লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
বাজেট ও আইসিটি
করভারের প্রযুক্তি বাজেট
আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলেছেন খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অপরদিকে এই বাজেটকে পরোক্ষভাবে করভারনির্ভর বলে মন্তব্য বিশ্লেষকদের। আর বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেও তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে গণমনে যেমনি সংশয় দেখা দিয়েছে, তেমনিভাবে সংশ্লিষ্টরা অতিরিক্ত করভার সামাল দেয়ার কৌশল খুঁজে পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় ভোক্তাদের কী গতি হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। কেননা, বাজেটে সিমকেন্দ্রিক সেবা ব্যয়, কমপিউটার, যন্ত্রাংশ ও কমপিউটার-সংশ্লিষ্ট পণ্যে আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বরং ই-কমার্স ও অনলাইন শপিংকে করমুক্ত সীমার বাইরে রাখা হয়েছে। প্রযুক্তিভিত্তিক সেবার প্রসারেও নতুন করে কোনো সুবিধা যুক্ত হয়নি বাজেটে।
তবে সব ছাপিয়ে বরাবরের মতো এবারও দৈনিক পত্রিকা আর অনলাইনগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দের কথাটিই বেশ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় ও তা থেকে লব্ধ সুবিধা বা প্রাপ্তির বিষয়টি থাকছে একেবারেই অন্তরালে। তাই এক খাতের বরাদ্দ অন্য কোনো খাতে ব্যয় হওয়ার সংশয়টা এবার আরও প্রবল হয়েছে। কেননা, উন্নয়ন খাতে সরকারের এই বরাদ্দ করা অর্থের সুফল প্রত্যক্ষভাবে প্রান্তিক মানুষ পর্যায়ে পৌঁছে না। মূলত তাদেরকে হজম করতে হয় তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবার ওপর আরোপিত করভার। এবারের বাজেটে সেই ধাক্কাটিই এসেছে প্রবলভাবে। শুরুতেই দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের সবচেয়ে বর্ধিত খাত মোবাইল ফোন সিমভিত্তিক সব ধরনের সেবার খরচ যেমন বাড়ানো হয়েছে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও পুনঃউৎপাদন খাত হিসেবে বিবেচিত হার্ডওয়্যার খাতের অনেক পণ্যের দামও ক্রেতার সামর্থ্যকে আঘাত করবে।
বরাদ্দ বেড়েছে, বেড়েছে করভার
একদিকে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য এই খাতে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত ২ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে এই প্রস্তাব পেশ করেন তিনি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য এই খাতের বরাদ্দ ৬২১ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের জন্য বরাদ্দ করা ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। একই সাথে এই খাতের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২২৯ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত বরাদ্দের কতভাগ অতিরিক্ত শুল্ক ও কর হিসেবে সরকারের ঘরে ফেরত যাবে, সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে।
একটু পেছনে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে আইসিটি খাতে সার্বিক বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়িয়ে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জন্য বরাদ্দ করা বাজেট পরে সংশোধন করে ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮ হাজার ৩০৬ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে (৬ হাজার ২৪২ কোটি টাকা থোক বরাদ্দসহ)। আট বছরে আইসিটি খাতের বরাদ্দ ৩.৫২ গুণ বেড়েছে। এ বরাদ্দের পরিমাণ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির ০.৪৮ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ২.৪৪ শতাংশ।
শিক্ষাতে ভর করে প্রকল্পহীন বরাদ্দ
২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ এবার শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে। টাকার অঙ্কে বেড়েছে তা ১১ হাজার ৯০৫ কোটি। মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৭ ভাগ অর্থ এবার এই খাতে খরচের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বরাদ্দ বৃদ্ধি ছাড়া এবার এ খাতে নতুন কোনো বড় সুখবর নেই। বেসরকারি শিক্ষকদের বহুল প্রত্যাশিত এমপিওভুক্তি খাতে আগামী অর্থবছরেও নতুন বরাদ্দ দেয়া হয়নি। শিক্ষা খাতে বড় ধরনের কোনো নতুন প্রকল্পও হাতে নেয়া হচ্ছে না। বরং চলমান প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট ৪৯ হাজার ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিগত সময়ের হিসেবে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে এটাই সর্বোচ্চ বরাদ্দ। শিক্ষায় এ বরাদ্দ চলতি বছরের তুলনায় ১১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে শিক্ষা খাতে (শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়) মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৩১ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। এই অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩৭ হাজার ১০৬ কোটি টাকা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মিলে শিক্ষা খাতকে বিবেচনা করা হয়। তবে গত বছরের মতো এবারও প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কেও একীভূত করে ‘শিক্ষা ও প্রযুক্তি’ খাত করা হয়েছে। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতেই বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ। এ খাতে ৫২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা ছিল প্রস্তাবিত বাজেটে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির সাথে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ ছিল গত বছর বাজেটের আলোচিত ঘটনা। ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে তা বাতিল করা হয়। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ ধরনের কোনো ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। তবে ব্যাপকভাবে জনপ্রত্যাশা থাকলেও শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, শিক্ষা খাতে নতুন প্রকল্প গ্রহণের কোনো আশ্বাস প্রস্তাবিত বাজেটে দেয়া হয়নি। একইভাবে আন্দোলনরত আইসিটি শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণ ও তাদের বেতন-ভাতা দেয়ার বিষয়টিও এখানে প্রাধান্য পায়নি।
অবশ্য সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের আলোকে ‘ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ’ শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। এরপর ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে, ২০১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে, ২০১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণিতে ও ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামের নতুন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান তিন বিভাগেই বিষয়টি বাধ্যতামূলক। এরপর ২০১১ সালের নভেম্বরে এক পরিপত্রের মাধ্যমে সরকার আইসিটি শিক্ষকদের এমপিও স্থগিত করে। বছরের পর বছর ধরে এমপিওভুক্তি বন্ধ থাকায় বেতন-ভাতা ছাড়াই পাঠদান করে আসছেন এসব শিক্ষক। এ বিষয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এসএম শামীমুর রহমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘আইসিটি’ খাতকে সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিলেও ধুঁকে ধুঁকে চলছে আইসিটি শিক্ষা। কমপিউটার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ করা সম্ভব নয়।
শুধুই আশাবাদ
ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে পরিকল্পনায় রেখে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রস্তাবিত বাজেটের এই ব্যয় বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে সাড়ে ১৫ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৯ শতাংশ বেশি। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে এই বাজেট অধিবেশনে প্রযুক্তি খাতের নানা দিক তুলে ধারেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি জাতীয় সংসদকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ভিলেজ স্থাপনের ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। নির্মাণাধীন ‘যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ ২০১৬ সালের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা যাবে।
তিনি বলেন, জাতীয় তথ্যসম্ভারকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক করার লক্ষ্যে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে টায়ার-৪ ডাটা সেন্টার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ই-গভর্ন্যান্স কার্যক্রম বাস্তবায়নে ইন্টার অপারেবিলিটি সমস্যা দূরীকরণ ও প্রক্রিয়া সহজসাধ্য করার জন্য ন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচার (এনইএ) উন্নয়নের কাজ করছে সরকার। পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সি-মি-উই-৫-এর ‘ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন’ স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। দেশে ইন্টারনেট সেবার সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, দেশের সর্বত্র দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সব মেট্রোপলিটন শহর, জেলা শহর ও উপজেলাগুলোতে বেজ ট্রান্সমিশন স্টেশন (বিটিএস) স্থাপন, ৩০০ কিমি অপটিক্যাল ফাইবার এবং বিটিএসগুলোর আমত্মঃসংযোগের জন্য দেশব্যাপী ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্গম ১২৮টি উপজেলার ১ হাজার ৫টি ইউনিয়ন পরিষদে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল নেটওয়ার্ক এবং ৫টি জেলার ১২টি দুর্গম উপজেলায় রেডিও লিঙ্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মহাকাশে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ প্রস্ত্তত, উৎক্ষেপণ ও গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনে একটি বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সাইবার স্পেস ও ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধসহ সব তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ‘ইন্টারনেট সেফটি সলিউশন’ নামে মনিটরিং ও রেগুলেটরি ব্যবস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। সাইবার অপরাধ থেকে রক্ষা পেতে সুদৃঢ় ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এ ছাড়া গ্রাহকসেবার মানোন্নয়ন এবং গ্রাহকের ফোন নাম্বার সুরক্ষার লক্ষ্যে মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) লাইসেন্স দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ এবং ইন্টারনেট সেবার গুণগত মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমরা অনেকখানি অগ্রসর হয়েছি। ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা যথাক্রমে প্রায় ১৩ কোটি ২০ লাখ ও ৬ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথও ১৮০ জিবিএসে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে সারাদেশে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় তথ্য বাতায়নে এখন পর্যন্ত জেলা, উপজেলা, বিভাগ, দফতর, অধিদফতরসহ ২৫ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট সন্নিবেশিত হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অপরাধমূলক কর্মকা-- তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার রোধে সিম ও রিমের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজও করা হয়েছে।
প্রযুক্তি খাতের ৪ স্তম্ভ এবং প্রান্তিক মানুষের মোহভঙ্গ
প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয়ে অগ্রাধিকার হয়েছে ই-সরকার, ই-শিক্ষা, ই-বাণিজ্য এবং ই-সেবার ক্ষেত্রে। বাজেট (২০১৬-১৭) উপলক্ষে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা : হালচিত্র ২০১৬’ শীর্ষক পুস্তিকায় এই চারটি খাতকে শক্তিশালীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ধারণার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হলে উন্নয়নের সব ধারায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন হবে উপযুক্ত বিনিয়োগ। মৌলিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই বিনিয়োগের প্রাধিকার নির্ধারিত হয়। বাজেট বক্তব্যে সংযুক্ত এই পুস্তিকায় ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য সরকার এবার চারটি বিশেষ ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিয়েছে। এতে তথ্যপ্রযুক্তির চারটি মৌলিক ক্ষেত্র হলো- সরকারের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে ই-গভর্ন্যান্স; মানবসম্পদ উন্নয়নে ই-শিক্ষা; দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে ই-বাণিজ্য এবং সরকারের সেবাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গড়ে তোলা ই-সেবা কেন্দ্র বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে বাজেট বক্তব্যে মোবাইল ফোন সিম ব্যবহার করে কথা বলাসহ অন্যান্য সেবার ওপর ২ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো, সিমকার্ড, স্ক্র্যাচকার্ড, ক্রেডিটকার্ড ও সমজাতীয় স্মার্টকার্ড তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার ও সাইবার নিরাপত্তায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর বিদ্যমান শুল্কহার ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব এবং কমপিউটার ও কমপিউটার সামগ্রীর ওপর অতিরিক্ত ৩ শতাংশ আমদানি শুল্ক (সেই সাথে আমদানি পর্যায়ে এটিভি বেড়ে যাওয়া) আরোপ করার প্রস্তাব সরকারের রূপকল্পের সাথে খাপ খাবে না। বরং ভোক্তার কাঁধে অতিরিক্ত মূল্যভার অসহনীয় হবে।
মোবাইল সেবা বাড়ল শতকরা ৫.৭৫ টাকা
প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফোন সিম ব্যবহার করে কথা বলাসহ অন্যান্য সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে মোবাইল ফোনের সিমের প্রতিটি সেবার সাথে যোগ হবে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক)। অর্থাৎ ১ শতাংশ সারচার্জ এবং ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক মিলে ১০০ টাকার টকটাইম বা ইন্টারনেট কিনতে গুনতে হবে ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা। এর ফলে গ্রাহককে শতকরা আরও ৫.৭৫ টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে। বাজেট প্রস্তাবের রাতেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি এসআরও জারি করে সব মোবাইল অপারেটরের ভয়েস কল, ইন্টারনেট ডাটা, এসএমএসসহ সিমের মাধ্যমে দেয়া সব সেবার ওপর শুল্ক বাড়ানোর নির্দেশনা দিলে সাথে সাথেই তা বাস্তবায়ন করে অপারেটরগুলো। বাজেট পেশের পরদিন থেকে ক্ষুদে বার্তায় মোবাইল অপারেটরদের ভয়েস কল, ইন্টারনেট ডাটা, এসএমএসসহ সিমের মাধ্যমে দেয়া সব সেবার ওপর শুল্ক বাড়ানোর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার এই বার্তা গ্রাহকদের সাথে ভাগ করতে শুরু করেছে মোবাইল অপারেটরেরা। বার্তায় বলা হয়েছে- ‘মোবাইল সেবার ওপর পূর্ব আরোপিত ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা আপনার ট্যারিফে প্রতিফলিত হয়েছে। রবির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।’ নিয়ম অনুসারে আগে ১০০ টাকায় ১৫ টাকা ভ্যাট দিলেও এখন ১১৫ টাকার ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক এবং ১ শতাংশ সারচার্জসহ ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হবে। তবে মোবাইল ফোনের সিমকার্ডে গত অর্থবছরের মতোই ১০০ টাকা রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটেও অর্থমন্ত্রী একইভাবে সিমকার্ড ও রিমভিত্তিক সেবার ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক করারোপ করেছিলেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং টেলিযোগাযোগ শিল্পসংশ্লিষ্টদের কঠোর সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী সেই কর ৩ শতাংশে নামিয়ে আনেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসআরও জারির মাধ্যমে নতুন করে ১ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করে আবারও গ্রাহকের ঘাড়ে করের বোঝা বাড়ানো হয়। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সেই ১ শতাংশ সারচার্জ রেখে আরও ২ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। গ্রাহকের ঘাড়ে এই বাড়তি করের বোঝায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল ফোন অপারেটরস বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব ও প্রধান নির্বাহী টিআইএম নুরুল কবীর বলেছেন, সিমকার্ড কিংবা রিমের ওপর ২ শতাংশ সম্পূরক কর সার্বিকভাবে মোবাইল সেবার খরচ বাড়িয়ে দেবে। এর ফলে গ্রাহকদের কাছে ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, অনেক গ্রাহক বাড়তি করসহ মূল্য পরিশোধে সমর্থ হবেন না। ফলে তারা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। সেবা সম্প্রসারিত না করতে পারলে মোবাইল অপারেটরেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ধরনের করারোপ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নের সাথে সাংঘর্ষিক। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জববার। তার ভাষায়, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রতিবছর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ভ্রান্তনীতির ফল। এর ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ ব্যাহত হবে। তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাঈদ খানের অভিমত, সাধারণ গ্রাহকদের ওপর এ ধরনের করারোপ ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে সরকারের প্রতিশ্রুতির সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন জানিয়েছেন, এই বাড়তি করচাপ ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে এই শিল্পের ভূমিকা ব্যাহত হবে। রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইকরাম কবীর বলেছেন, এর ফলে ডাটা এবং ভয়েস কল কমার পাশাপাশি সামগ্রিক রাজস্ব আয় কমবে।
হার্ডওয়্যার খাতে ব্যয় বাড়বে চারগুণ পর্যন্ত
প্রস্তাবিত বাজেটে কমপিউটার ও কমপিউটার সামগ্রী হিসেবে চিহ্নিত ১২টি এইচএস কোডের মধ্যে ১১টি কোডে অন্তর্ভুক্ত পণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে কমপিউটার, কমপিউটার যন্ত্রাংশ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, টোনার, কার্ট্রিজ, হার্ডডিস্ক, মডেম, ইথারনেট ইন্টারফেস কার্ড, নেটওয়ার্ক সুইচ, হাব, রাউটার, ইউপিএস, আইপিএস, ডাটাবেজ অপারেটিং সিস্টেম, ডেভেলপমেন্ট টুলস, ফ্ল্যাশ মেমরি কার্ড ইত্যাদি পণ্যের দাম কমপক্ষে শতকরা সোয়া ৩ টাকা বাড়বে। এই ব্যয় মনিটর ও কমপিউটারের অন্যান্য যন্ত্রাংশ পর্যায়ে চারগুণ পর্যন্ত বাড়বে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রশস্ত পর্দার মনিটরের ওপর ৬০ শতাংশ এবং কমপিউটার সামগ্রীর ওপর পরোক্ষভাবে ৩১.৮ শতাংশ করচাপ বেড়েছে। এর ফলে ক্লোন পিসি নামে দেশে অ্যাসেম্বেল করা যে ডেস্কটপ পিসির বাজার দিন দিন ঋদ্ধ হচ্ছিল, তা হুমকির মুখে পড়বে। বিদেশী ব্র্যান্ডের পিসির বাজার প্রসারের মাধ্যমে দেশে প্রযুক্তি খাতে মানবসম্পদের উন্নয়নও সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। আইটি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির মুখপাত্ররা দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে করচাপ যুক্ত হয়েছে তা ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
ই-কমার্স খাত নিয়ে ধূম্রজাল
বাজেটে ই-কমার্স খাতের নতুন সঙ্গায়নের মাধ্যমে কিছুটা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, ‘অনলাইনে পণ্য বিক্রয়’ অর্থ ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক ব্যবহারের মাধ্যমে সেইসব পণ্য ও সেবার ক্রয়-বিক্রয়কে বোঝাবে, যা ইতোপূর্বে কোনো উৎপাদনকারী বা সেবা সরবরাহকারীর কাছ থেকে মূসক পরিশোধিত হয়েছে এবং যাদের কোনো বিক্রয়কেন্দ্র নেই। এই সঙ্গায়নে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, ই-কমার্স খাত বলে অন্য সাধারণ খাতের চেয়ে আলাদা কিছু থাকল না। কেননা, অনলাইনে বিক্রি করা পণ্যগুলোর জন্য বিক্রেতাকে আগেই কর দিতে হচ্ছে। আবার অনলাইন শপগুলোর মধ্যে বিক্রয় কেন্দ্র না থাকাটা এই খাতে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অথচ অর্থবিলে ই-কমার্স ও অনলাইন শপিং ২০২৪ সাল পর্যন্ত করমুক্ত বা কর-অবকাশ সুবিধা ছিল