লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৭ - ফেব্রুয়ারী
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
হাওয়ায় ভাসছে ডিজিটাল বাংলা
ভাষার দেশ বাংলাদেশ। ভাষা ব্যবহারকারী বিবেচনায় বিশ্বে বাংলার অবস্থান সপ্তম। আর জনসংখ্যার হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। অবশ্য আয়তনের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে নবম। প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা থাকলেও জনসম্পদ আমাদের শক্তি। প্রযুক্তি রূপান্তরের এই নতুন সোপানে এসে মেধাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে অর্জিত হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সেই পথেই এখন এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল শক্তিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বিনির্মাণ করা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। নির্ধারণ করা হয়েছে রূপকল্প-২০২১। এই লক্ষে্যর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ডিজিটাল রূপান্তর। আর তা বাস্তবায়নে হাতে আছে মাত্র চার বছর। এর মধ্যেই দেশকে মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে রয়েছে ‘ভাষা’। এই বাধা দূর করতে দেরিতে হলেও আশার আলোর দেখা মিলছে গুহার শেষ প্রামেত্ম। হাওয়ায় ভাসমান ‘বাংলা’ ভাষার ডিজিটাল রূপান্তরের টেকসই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে অবশেষে। ইতোমধ্যেই আমরা পেয়েছি বাংলায় ইন্টারনেট ঠিকানা তৈরির অধিকার। মিলেছে বাংলাভাষাবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে একই আবর্তে ঘূর্ণায়মাণ অবস্থা থেকে উত্তরণের আভাস। নেয়া হয়েছে যুগপৎ গবেষণা ও উন্নয়ন পদক্ষেপ। প্রত্যাশা করা যায় এবার হয়তো বাংলা কিবোর্ড, ফন্ট তৈরির মুখরোচক আলোচনা আর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কথা’, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মঙ্গলদ্বীপ’, ‘সুবচন’ আর টিম ইঞ্জিনের ‘পুঁথি’র মতো তুঘলকি কা- থেকে রক্ষা মিলবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাষার দূরত্ব ঘুচতে সক্ষম হব আমরা। কেতাদুরস্ত হতে গিয়ে আর আলগা করব না নাড়ির বাঁধন। উপনিবেশবাদের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাভাষাকে ছড়িয়ে দেব প্রতি প্রাণে। অভ্যন্তরীণ দাফতরিক কাজে বাংলাভাষাকে আর অগ্রাহ্য করা হবে না। ওয়েবে বাংলার জয়জয়কার হবে। হাওয়ায় গা না ভাসিয়ে জোর গলায় বলতে পারব এবার পালা ‘বাংলা’র।
এবার পালা ‘বাংলা’র
বাংলাভাষার সাথে আমাদের রক্তের টান, নাড়ির বাঁধন যে কতটা সুগভীরে তার নজির এখন ভাসছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়ও। বিশ্বে ২১ ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতির পর ইন্টারনেট মাধ্যমে বাংলা অক্ষরে লিখে আজ আমরা আমাদের আদিম পরিচয়ে পৌঁছে গেছি ভার্চুয়াল জগতে। বাস্তব আর পরাবাস্তবতায় জড়াজড়ি করে রয়েছে আমাদের রক্তাক্ত বর্ণমালা। ইংরেজি ও ম্যান্ডারিন ভাষার পর পৃথিবীর চতুর্থ ভাষা হিসেবে ইন্টারনেট জগতে সমহিমায় অবির্ভূত হয়েছে বাংলা বর্ণমালা। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৩২ কোটি বাংলাভাষিকে একই বৃমেত্ম দুটি ফুলের মতো বেঁধেছে ‘ডটবাংলা’।
এক দশকের অপেক্ষা
বাংলাভাষার ইন্টারনেট ভবিষ্যতের জন্য ডটবাংলা আশার প্রতীক। এ প্রতীক বাংলাদেশের জন্য নতুন নিশান। এই নিশান অর্জন করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে এক দশক। কেননা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার স্বীকৃতি পেতে যেমনটা বিপ্লব করতে হয়েছে; ইন্টারনেট ডোমেইন ডটবাংলার স্বীকৃতি পেতেও হোঁচট খেতে হয়েছিল। এ ডোমেইনের জন্য পশ্চিম বাংলা এবং সিয়েরা লিওন আবেদন করেছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার সাথে তো আমাদের ‘রক্তের’ বাঁধন। তাই সে বাঁধনকে অস্বীকার করতে পারেনি ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস (আইক্যান)। এক দফা বাতিল করা হলেও গেল বছর জুনে ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস (আইক্যান) পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে এই ডোমেইন নেম বরাদ্দ দেয়া হয়। আর গেল ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলায় ওয়েব ঠিকানা লিখে ইন্টারনেট বিশ্বে বাংলার জয় ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গভবন থেকে উদ্বোধন করেন তার কার্যালয় থেকে পরিচালিত অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের অধীনে ডেভেলপ করা ডট বাংলার প্রথম ওয়েব পোর্টাল উত্তরাধিকার।
কী এই ডটবাংলা?
