবে না। এসব রোবট নিয়ে আয়োজন করা হয় রোবোকাপ অ্যাটদ্যরেট হোম প্রতিযোগিতার।
রোবোকাপ অ্যাটদ্যরেট হোম প্রতিযোগিতায় রোবটদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ বাড়ির মডেল, যেখানে ছিল বেডরুম, কিচেন, হলরুম, লিভিংরুম, ইউটিলিটি রুমসহ নানা কিছু। রোবটরা প্রতিটি রুমে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ির মানচিত্র তৈরি করে এবং রুমের কোথায় কোন যন্ত্রপাতি বা প্রয়োজনীয় জিনিসটি রয়েছে, তারও তালিকা তৈরি করে। এসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জিনিসপত্রের মধ্যে রয়েছে ওয়াশিং মেশিন, টেবিল, সেলফ, ফুলদানি, পোশাকসহ রান্নাঘরের বিভিন্ন তৈজসপত্র। মাইক্রোসফটের কানেক্ট সেন্সর ব্যবহার করেছে নতুন নতুন এসব রোবট। একবার পুরো বাড়ি তথা প্রতিটি রুমের মানচিত্র এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকা নিজের মেমরিতে সংরক্ষণ করার পর রোবটগুলো নির্দেশিত যেকোনো জিনিস একবারেই খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়।
ইতোমধ্যেই এমন বেশ কিছু রোবট তৈরি করা হয়েছে যারা বয়স্ক মানুষের সঙ্গী হিসেবে সময় কাটাতে এবং তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা কাজ করতে সাহায্য করে থাকে। তাছাড়া এমন কিছু রোবট রয়েছে যারা ঘর পরিষ্কার করা, খাবার বা গোসলের পানি এগিয়ে দেয়া এবং ছোটখাটো জিনিসপত্র এগিয়ে দেয়ার মতো কাজও করতে সক্ষম। অসুস্থ এবং বয়স্কদের সহায়তার কাজে এসব রোবট ব্যাপকভাবে ব্যাবহার করা যেতে পারে। রোবট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এক সময় এ সব রোবট ব্যবহারের বিষয়টি হবে মামুলি ব্যাপার এবং সত্যিকারের বাস্তবতা। উন্নত বিশ্বে এখনই এদের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে এবং তারা তাদের অবস্থানে থেকে যথাযথ সেবাও নিশ্চিত করতে সমর্থ হচ্ছে।
বায়োনিক গ্লাস :
যাদের দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে, তাদের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে একটি সুখবর পাওয়া গেছে। মেলবোর্নের একদল গবেষক সম্প্রতি জৈবিক চোখের আদিরূপের মতো বায়োনিক চোখ আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছে। দৃষ্টিহীন মানুষের জন্য ব্রেইল লিপির পরবর্তী যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হচ্ছে। গবেষকরা আশা করছেন নতুন এই বায়োনিক চোখ অস্ট্রেলিয়ার একজন দৃষ্টিশক্তিশূন্য নাগরিকের চোখে স্থাপন করা হবে। বয়সের সাথে সাথে অনেকের দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। একই সাথে অনেকেই জন্ম থেকে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকে, যা তাদের জীবনযাপনের জন্য নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের দৃষ্টিক্ষমতা বাড়ানোর উপযোগী বায়োনিক গ্লাস বা চশমা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে স্মার্টফোন এবং গেমিং কনসোলের প্রযুক্তি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা স্মার্টফোন এবং গেমিং কনসোলে ব্যবহার হওয়া ভিডিও ক্যামেরা, পজিশন ডিটেকটরস, ফেস রিকগনিশন এবং ট্র্যাকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যবহারের উপযোগী বায়োনিক গ্লাস তৈরি করেছেন। গবেষকরা জানান, নতুন এই গ্লাস বা চশমা পরলে ক্ষীণদৃষ্টির ব্যক্তিরা তাদের সামনে থাকা যেকোনো জিনিসই দেখতে পাবেন। আর এ চশমা ডায়াবেটিক এবং বয়সের কারণে চোখে যারা কম দেখেন তাদের জন্যও উপযোগী হবে। এ বায়োনিক ডিভাইসের সফল প্রয়োগে বিশ্বের অসংখ্য ক্ষীণদৃষ্টিশক্তির মানুষ উপকৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com