লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
বিএমডিএ’র ডিজিটালাইজেশন নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) আয়োজনে এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইজেডওয়াই কর্পোরেশনের সহযোগিতায় গত ২১ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিএমডিএ’র প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘ডিজিটালাইজেশন অব বিএমডিএ : প্রোগ্রামস, প্র্যাকটিসেস, ম্যাপিং সারফেস ওয়াটার, গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জিং অ্যান্ড মনিটরিং অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন অ্যান্ড মিটিগেশন থ্রো প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার’ শীর্ষক সেমিনার। বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক মো: আবদুর রশীদের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এমপাওয়ারের কনসালট্যান্ট ই-কৃষি বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ মো: নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের মহাসচিব ও মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর সহকারী সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল হক অনু, ইজেডওয়াইয়ের বিজনেস ম্যানেজার (বাংলাদেশ) হিমেল চৌধুরী, সোর্স অ্যান্ড সার্ভিসের সিইও প্রকৌশলী মো: আবুল কালাম আজাদ। সেমিনারে বিএমডিএ’র দুই শতাধিক প্রকৌশলী উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে-বিদেশে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কৃষি, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, স্বল্প সেচের ফসল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। গত নভেম্বরে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের পানিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্যানেলের সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সাতটি এজেন্ডা তুলে ধরেন। পঞ্চম এজেন্ডায় তিনি বলেন, ‘কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ব্যাপকভাবে পানি ব্যবহার হচ্ছে। এ জন্য সীমিত পানি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন করা যায় এমন জাতের উন্নয়নে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে বিএমডিএ’র উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট সেক্টরের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন ও পরামর্শে ইতোমধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার করে স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে। পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও খরা সহনীয় নতুন জাতের সাথে কৃষকদের পরিচয় করাতে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিএমডিএ। খরা কোনো আতঙ্ক নয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি খরাপ্রবণ এলাকা বিদেশে আছে। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ও খরা সহনশীল জাতের উচ্চমূল্যের নানা ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। খরা সহিষ্ণু জাত এবং পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে কৃষকদের মোটিভেশনাল ট্রেনিং দিতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে বিএমডিএ।
বিএমডিএ’র চেয়ারম্যান আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষিত লোকদের কৃষিকাজে অনীহা দূর করতে হবে। কৃষিকে আরও বেশি করে যান্ত্রিকীকরণ করা হলে শিক্ষিতরা কৃষি কাজে আগ্রহী হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে প্রধানমন্ত্রীর মূল্যবান পরামর্শ বাস্তবায়নে বরেন্দ্র অঞ্চলে কাজ করছে বিএমডিএ। আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে ইতোমধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের কৃষিঋণের আওতায় বিনা জামানতে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর এবং বদলগাছি উপজেলার কৃষক গ্রুপের মাঝে ভিএমপিসহ পাওয়ার টিলার মেশিন প্রদান করা হয়েছে। কম পানি, কম বীজ, কম সার ও কম ডিজেল ব্যবহার করে কৃষি সুরক্ষা যান্ত্রিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই দিকে লক্ষ রেখে কৃষকদের ভার্সাটাইল মাল্টিক্রপ প্লান্টার (ভিএমপি) মেশিন দেয়া হয়েছে।
বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক মো: আবদুর রশীদ বলেন, আগামী ২১ জানুয়ারি রাজশাহীতে বিএমডিএ’র আয়োজনে ‘ফার্স্ট বারিন্দ অ্যাগ্রো ইকোলজিক্যাল ইনোভেশন প্ল্যাটফর্ম’ নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এই সম্মেলন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি খাতের উন্নয়ন নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, ‘প্রায় সাত কোটি জনসংখ্যা নিয়ে একসময় বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। কৃষি খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সফল অভিযোজনের ফলে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। আগে দেশের জনসংখ্যা কম ছিল এবং চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ ছিল বেশি। এখন জনসংখ্যা বেশি। চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ অনেক কম। তারপরও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মেধা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। ভবিষ্যতে কৃষি খাতে গবেষণা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার বাড়ানো গেলে ফসল উৎপাদন বহুগুণে বাড়বে।