ওয়েব এক অতলান্ত জগৎ। এই জগতে পরিচয় শনাক্ত করার একমাত্র পথ ডোমেইন। ডটকম, ডটনেট, ডটবিজ, ডটইনফো, ডটঅর্গ ছাড়াও প্রতিটি দেশের জন্য রয়েছে ভিন্ন ডোমেইন। এগুলো সাধারণত দেশের নামের সূচনা অক্ষর দিয়ে শুরু হয়ে থাকে। যেমন- ইন্টারনেট দুনিয়ায় বাংলাদেশের পরিচয় ডটবিডি। ডটবাংলার মাধ্যমে এবার ভাষার ক্ষেত্রেও অনন্য পরিচয় পেল বাংলাদেশ। ফলে এখন আর আমাদের সার্চ বারে ইংরেজিতে ডোমেইন নেম লিখতে হবে না। বাংলা অক্ষরে লিখলেই চলবে। অবশ্য এজন্য আগেই ডোমেইনটিকে ডটবাংলা (.বাংলা) ডোমেইনে নিবন্ধন করতে হবে। পাঠক চাইলে কিবোর্ডে আপনিও পরখ করতে পারেন। আগে যেমনটা সার্চ বারে http://www.btcl.com.bd না লিখে বিটিসিএলডটবাংলা লিখলেই চলে আসবে বিটিসিএলের ওয়েবসাইট। ডটবিডি না লিখে ইউআরএলে বাংলায় ডটবাংলা লিখেও মিলবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পরিচয়। কেননা ভাষাভিত্তিক ডোমেইনে এখন ডটবাংলা ইউনিকোড দিয়ে স্বীকৃত বাংলাদেশি ডোমেইন। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই বাংলায় ওয়েবসাইট খুলতে হলে বাংলাদেশ থেকেই অনুমতি নিতে হবে।
যেভাবে এলো ডটবাংলা
২০০৯ সালের ১৫-১৮ নভেম্বর। মিসরের দ্বীপশহর শার্ম আল শেখে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের চতুর্থ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের বৈশ্বিক সভা। সেই সভায় বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের (বিআইজিএফ) উদ্যোগে যোগ দেন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিআইজিএফের বর্তমান মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল হক। অধিবেশনের আগে ডোমেইন সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন নজর কাড়ে তার। তিনি বিষয়টি নিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সাথে আলোচনা করেন। এরপরই আইক্যানের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রড বেকস্ট্রমের সাথে ডটবাংলা ডোমেইন বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। সফর শেষে তৎকালীন সংসদীয় সভায় এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন। এরপর ২০১০ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি ডটবাংলার জন্য আইক্যানে অনলাইনে আবেদনপত্র জমা দেন প্রধানমন্ত্রী। দুই বছরের মাথায় ২০১২ সালে ডটবাংলা ডোমেইনটি ব্যবহারের অনুমতিও মেলে। কিন্তু কারিগরি জটিলতার কারণে ২০১৫ সালে ডোমেইনটি ব্যবহারের অনুমতি হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের প্রতিক্রিয়ায় এক পর্যায়ে ডোমেইন উদ্ধারে বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সক্রিয় হয়। এরই মধ্যে এই ডোমেইনের জন্য আবেদন করে বসে ভারত ও সিয়েরা লিওন। সবশেষে ৫ অক্টোবর ইন্টারনেটে ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডোমেইন (আইডিএন) ডটবাংলা (.বাংলা) ব্যবহারের চূড়ান্ত ছাড়পত্র পায় বাংলাদেশ।
কীভাবে মিলবে ডটবাংলা
বাংলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইন্টারনেট কান্ট্রি কোড টপ-লেভেল ডোমেইন (সিসিটিএলডি)। এই ডটবাংলা ডোমেইনের নিয়ন্ত্রক ডটবিডির মতোই বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির সাথে এই ডোমেইনের কারিগরি উন্নয়নের সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অপারেটর। আর এটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যেই ডটবাংলা নিবন্ধনের জন্য এক হাজার আবেদন জমা পড়েছে। ডটবাংলাকে জনপ্রিয় করতে আসছে একুশে বইমেলাতেও ডটবাংলার প্রচারণা ও নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডটবাংলার অপারেশনের দায়িত্বে থাকা বিটিসিএলের বিভাগীয় প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম। তিনি জানান, উদ্বোধনের পর থেকে ১ জানুয়ারি থেকে নিবন্ধনের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রথমে দেশের সাংবিধানিক, সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্র্যান্ডনেম প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে। নিবন্ধনের জন্য ডাটা মাইগ্রেশন হয়ে গেছে। এখন জোন ফাইল থেকে সিঙ্ক করার কাজ বাকি। তাও শেষ পর্যায়ে।
