প্রযুক্তি আর ভাষা দু-ই পরস্পরসংশ্লিষ্ট অনুষঙ্গ। এর একটিকে অবলম্বন করে অপরটির পথ চলা। একটি ছাড়া অন্যটি যেনো অচল। সেজন্য প্রযুক্তির ফসল সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে পৌঁছাতে হলে চাই গতিশীল ভাষা। এক্ষেত্রে মাতৃভাষাই হচ্ছে সবচেয়ে গতিশীল ও বোধগম্য ভাষা। সে জন্য প্রতিটি দেশই তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষাকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে সর্বাধিক পরিমাণে প্রয়োগের জোরালো প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, প্রযুক্তি প্রয়োগকে তৃণমূলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ায় মাতৃভাষাই হচ্ছে সর্বোত্তম বাহন। আমরা বাংলাভাষাকে যত বেশি করে তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারব, এর ফসলও বেশি থেকে বেশি মাত্রায় সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারব। আর এ কাজটি করার জন্য প্রযুক্তিতে বাংলাভাষার প্রয়োগপরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা ও উদ্যোগ-আয়োজন প্রয়োজন। আমরা প্রত্যাশিত মাত্রায় সে গবেষণা ও উদ্যোগ নিতে পারিনি একথা সত্য, তবে প্রাযুক্তিক অপরিহার্যতার কারণেই ইতোমধ্যেই এক্ষেত্রে আমরা কমবেশি অর্জনের ভাগীদার হয়েছি। বিভিন্ন মহল এক্ষেত্রে নানাধর্মী কর্মকান্ড পরিচালনা করে চলেছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। সে সূত্রে তাদের ভাগ্যে কিছু অর্জনও জুটেছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাভাষার প্রয়োগের এসব গবেষণা ও উদ্যোগের ওপর আলোকপাত করে আমাদের এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
ভাষার আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিতে মাসিক কমপিউটার জগৎ দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছর বাংলাভাষার প্রাযুক্তিক প্রয়োগ জোরদার করার তাগিদ রেখে এ ধরনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে। আমাদের প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সব মহল এক্ষেত্রে বাংলাভাষার উন্নয়নে অধিকতর মনোযোগী হবে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের মহতী প্রয়াসের সূত্রে এরই মধ্যে অনেক বাংলা সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি এসব সফটওয়্যারের বেশিরভাগই ইউজার-ফ্রেন্ডিল নয়। ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীরা এসব সফটওয়্যার ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন না। এসব বাংলা সফটওয়্যার যাতে অধিকতর সহজে ব্যবহারোপযোগী হয় সেজন্য আরো ব্যাপক গবেষণা পদক্ষেপ দরকার। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের সরকারি আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা অপরিহার্য। নইলে উদ্যোক্তারা ও গবেষকেরা এ ব্যাপারে এক সময় উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। তখন প্রযুক্তিতে বাংলার প্রয়োগে সামগ্রিক ধস নেমে আসবে। এতে আমরা যে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হবো, তা পূরণ হয়তো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। অতএব সময় থাকতে সাবধান হওয়াই শ্রেয়। অতীতে এর অভাবে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সীমাহীন পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি আমাদের কারো না বোঝার কোনো কারণ নেই।
আমরা এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বলি। জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধি ও শাসকশ্রেণীর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা বলি। আর এক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ সে কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম, তা আজ সুপ্রমাণিত। উল্লিখিত জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সবার আগে আন্তরিক উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে জনপ্রতিনিধি ও শাসকশ্রেণীকেই। এক্ষেত্রে একটি বাস্তব উদাহরণ সম্প্রতি সূচনা করেছেন নওগাঁ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী। তিনি গত ২১ জানুয়ারি তার নির্বাচনী এলাকা মহাদেবপুর উপজেলা অডিটরিয়ামে স্থানীয় নাগরিক কমিটির মাধ্যমে উপজেলার যাবতীয় কর্মকান্ডের ডাটাবেজ তথ্যউপাত্ত উপস্থাপন করেন জনগণের সামনে। ‘জনগণের মুখোমুখি সংসদ সদস্য : কর্মকান্ডের জবাবদিহিতার এক বছর ২০০৯’ শীর্ষক এ উপস্থাপন অনুষ্ঠানে তিনি তার নির্বাচনী এলাকা মহাদেবপুর উপজেলার ৩০টির বেশি দফতরের যাবতীয় কর্মকান্ড তুলে ধরেন। পাঁচশ’ বেশি প্রতিনিধির সামনে তিনি সর্বসাধারণের নানা প্রশ্নেরও জবাব দেন। এই গবেষণাধর্মী জবাবদিহিমূলক ডিজিটাল উপস্থাপনের মূলে ছিল ‘সেন্টার ফর ই-পার্লামেন্ট রিসার্চ’। আমাদের বিশ্বাস এ ধরনের উদ্যোগ দেশে সুষ্ঠু জবাবদিহিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের একধাপ উত্তরণ ঘটলো। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইর প্রতি রইলো আমাদের অভিনন্দন।
প্রযুক্তিকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে যারা সফল, তাদের সাফল্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নানামুখী বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ টানতে পারি ভারতের ‘সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অব অ্যাডভান্সড কমপিউটিং’ তথা সি-ড্যাক-এর। সুপার কমপিউটিং তথা অগ্রসর মানের নানা ধরনের কমপিউটিংয়ে এ কেন্দ্রটি অসাধারণ অবদান রেখে চলেছে। কমপিউটিংয়ের ক্ষেত্রে জোরালো অগ্রগতি অর্জন করতে হলে আমাদেরকেও এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এ কেন্দ্রটি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবারের ‘ভারতের সি-ড্যাক ও ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা। আশা করি লেখাটি আমাদের নীতি-নির্ধারকদের নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দেবে।