সর্বাধুনিক এবং অত্যন্ত চৌকস এক রোবট তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের গবেষকরা। এই রোবট ব্যবহারকারীরা দূরপাল্লার অডিও ভিজ্যুয়াল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বহুবিধ সুবিধা পাবে। দেখতে টেডি বিয়ারের মতো। কেউ দেখলে একে বাচ্চাদের সঙ্গী বা পুতুল বলেই মনে করবেন। অথচ এর রয়েছে অসাধারণ ক্ষমতা, অত্যন্ত স্পর্শকাতর কর্মতৎপরতা। এমআইটির এই সহচরের নাম হাগ্যাবল। এটি তাদের সর্ব সাম্প্রতিক প্রকল্প, যা নিয়ে কাজ করে চলেছেন গবেষকরা। চূড়ান্ত সাফল্য ধরা দিলে এই টেডি বিয়ার অর্থাৎ হাগ্যাবলকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা যাবে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, শিক্ষা এবং সামাজিক যোগাযোগের বহুবিধ কর্মযজ্ঞে।
গবেষকরা বলেছেন, বিকট দর্শন নয়, তারা এমন ডিজাইনের রোবট তৈরি করতে চেয়েছেন যা ব্যবহারকারীরা, বিশেষত শিশুরা বন্ধুভাবাপন্ন মনে করে গ্রহণ করে। আর এই চিন্তা থেকেই তাদের দৃষ্টি যায় টেডি বিয়ারের দিকে। সব শিশুই এটি ভালোবাসে। তাই এর সঙ্গে মিল রেখে রোবটের স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতি বিন্যাস করেছেন তারা। এটি করতে গিয়ে যন্ত্রের কাঠামোগত পরিবর্তনেরও প্রয়োজন হয়েছে, যা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাদের করতে হয়েছে। তাদের তৈরি করা এই রোবটের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দূরপাল্লার ভিজ্যুয়াল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা। এই রোবট ব্যবহার করে দূরে অবস্থান করা দাদা-দাদিরা তাদের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে চাইলেই অডিও ভিজ্যুয়াল যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন, শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের দিতে পারবেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, চিকিৎসক পারবেন তার রোগীদের ওপর নজর রাখতে ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে। এছাড়াও গোয়েন্দা তৎপরতাসহ বহু প্রয়োজনীয় কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে অতি স্পর্শকাতর রোবট হাগ্যাবল।
১ হাজার ৫ শ’র বেশি সেন্সর বসানো হয়েছে রোবটটির স্কিনে। সঙ্গে রয়েছে শব্দহীন অ্যাকচুয়েটর। একাধিক ভিডিও ক্যামেরা রয়েছে তার চোখে, কানে রয়েছে মাইক্রোফোন, মুখে একটি স্পিকার। ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কসমৃদ্ধ একটি পিসিও রয়েছে তার দেহে। পিসিটির ওজন ৮০২ দশমিক ১১ গ্রাম।
এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, রোবটরা যে ধরনের আচরণ করে থাকে এই রোবটটি তেমন নয়। এর আচার-আচরণ, চলাফেরা, ভাবভঙ্গিতে ব্যক্তিত্বসমৃদ্ধ চরিত্র ফুটে ওঠে। এর দেহকে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে নরম সিলিকনের চামড়া দিয়ে। এটি দেখতে এমন হয়েছে যে, বাইরে থেকে দেখে বা ধরে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই যে, এর দেহের ভেতরে রয়েছে কতই না স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি। হাগ্যাবলকে ধরলে বালিশের মতো কোনো পুতুল নয়, বরং কুকুরছানাকে ধরলে যেমন অনুভূতি হয় এ ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই অনুভূতি হবে। অর্থাৎ রোবটটি কোলে তুলে নিলে পুতুল কোলে নিয়েছি মনে হবে না, বরং মনে হবে নরম তুলতুলে কোনো কুকুরছানাকে কোলে নিয়েছি। এর দেহাবরণের ভেতরেই অবস্থান করছে দেড় হাজারেরও বেশি স্পর্শকাতর সেন্সর, ক্যামেরা, স্পিকার, মাইক্রোফোন ও কমপিউটার।