এদিকে ডটবাংলায় নিবন্ধন পেতে ইতোমধ্যেই উইকিপিডিয়া, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ডোমেইন নিতে সংশ্লিষ্টরা আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন বিটিসিএল পরিচালক (জনসংযোগ) মীর মোহাম্মদ মোরশেদ। তিনি জানান, ১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে সর্বসাধারণের জন্য ডটবাংলা ডোমেইন উন্মুক্ত করা হয়েছে। একুশে বইমেলায় ৫০ নম্বর স্টল থেকে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করা যাচ্ছে। ৫০০ টাকার বিনিময়ে ডটবাংলা ডোমেইনে নাম নিবন্ধন করা যায়। বিটিসিএলের ওয়েবসাইটেও নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট ফি’র সাথে সরকার নির্ধারিত ভ্যাট ও অনলাইনে ফি পরিশোধের খরচ দিয়ে যেকোনো ব্যক্তি পছন্দের নাম নিবন্ধন করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা ফি দিতে হবে।
বাংলাভাষার ডিজিটাল রূপান্তরে শুভঙ্করের ফাঁকি
বাংলাভাষার ডিজিটাল রূপান্তরের কাজ শুরু হয় দুই যুগ আগে। রাষ্ট্রীয় ও দাফতরিক কাজে বাংলার ব্যবহার নিয়ে ১৯৫২ সালে ছাত্র-জনতার ভাষা সংগ্রামে আন্দোলিত হয়ে শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। এরই মধ্যে ১৯৬৯ সালে দেশে আনা হয় প্রথম বাংলা টাইপরাইটার মেশিন। আর স্বাধীনাতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে আসে অপ্টিমা মুনীর টাইপরাইটার মেশিন। এরপর ১৯৮৪ সালে কমপিউটার জগতে বাংলার বিপ্লব ঘটায় ‘বিজয় বাংলা’। অবশ্য প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতায় মুদ্রণ মাধ্যমে ভালো করলেও সহস্রাব্দের ঊষালগ্নেও ওয়েববিশ্বে বাংলার ব্যবহার ছিল সীমিত। ১৯৮৪ থেকে ২০০২ পর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করে প্রায় ২০টির মতো বাংলা কিবোর্ড সফটওয়্যার। ১৯৬৯ সালে আসে মুনীর কিবোর্ড। ১৯৭৩ সালে আমরা পাই বাংলা টাইপরাইটার প্রবর্তন। ১৯৮৬ সালে আত্মপ্রকাশ করে শহীদলিপি এবং ১৯৮৮ সালে বিজয় কিবোর্ড। এখন পর্যন্ত অন্যান্য কিবোর্ডের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিজয়। অবশ্য বিজয়ের আগে, সমসাময়িককালে ও পরে আমরা মুনীর কিবোর্ড (প্রফেসর মুনীর চৌধুরী একটি আধুনিক বাংলা টাইপরাইটার ডেভেলপড করেন), রূপালী কিবোর্ড, প্রভাত কিবোর্ড, একুশে কিবোর্ড উল্লেখযোগ্য। বিজয়ের কপিরাইট জটিলতা থাকলেও একুশে কিবোর্ড শুরু থেকেই বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং একে ওপেনসোর্সও রাখা হয়। একুশে কিবোর্ডের জনক ড. রুবিন আপটন (Dr. Robin Upton) নিজ উদ্যোগে ই-মেইল করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তার বাংলা টাইপ করার এই কিবোর্ডটি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন। একজন ফিরিঙ্গির এই অবদানটাও আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। ইতিহাস বলছে, প্রতিটি কিবোর্ড লে-আউট প্রযুক্তির জগতে বাংলাকে ছড়িয়ে দিতে একেকটি ধাপ হিসেবে কাজ করেছে। দুই-তিন ধাপের পর আমরা বিজয় পেয়েছিলাম। তারপর আরও অনেক ধাপ পার হয়ে আমরা পেয়েছি ইউনিকোডে বাংলা লেখার সুযোগ। ২০০৩ সালে আবির্ভূত হয় অভ্র। ভার্চুয়াল জগতে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায় মূলত বাংলা ব্লগ এবং এরও পরে আমাদের ফেসবুক-নির্ভরশীলতার কারণে। অবশ্য ২০০৫-এর পরবর্তী সময়ে অভ্র-নির্ভরশীলতা বাড়ার পর দেখা দেয় নতুন বিতর্ক। সমসাময়িক সময়ে জাতীয় কিবোর্ড, ইউনিজয়সহ নিকষ, আমার বর্ণমালা, আবির্ভাব ইত্যাদি নানা ফন্ট নিয়ে যেনো একই আবর্তে ঘুরেছেন আমাদের প্রযুক্তিশিল্পীরা। বাংলাভাষার উন্নয়নে কমপিউটার কাউন্সিল, নির্বাচন কমিশন ও এটুআই তিন সেট বাংলা ফন্ট তৈরি হলেও তা সাধারণের মন পায়নি। অবশ্য ভাষার কোড ও কিবোর্ড প্রমিতকরণের ইঁদুর-দৌড় শেষতক আলোর মুখ দেখে ২০১১ সালে। আর ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের প্রাতিষ্ঠানিক সদস্যপদ লাভ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহৃত বাংলা লিপি প্রমিতকরণে এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, সংযোজন করার ক্ষেত্রে ভোটাধিকার লাভ করে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বর্ণ সঙ্কেতায়ন ব্যবস্থা-ইউনিকোডে বাংলাভাষা যুক্ত হওয়ার পর এর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গিয়েছিল। জনপ্রিয় ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগল ১৩০টি ভাষার সাথে বাংলাকেও যুক্ত করে। বছর সাতেক ধরে কমপিউটারে ফোনেটিক কিবোর্ড ব্যবহার করে খুব সহজেই সব ধরনের বাংলা লেখা সম্ভব হচ্ছে। ফলে যারা কিবোর্ডের কোথায় কোন বাংলা হরফ আছে তা জানেন না, তারাও সহজেই বাংলায় লিখতে পারছেন। লেখার ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও পড়াশোনা কিংবা বলার ক্ষেত্রে যেমন পিছিয়ে আছে, তেমনি অনধাবনেও আছে দুর্বলতা। তাই এখনও বাংলা বর্ণ স্ক্যান করে বা এর ছবি দেখে কমপিউটার ঠিকমতো চিনতে পারে না। বলতে পারে না। এখনও বাংলা বাণীকে লিখিত বাক্যে রূপান্তর কিংবা বাংলা হাতের লেখা চিহ্নিতকরণ বিষয়ে এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ভাষাংশ ভা-ারের অপ্রতুলতা। টেকসই অভিধানের সঙ্কট। প্রায় এক দশক ধরে এ নিয়ে কাজ হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাভাষার প্রযুক্তিকীকরণে আমরা পূর্ণাঙ্গ সফলতা পাইনি।
এ নিয়ে খেদ প্রকাশ করে বিজয় বাংলার প্রবর্তক মোস্তাফা জববার বললেন, বাংলাভাষার প্রযুক্তিকীকরণে অতীতে আমরা অনেক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করেছি। অনুকরণ আর নকলিকরণে কাজ হয়নি। বিফলে গেছে। শুধু ওসিআর তৈরি করতে গিয়ে ৭ কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এবং এটুআই আলাদা আলাদাভাবে একই ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। জলে গেছে আইডিএফসির ৮০ হাজার ডলার।
তিনি আরও বলেন, বাংলা ভাষার নামে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলাভাষার উন্নয়নে শুধু নেতৃত্ব নয়, সব কাজই সরকারের করার কথা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার বাংলা টাইপরাইটার এবং বাংলা টাইপরাইটারকে বিদ্যুতায়নের গবেষণা নামক একটি প্রকল্প ছাড়া এর উন্নয়নে তেমন কোনো ভালো বা উপকারী কাজ ইতোপূর্বে দেখিনি। আশির দশকে যখন কমপিউটারে বাংলাভাষার উন্নয়নের প্রয়োজন ছিল তখন শহীদলিপি সফটওয়্যারটি জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট কিনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। এরপর বাংলাদেশ সরকার ’৯২ সাল থেকে বাংলাভাষার কোড ও কিবোর্ড প্রমিতকরণ করতে গিয়ে বারবার গুবলেট পাকিয়েছে। বিজয় কিবোর্ডকে নকল করে জাতীয় কিবোর্ড নামে একটি নকল কিবোর্ড তৈরি করার বাইরে সরকার ২০১১ সালে একটি বাংলা প্রমিত কোড সেট প্রণয়ন করেছে। অন্যদিকে বাংলাভাষার উন্নয়নের নামে কমপিউটার কাউন্সিল, নির্বাচন কমিশন ও এটুআই তিন সেট বাংলা ফন্ট তৈরি করেছে, যার কোনোটাই কেউ ব্যবহার করে না। ২৩ লাখ টাকার অনুদানের সহায়তায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে ওসিআর বানানোর প্রচেষ্টাও নিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই। এর পরের কথা সবার জানা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত ৪৫ বছরে পরিকল্পিতভাবে এক টাকাও খরচ করেনি বাংলাদেশ। নষ্ট ওসিআর মেশিন কিনতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অর্থ খরচ করে কিবোর্ড নকল করা হয়েছে।
একইরকম ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করলেন দৃষ্টিশক্তির প্রতিবন্ধকতাকে পোশ মানিয়ে নেয়া ডিজিটালি অ্যাকসেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেমের (ডিইসি) একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষক ভাস্কর ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্র্যাক বিশ্বদ্যিালয়ের কথা, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গলদ্বীপ ও সুবচন কোনোটাই ব্যবহার হয় না। সবগুলোই অকার্যকর। অনেক অর্থ ব্যয় হলেও তা ছিল মূলত তুঘলকি কা-। অবশ্য ওসব নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। কেননা ইতোমধ্যে আমরা নিজেরাই আমাদের সমাধান বের করে নিয়েছি। ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) মাধ্যমে আমরা বরিশাল, রাজশাহী, খুলনাসহ বিভাগীয় পর্যায়ে ৬টি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীবান্ধব ল্যাব স্থাপন করেছি। এখান থেকে ননভিজ্যুয়াল ডেস্কটপ অ্যাকসেস (এনভিডিএ) প্রযুক্তির ই-স্পিক ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সহজেই পড়তে ও লিখতে পারছে। ই-স্পিকে শুধু বাংলা নয়, দক্ষেণ এশিয়ার সাতটি ভাষা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখানে বাংলাভাষার উন্নয়নে আমি প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছি। আমার সাথে ইপ্সা সহকর্মী রাশেদুজ্জামান ও বাংলাদেশ ভিজ্যুয়াল এমপাওয়ার সোসাইটির নাজমা আরা পপি নিরলসভাবে কাজ করছেন।
জ্বলল আশার আলো
প্রাযুক্তিক রূপান্তরের ভেলায় চেপে মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে যাচ্ছে বংলাদেশ। জীবনের পলে পলে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে চারদিকে চলছে রাস উৎসব। কমপিউটার, মোবাইল, নানামাত্রিক অ্যাপের ব্যবহার বাড়ছে ধূমকেতু গতিতে। ইন্টারনেট সংযোগে বিশ্বসভায় ছড়িয়ে পড়ার অবকাশও তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রক্তে কেনা ‘ভাষা’র প্রযুক্তিকায়নে ছেলেবেলায় বষ্টুমীর আগমনী গান থামিয়ে ‘দেখিস একদিন আমরাও’ বলে যে আশা দেখিয়েছিল তা হয়তো এবার বাস্তবায়ন হতে পারে। হয়তো বা আর দেখিয়ে দেখিয়ে লজেন্স চোষার দিন ফুরাল। এবার হয়তো এই উন্নয়নের ধারায় ঠাঁই পাবে বাংলার ব্যবহার প্রত্যাশিত পর্যায়ে না পৌঁছায় বিপাকে পড়া কম-শিক্ষিত প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ।
পরিস্থিতির অন্তর্গত যন্ত্রণা অনুধাবন করে প্রযুক্তি খাতে বিশেষ করে কমপিউটারে বাংলাভাষার ব্যবহার বাড়াতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বাংলানির্ভর ১৬টি নতুন সফটওয়্যার তৈরির একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এজন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫৯ কোটি টাকা। এই অর্থে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে নেতৃস্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলা কমপিউটিং প্রতিষ্ঠা করা হবে। আইসিটি-সহায়ক বাংলাভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রমিত করা হবে। বাংলা কমপিউটিংয়ের জন্য উপকরণ, প্রযুক্তি এবং বিষয়বস্ত্তর উন্নয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সাথে আইসিটিতে বাংলাভাষা সমৃদ্ধকরণ ও আধুনিকায়নের জন্য সমীক্ষা, জরিপ এবং গবেষণা ও উন্নয়ন পরিচালনা করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে ‘বাংলাভাষা সমৃদ্ধকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। এরপর প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা ডাকে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য মো: জিয়াউল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কিছু সংশোধনী সাপেক্ষে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনুমোদন মেলে প্রকল্পটি। ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। প্রসঙ্গত, প্রকল্পটি চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ও অনুমোদন ছাড়াই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পে চলতি অর্থবছর ব্যয় হবে ১৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে ৬৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয় হবে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় করা হবে ৭৮ কোটি ১২ লাখ টাকা। সব মিলে ব্যয় দাঁড়াবে ১৫৯ কোটি ২ লাখ টাকা। বিসিসি সূত্র জানায়, গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃত্বস্থানীয় হিসেবে বাংলা কমপিউটিং প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। তা ছাড়া আইসিটি-সহায়ক বাংলাভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রমিতকরণ করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। বাংলা কমপিউটিংয়ের জন্য বিভিন্ন টুলস, প্রযুক্তি ও বিষয়বস্ত্তর উন্নয়ন করা হবে। এর আওতায় ১৬টি সফটওয়্যার উদ্ভাবন করা হবে। যার মাধ্যমে বিভিন্ন সমীক্ষা, জরিপ ও গবেষণা পরিচালনা করা হবে। এ বিষয়ে প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলায় বিভিন্ন টুলস উদ্ভাবনের লক্ষ্যে সম্প্রতি সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে। সমীক্ষার সুপারিশের আলোকে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১৬৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। তবে পরিকল্পনা কমিশনের হস্তক্ষেপে ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা কমে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ১৫৯ কোটি ২ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জববার বলেন, সরকারিভাবে বাংলাভাষা ব্যবহারের প্রথম পরিকল্পিত উদ্যোগ এটি। তবে এ কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পপ্রধান নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্প অবকাঠামো চূড়ান্ত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাভাষাকে অগ্রগামী হিসেবে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ১৬টি সফটওয়্যারের উন্নয়ন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা কর্পাস, বাংলা ওসিআর, বাংলা স্পিচ টু টেক্সট-টেক্সট টু স্পিচ, জাতীয় বাংলা কিবোর্ড, বাংলা স্টাইল গাইড, বাংলা ফন্ট এবং বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর। এসব সফটওয়্যার টুলস উন্নয়ন করলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাভাষা ব্যবহার সহজ হবে। পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তি পরিবর্তনের সাথে সাথে আরও টুলসের উন্নয়ন করা হবে। আশা করা যায়, এই প্রকল্প সম্পন্ন হলে আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান অতি দ্রুত হয়ে যাবে।