বক্তারা বিএমডিএ’র ডিজিটালাইজেশন নিয়ে অনেকগুলো মূল্যবান পরামর্শ দেন। এসবের মধ্যে রয়েছে- কৃষকদের জন্য ডিজিটাল হেল্প ডেস্ক চালু করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে কৃষকেরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে যেকোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান পাবেন। মোবাইল ফোনে তথ্যসেবা পেতে কল করার জন্য একটি শর্ট কোড থাকতে পারে। হেল্প ডেস্কের আওতায় কৃষকদের সম্ভাব্য প্রশ্ন ও সমস্যা নিয়ে তথ্যভা-ার তৈরি হতে পারে। তথ্যভা-ারের ভিত্তিতে রেকর্ডেড কণ্ঠস্বরনির্ভর মেসেজ তৈরি করা যেতে পারে, যাতে কৃষকের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর wতনি ফোন করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুনতে পারেন।
বরেন্দ্র এলাকায় কৃষি ব্লকভিত্তিক অনলাইন পিএইচ ডাটাবেজ তৈরি এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা প্রয়োজন। মাটির পিএইচ দেখে সম্ভাব্য কৃষি ফসল এবং সার সুপারিশ করলে কৃষি উৎপাদন অনেক বাড়বে। মাটির উর্বরতা ঠিক থাকবে। অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বরেন্দ্র এলাকার কৃষি পণ্য অনলাইনে বিক্রি করতে একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। এই সাইটের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। কৃষকের খামারে উৎপাদিত ফল-ফসল ভিডিও কলের মাধ্যমে ক্রেতা কেনার আগে দেখতে পারবেন। কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইন নিয়ে বড় উদ্যোগ নিলে কৃষক অনেক লাভবান হবেন।
কৃষিতে ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) ব্যবহার বাড়াতে হবে। এটি আমাদের কৃষিকে বৈপ্লবিকভাবে পাল্টে দিতে পারে। সবচেয়ে বেশি পানি সাশ্রয় করে অধিক ফসল উৎপাদন করতে হলে জমিতে সয়েল ময়েশ্চার সেন্সর লাগিয়ে ফসল অনুযায়ী জমিতে পানির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে। এতে অনেক পানি সাশ্রয় হবে। বিএমডিএ’র গভীর নলকূপে দিনের বেলায়ও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। এতে অনেক বিদ্যুৎ ও অর্থ অপচয় হয়। লাইট সেন্সরের মাধ্যমে বিএমডিএ’র গভীর নলকূপের বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ট্রান্সফর্মারে বিশেষ ডিভাইস লাগিয়ে চুরি ঠেকানো এবং সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে অনলাইনে সেচপাম্প মনিটর করে যেতে পারে। জিপিএসভিত্তিক বিএমডিএ’র সড়ক, সেচপাম্প, জলাধারসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ডিজিটাল ম্যাপিং করলে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। স্যাটেলাইট চিত্র, আবহাওয়া ও জলবায়ুর তথ্য বিশেস্নষণ করে কৃষককে ফসল সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করা যেতে পারে।
আধুনিক কৃষির সাথে কৃষককে খাপ খাওয়াতে মোটিভেশনাল ট্রেনিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের বড় একটি কৃষিভিত্তিক এলাকা নিয়ে বিএমডিএ’র কার্যক্রম। এখানকার কৃষি, পরিবেশ, জলবায়ু, আবহাওয়া, বিষয়ভিত্তিক গবেষণা ও তথ্যসেবা দ্রুত কৃষকের কাছে পৌছাতে হলে অনলাইন ডাটাবেজ গড়ে তুলতে হবে। বিএমডিএ’র দৈনন্দিন বিভিন্ন কার্যক্রম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করলে জনসাধারণ প্রতিনিয়ত হালনাগাদ তথ্য পাবে।
বিএমডিএ’র সব কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে অটোমেশন করা ও ই-ফাইলিং চালু করা যেতে পারে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে কৃষি সেবা নিতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা করতে হবে। কৃষকেরা যদি স্মার্টফোন ব্যবহার করে তাদের উৎপাদন, বাজারজাতসহ সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে পারেন, তাহলে সবার মধ্যে একধরনের সাড়া পড়ে যাবে এবং কৃষি খাতে আরও উন্নয়ন ঘটবে। সঠিক সময়ে সঠিক জাতের ফসল চাষ এবং জমিতে তিন থেকে চার ফসল নিশ্চিত করতে ডিজিটাল কৃষি ক্যালেন্ডারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বরেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকার কৃষি জমি এবং ভূ-প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে এই ক্যালেন্ডার তৈরি করা সম্ভব। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বরেন্দ্র এলাকায় কৃষি পর্যটন চালু করা যেতে পারে।
সেমিনারে বক্তারা বিএমডিএ’র কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি, কৃষকদের বিভিন্ন সচেতনতামূলক এসএমএস প্রদান, পিএইচ ল্যাব, কৃষকদের ট্রেনিং, ফসল উৎপাদনে খরা মনিটরিং ও এই সম্পর্কিত সতর্কবার্তা প্রদান, কৃষকদের পণ্যের ভ্যালু চেইন, বারিন্দ ফার্মারস বিজনেস অ্যাডভাইজরি সার্ভিস, স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে কৃষি তথ্যসেবা, স্মার্টফোন অ্যাপ, কৃষকের জন্য আইভিআরভিত্তিক অ্যাপ, বিএমডিএ’র ইআরপি, ডাটাওয়্যার হাউজ, আইওটি’র ব্যবহার, হার্ডওয়্যার সাপোর্ট, সোলার সেচপাম্প স্থাপন এবং অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রি, লাইট সেন্সর, প্রযুক্তি ডিভাইস ব্যবহার করে ট্রান্সফর্মারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বৃষ্টির পানি হারভেস্ট করে রিচার্জ এবং ভূগর্ভস্থ পানি মনিটরিং, ই-সেচ পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত অলোচনা করেন।
জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে কৃষি খাতের অবদান বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নে এ খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকে সহজলভ্য, সাশ্রয়ী ও কৃষকবান্ধব করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই কৃষকের কাছে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার