দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টা হবে, হচ্ছে পর্যায়ে ছিল। কিন্তু এখন তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। চিকিৎসার কাজে রোবটের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। আর এ কাজটি করেছেন আয়ারল্যান্ডের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ানোর অংশ হিসেবেই এখন এসে গেছে চিকিৎসক রোবট। এই রোবটই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, অস্ত্রোপচার শুধু একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকই করতে সক্ষম তা নয়, রোবট নামের যন্ত্রের পক্ষেও সম্ভব। রোবটিক্সের অগ্রগতি সম্পর্কে যাদের ধারণা প্রবল নয়, তাদের পক্ষে এই কথা বিশ্বাস করা একটু কষ্টকরই বটে।
গত জুনে আয়ারল্যান্ডের কর্ক ইউনিভার্সিটি ম্যাটারনিটি হাসপাতাল তথা সিইউএমএইচ-কে পরিণত করা হয়েছে ‘ইউরোপিয়ান রোবটিক গাইনোকোলজিক্যাল এপিসেন্টার’-এ। হাসপাতালের বেশ কিছু অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে রোবটের হাতে। এর মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর অপারেশন থেকে শুরু করে খুব সামান্য অপারেশনও করানো হবে রোবটদের দিয়ে। এটা ইউরোপের একমাত্র হাসপাতাল, যেখানে ক্যান্সার আক্রান্ত এবং ক্যান্সার ছাড়া অন্য রোগীদেরও স্পর্শকাতর রোবটের সাহায্যে অপারেশন করানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে সিইউএমএইচে পরীক্ষামূলক অসংখ্য অস্ত্রোপচার করেছে রোবটরা। ২০০৭ সাল থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোবটদের দিয়ে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেয়। যেসব রোবট এই অপারেশনগুলো করে, তাদের প্রোগ্রামের নাম ‘দ্য ভিনসি’। এর ব্যয় কয়েক মিলিয়ন ইউরো। এই রোবটগুলো খুব দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে অসংখ্য অপারেশন করতে সক্ষম হয়েছে। রোগীর দেহে অস্ত্রোপচারের তেমন কোনো দাগও অনেক সময় দেখা যায়নি। দেখা গেছে রোবটগুলো যেসব অপারেশন করেছে, সেসব রোগী দ্রুত সেরে উঠেছে। তাই হাসপাতালেও রোবটের ভূমিকা বাড়ছে।
আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে হয়তো যেকোনো অপারেশনের পুরোটাই যন্ত্র বা রোবটের সাহায্যে করা সম্ভব হবে। তবে এই মুহূর্তে কর্ক ইউনিভার্সিটি ম্যাটারনিটি হাসপাতালে যেসব অপারেশন রোবটরা করছে, তার দিকে তীব্র নজর রাখছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ড. ম্যাট হিউইট এবং ড. বেরি ও’রেইলি। প্রতিটি অপারেশনের সময় তারা রোবটদের পাশে থাকছেন।
রোবটরা ‘কি-হোল’ সার্জারি পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারগুলো করছে। এই পদ্ধতিতে রোগীর দেহে খুব ছোট ছোট ছিদ্র করে অপারেশন করা হয়। একটি ছিদ্র দিয়ে ক্যামেরা ঢোকানো হয়, আর অন্যটি দিয়ে অপারেশনের যন্ত্র। দেখা যাচ্ছে, রোবটরা এই অপারেশনগুলো করছে নিখুঁতভাবে। ড. হিউইট জানান, রোবট দিয়ে ‘কি-হোল’ অপারেশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো অপারেশনটি দেখা সম্ভব, যা সাধারণ অপারেশনে দেখা সম্ভব নয়।
এছাড়া আরেকটি সুবিধা হলো- রোবট নিজেই বুঝতে পারছে ঠিক কোন সময় কোথায় ক্যামেরা ধরতে হবে। অত্যন্ত দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে ক্যামেরা ঘোরাতে পারে রোবটরা। এ জন্য তাদের কোনো সহকারীর প্রয়োজন হয় না কিংবা কারো ওপর নির্ভরও করতে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো- অপারেশনের সময় রোগীর দেহে কোনো ধরনের কম্পন অনুভূত হয়নি। অথচ অত্যন্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসকও যখন অস্ত্রোপচার করেন তখনও রোগীর দেহ কিছুক্ষণ পরপর কাঁপতে থাকে।
সিইউএমএইচে গাইনোকোলজিক্যাল রোবটিক প্রোগ্রাম শুরু হয় ২০০৮ সালে। এর আগে ২০০৭ সালে গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডে প্রথম রোবটিক গাইনোকোলজিক্যাল সার্জারি করা হয়।
দ্য ভিনসি সিস্টেমের উচ্চ রেজ্যুলেশনের থ্রিডি স্টেরিও ভিউয়ার এমনভাবে নকশা করা, যা শল্যচিকিৎসকদের দেয় কাজটি সম্পন্ন করার বিশেষ সুবিধাসংবলিত অভিজ্ঞতা। অপারেশনের স্থানটি স্ক্রিনে ফুটে ওঠে অত্যন্ত স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে। ফলে পুরো বিষয়টি আরো সঠিক উপায়ে সম্পাদন করা সম্ভব হয়। রোবটের বাহুগুলো খুবই নিখুঁতভাবে অপারেশনস্থলে প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পারে। বাহুগুলো শল্যচিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং উচ্চ রেজ্যুলেশনের অ্যান্ডোসকপিক ক্যামেরা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বাহুগুলোর নড়াচড়াও মানুষের হাতের মতোই সাবলীল। তাছাড়া পুরো পদ্ধতিটি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে অপারেশনের সময় কোনো ধরনের ভুল না হয়। চিকিৎসকরা যখন কোনো রোগীর অপারেশন করেন তখন নানা ধরনের ভুল হতে পারে বা বলা যায় প্রায়ই ভুল হয়ে থাকে। যার চরম খেসারত দিতে হয় রোগীকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্য ভিনসি পদ্ধতিতে ভুলের সুযোগ নেই। মানুষ সাধারণত যে ধরনের ভুল করে, রোবট চিকিৎসক তা কিছুতেই করবে না। দ্য ভিনসি সার্জিক্যাল সিস্টেমে রোগীরা যে সুবিধাগুলো পাবেন তার মধ্যে রয়েছে- অপারেশনের সময় ব্যথা কম অনুভূত হওয়া, ভয়ভীতিমুক্ত থাকা, ইনফেকশন বা সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকা, রক্তক্ষরণ কম হওয়া, দ্রুত আরোগ্য লাভ করে স্বাভাবিক কাজে ফিরে যেতে পারা এবং সর্বোপরি অর্থ সাশ্রয় হওয়া। অন্যদিকে হাসপাতালের সুবিধা হলো- রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাওয়ায় দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করে। তাই তাদের পক্ষে বেশি রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব।
সিইউএমএইচের এই সাফল্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইউসিসি/সিইউএমএইচের অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনোকোলজির প্রফেসর এবং ইউসিসি কলেজ অব মেডিসিন অ্যান্ড হেল্থের প্রধান ড. জন হিগিন্স বলেছেন, রোবটিক সার্জারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে কর্কের এই সাফল্য যথেষ্ট আগ্রহ উদ্দীপক এবং যৌথভাবে কাজের জন্য এটি একটি চমৎকার সুযোগ। এমনটি যদি করা যায় তাহলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।
এদিকে ওই সিইউএমএইচে এই প্রথমবারের মতো সন্তান প্রসবের কাজে সহায়তা করেছে রোবট। পেট্রিক এবং অ্যান পরিবারের নতুন অতিথির নাম লুসি। এই দম্পতির আগের সন্তানটি গর্ভপাত হয়ে যায়। অ্যানের গর্ভাশয় ছিল দুর্বল। মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের জন্য এটা সবচেয়ে বড় কারণ। এ ধরনের রোগ চিকিৎসায় প্রচলিত শল্যচিকিৎসা পদ্ধতিতে ৫ দিন হাসপাতালে থাকতে হয় এবং সুস্থ হতে সময় লাগে ৩ মাস। কিন্তু দ্য ভিনসি সার্জিক্যাল সিস্টেমের আওতায় একটি রোবট অ্যানের গর্ভাশয় পরীক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় অপারেশন করায় এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। অ্যানই ইউরোপের প্রথম নারী, যিনি এই সুবিধা পেলেন। এরপর অ্যান অন্ত:সত্ত্বা হন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত শিশুটিকে গর্ভে রাখতে সক্ষম হন। এক পর্যায়ে লুসি ভূমিষ্ট হয়।
ইউরোপে একমাত্র কর্কেই দ্য ভিনসি রোবটিক সিস্টেম ব্যবহার হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ইউরোপের অন্যান্য হাসপাতালেও এই পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়বে। ড. বেরি ও’রেইলি বলেছেন, লুসির জন্মটা আমাদের জন্য একটা অসাধারণ ঘটনা। আমরা অত্যন্ত উদ্বেলিত। দ্য ভিনসির সাফল্যের এটা একটা দৃষ্টান্ত। অ্যানের মতো অনেকেই এখন তাদের সমস্যা দূর করে সন্তান ধারণে সক্ষম হবে।
একথা এখন জোর দিয়েই বলা যায়, মানুষ তার কাজের ক্ষেত্রে যে ভুলগুলো সচরাচর করে বা নিজের অজান্তে হয়ে যায়, রোবটের ক্ষেত্রে তা হওয়া সম্ভব নয়। কারণ রোবট নির্দিষ্ট কমান্ডের ভিত্তিতেই কাজ করে থাকে। তার মধ্যে থাকে না কোনো ক্লান্তি-শ্রান্তি। একটি যন্ত্র হিসেবে তার কাজ হয় যন্ত্রের মতোই। মানুষের মতো বহু চিন্তা তাকে একসাথে করতে হয় না। সে শুধু তার কাজটুকুই বোঝে। তাই মানুষ চিকিৎসকের তুলনায় রোবট চিকিৎসকের ভুল নেই বললেই চলে। রোবটকে দিয়ে অপারেশন করানোর এই উদ্যোগ এখনো রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়েই।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com