হাগ্যাবলের সঙ্গে সংযোগ দেয়া রয়েছে একটি ওয়েব ইন্টারফেসের। আর এর কারণেই বহুদূরে অবস্থান করা কোনো ব্যক্তি অপর কোনো অবস্থানে থাকা কোনো ব্যক্তিকে দেখতে পাবেন রোবটের চোখের মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে অডিও ও ভিডিওর মাধ্যমে রোবটের আচার-আচরণের ওপরও নজর রাখা সম্ভব। রোবটটিকে বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ায় দূর থেকে নিয়ন্ত্রণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ দূরে বসে কেউ ইচ্ছে করলে রোবটটিকে দিয়ে বিশেষ কোনো কাজ করিয়ে নিতে পারবেন। অথবা এমন নির্দেশনা দিতে পারবেন যা দূরে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশ্যসাধনে প্রয়োজন রয়েছে।
অভিভাবকরা রোবটটির ভেতরে স্পিচ থিনথেসিসের মাধ্যমে কিছু কথা টেক্স আকারে ঢুকিয়ে দিতে পারেন। কিংবা হাসিসহ নানাবিধ শব্দ করার জন্য কমান্ড দিতে পারেন। টেক্স আকারে থাকা কথা বা শব্দ শোনার পর শিশুদের মুখভঙ্গি কেমন হয় এবং তাদের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়াই বা কি হয় তা দেখা সম্ভব হবে। রোবটের থ্রিডি ভার্চুয়াল মডেলও দেখা যাবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, অভিভাবকরা হাগ্যাবলের চোখ এবং কানের মধ্য দিয়ে তাদের শিশুদের ওপর সর্বক্ষণিক নজরদারি এবং নির্দেশনা দিতে পারবেন। ফলে শিশুদের নিয়ে অহেতুক চিন্তার অবসান হবে। শিশুদের খেলনা হিসেবে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি রোবটটি হবে তার সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ যন্ত্রবিশেষ।
হাগ্যাবলকে সম্পূর্ণ বা আধাস্বায়ত্তশাসিত মোডে পরিচালনা করার ব্যবস্থা রয়েছে। এই রোবটের প্রোগ্রাম এমনভাবে করা হয়েছে যাতে এটি কোনো সুনির্দিষ্ট চেহারা বা অবয়ব স্মরণে রাখতে পারে। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই এটি চলমান বা গতিশীল কোনো চেহারা বা ছবি ট্র্যাক করতে পারে। আধাস্বায়ত্তশাসিত মোডে একটি জয়স্টিক ব্যবহার করে রোবটটির মাথা উপরে-নিচে এবং ডানে-বাঁয়ে নাড়ানো যাবে। এর নিউরাল নেটওয়ার্ক ৯টি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের স্পর্শ শনাক্ত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে খোঁচা দেয়া, সুড়সুড়ি দেয়া, আচঁড়ে দেয়া ইত্যাদি। এই সব স্পর্শের যেকোনো একটি পেলে সে অন্তত ৬ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ঠাট্টা করা, বিরক্ত করা, শাস্তিমূলক আলো নিক্ষেপ ইত্যাদি। কি ধরনের আচরণ বা স্পর্শের প্রতিক্রিয়া কিভাবে দেখানো হবে তা রোবটটি নিজেই নির্ধারণ করে থাকে এবং সে অনুযায়ীই প্রতিক্রিয়া দেখায়।
এখন এমআইটি মিডিয়া ল্যাব সত্যিকার পরীক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি হাগ্যাবল তৈরির কাজ করছে। মাইক্রোসফটের আইক্যাম্পাস মঞ্জুরির আংশিক সহায়তায় মাইক্রোসফট রোবটিক স্টুডিওতে রোবট তৈরি করা হচ্ছে। আরো পরীক্ষায় সফল হলে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হবে এই রোবট। তখন এর কর্মসীমা বা পরিধি বহুগুণে বেড়ে যাবে। বিশেষ করে শিশুদের ওপর নজরদারি, চিকিৎসাসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় এই হাগ্যাবল অনবদ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কর্মরত গবেষক ও কর্মকর্তারা।
এদিকে বিশ্বখ্যাত রোবটিক কোম্পানি আইরোবট তৈরি করতে যাচ্ছে ‘নরম’ রোবট। এটি মোচড়ানোর ভঙ্গিতে বা বলা যায় শামুক বা সামুদ্রিক প্রাণীর মতো চলতে সক্ষম হবে। এর যে আকার হবে তার চেয়েও ছোট আকারের কিছুতে সে চলে যেতে পারবে অনায়াসে।
ডিএআরপিএ’র ড. মিচেল জাকিং বলেছেন, সামরিক অভিযানের সময় কোন প্রকাশ্য অবস্থানে থাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ অভিযানের প্রয়োজনে এটি করতে হয়। এ পর্যায়ে যদি এমন কোনো রোবট থাকে যার আকার হবে ক্ষুদ্র এবং সেটি তার দেহের চেয়েও ছোট স্থান দিয়ে ঢুকে যেতে সক্ষম, তাহলে তা ঝুঁকিবিহীনভাবে ব্যবহার করা যাবে। তার বিশ্বাস নতুন প্রজাতির নরম, নমনীয় রোবট যদি তৈরি করা যায় তাহলে সেটি অনেক মূল্যবান কাজে লাগবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com