সদ্য বদলি হওয়া আইসিটি বিভাগের সচিব শ্যামসুন্দর শিকদার বলেন, কমপিউটিংয়ে বাংলার ব্যবহার খুব কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইংরেজির মাধ্যমে কমপিউটার ব্যবহার করা হচ্ছে। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বিশ্ব দরবারে বাংলাভাষা বিশেষ স্থান করে নেবে। একই সাথে সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য কমপিউটার ব্যবহার আরও সহজ হবে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে শুরু হওয়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আরও একধাপ এগোবে বাংলাদেশ। তিনি আরও বলেন, বাংলাভাষায় ইউনিকোড ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলা ইউনিকোড আইএসও স্ট্যান্ডার্ড ১৫২০:২০১১ স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউটিএফ ৬ থেকে শুরু হওয়ার পর ইউটিএফ ১০ ভার্সন নিয়ে কাজ চলছে। ভাষা গবেষণা এবং প্রযুক্তিতে বাংলাভাষার প্রমিতরূপ ব্যবহারের জন্য ১৫৯ কোটি ২ লাখ টাকার প্রকল্প পাস হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি সময় সম্মেলন কক্ষে বাংলায় কথা বললে সেই ভাষা অনুবাদ হয়ে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন ভাষায় শোনার প্রযুক্তিও আমরা তৈরি করতে সক্ষম হব।
বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এসএম আশরাফুল ইসলাম বলেন, বাংলাভাষায় ফন্ট, কিবোর্ড, অনুবাদ, বাংলা বাণীকে লিখিত বাক্যে রূপান্তর (ভয়েস টু টেক্সট), টেক্সট টু ভয়েস, বাংলা ওসিআর ও বাংলা হাতের লেখা চিহ্নিতকরণ বিষয়ে এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা রয়ে গেছে বাংলা বানান ঠিক করা নিয়ে। যতগুলো কিবোর্ড বাংলায় ব্যবহার হয়, তার মধ্যে একটি কিবোর্ডও এখনও পরিপূর্ণভাবে বানান শুদ্ধকরণে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আইসিটি ডিভিশনের উচিত বাংলাভাষার ওসিআর উন্মুক্ত করে দেয়া। তাহলে অ্যাপস ডেভেলপারেরা এই বিষয়ে কাজ করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাভাষায় দুটি স্টাইল গাইড ব্যবহার হয়। যার একটি পশ্চিম বঙ্গের এবং অন্যটি বাংলাদেশের। পশ্চিম বঙ্গের স্টাইল গাইড প্রণয়ন হলেও বাংলাদেশেরটা এখনও চালু হয়নি। আমাদের স্টাইল গাইড নিয়ে কাজ করতে হবে। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা নিয়েও গবেষণা চলছে। ইতোমধ্যে মারমা, চাকমা ভাষায় পাঠ্যবই রচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের পরিচালক প্রকৌশলী এনামুল কবির বলেন- ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ ভাষায় অনেক কনটেন্ট থাকলেও বাংলাভাষায় কনটেন্টের সংখ্যা খুবই অল্প। একটি অ্যানালাইটিক্যাল সাইটের পরিসংখ্যান অনুসারে এই সংখ্যা দশমিক ১ শতাংশেরও কম। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার প্রমিতকরণে আমাদের দক্ষ লোক দরকার। কিন্তু এই জায়গায় আমরা সঠিক কাজ সঠিক মানুষকে দিয়ে করানোর লোক খুঁজে পাই না। এছাড়া গুগল দেবনগরী ফন্টের জন্য দাড়ি এবং ডাবল দাড়িতে ইউনিকোড দিলেও আমাদের জন্য এখনও সেই জায়গা খালি রয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনসুর মুসা বলেন, দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ জানেই না ভাষা কী? অথচ আমাদের সবার মধ্যে ব্যাকরণ আছে। বাংলা ব্যাকরণ না জানলে ভাষা জানা যাবে না। আমি চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছি। চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, প্রতি ৫ কিলোমিটার পরপর ভাষার পরিবর্তন আছে। জীবিত পরিবর্তনশীল। বাংলাভাষায় তুমি, তুই এবং আপনি তিনটি ভাগ থাকলেও ইংরেজিতে নেই। কৃত্রিম ভাষা মানুষের মনের ভাব বুঝতে পারে না। বাংলার ক্ষেত্রে কৃত্রিম ভাষা ব্যবহার করে ভাষা বুঝা আরও কঠিন। দেশে ভাষা গবেষণা এবং প্রমিতকরণ করে প্রযুক্তিতে ব্যবহারের জন্য যে প্রকল্প করা হয়েছে তার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আগামী পাঁচ বছরে এ কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউআইইউ) অধ্যাপক ড. হাসান সরওয়ার বলেন, ২০০৫ থেকে কমপিউটার সায়েন্সের পাশাপাশি আমি ভাষা নিয়ে কাজ করছি। বাংলা বইগুলোকে স্ক্যান করে অটোমেশন রিডারে নিয়ে এসে ফন্টে ব্যবহার করার জন্য অনেক বছর আগে ২৩ লাখ টাকার প্রকল্প পেয়ে একটি ওসিআর তৈরি করেছিলাম। তখন খুব অল্প টাকার ফান্ড ছিল। এখন টাকা হয়েছে। যোগ্য লোক দিয়ে কাজ করানো গেলে আমরা তিন বছরে পরিপূর্ণ না হলেও একটি গাইডলাইন পেয়ে যাব।
অধ্যাপক এএফএম দানিয়াল হক বলেন, ভাষার প্রমিতকরণ নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করার প্রাথমিক ধাপে রয়েছি আমরা। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেমিংটন মেশিন দিয়ে কাজ করা হতো। আমাদের বাংলা ফন্টগুলো এখনও পর্যন্ত প্রমিত হয়নি। সরকারি, আধাসরকারি এবং বেসরকারি- এ তিন স্থানে একসাথে কাজ করতে হবে। এজন্য অনলাইনে গ্রুপিং করে কাজ করা যেতে পারে।
প্রথম আলো ইয়ুথ গ্রুপের সমন্বয়ক মুনির হাসান বলেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি ২ লাখ করপাস (ভাষাংশ) আছে। গুগলে ২৪ লাখ করপাস আছে। চার দিনে ৭ লাখ এবং দুই বছরে আমরা তৈরি করেছি আরও ৭ লাখ করপাস। কিন্তু গুগলে এই সংখ্যা নগণ্য। শুধু ইংরেজিতে গুগলে করপাস জমা আছে ৬ কোটি। কমপক্ষে ৫০ লাখ করপাস হলেও গুগলে আমাদের অবস্থান ভালো হবে। আমাদের কল সেন্টারে কাজ করার জন্য যোগ্য শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। অথচ মাত্র ৬০০ শব্দ আর ১৫০টি বাক্য জানলেই কল সেন্টারে কাজ করা সম্ভব।
ওসিআর ‘পুঁথি’ প্রকাশক টিম ইঞ্জিন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামিরা জুবেরি হিমিকা বলেন, ২০১২ সাল থেকে আমরা বাংলা কনটেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করি। ইংরেজিতে অনেক লাইব্রেরি ডিজিটাল করা হলেও দেশে এই ধরনের ডিজিটাল লাইব্রেরির সংখ্যা নেহায়েত কম। ইংরেজি করা সম্ভব হলে বাংলাও করা সম্ভব। নিজেদের অর্থ খরচ করে আমরা একটা ওসিআর তৈরি করি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, সরকারের কাছে এই প্রজেক্ট জমা দেয়ার পরেও সরকারিভাবে এই ওসিআর ব্যবহয় হয় না। আমরা নিজেরাই ৬০টি প্রতিষ্ঠানে এই ওসিআর ইনস্টল করে দিয়ে এসেছিলাম। আমরা আমাদের প্রজেক্টের এপিআই এক্সচেঞ্জ উন্মুক্ত রেখেছি। ভাষাকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করতে আমাদের গ্লোবাল টিম তৈরি করা দরকার। এতে আমরা দেশে-বিদেশে সবখানেই লাভবান হব।
প্রকল্প বিষয়ে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার সরকার বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ বিভাগে আমার কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। নতুন হিসেবে আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা কামনা করি। কীভাবে কাজ করব এবং কাকে কাজে নিয়োগ দেব এ ব্যাপারে আপনারা আমাকে নির্ধিদ্বায় পরামর্শ দেবেন। আপনাদের আমি সবসময় স্বাগত জানাই
বাংলাবান্ধব প্রযুক্তির ১৬ টুলস
ভাষার গুরুত্ব কি নিছক মনের ভাব বিনিময়ে? এক পলকে এমনটা মনে হলেও ভাষার রয়েছে অর্থনৈতিক ভিত্তি। ভাষা শুধু যোগাযোগ তৈরিই করে না, সমৃদ্ধির পথও উন্মুক্ত করে। বৈচিত্র্যময় ভাষার দুনিয়ায় এটি একদিকে যেমন বিজ্ঞান, অন্যদিকে যোগাযোগের অন্যতম প্রযুক্তিও। দ্বিভাষিক আর অনুবাদ সাহিত্য যেমন ভাষার বিশ্বজনীন যোগাযোগ সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে, তেমনি কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে রাষ্ট্রীয় থেকে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অটুট করবে। আর এজন্য একটি যুগপৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। প্রকল্পের অধীনে বাংলা করপাস, ফন্ট, সিএলডিএ, আইপিএ ফন্ট ইত্যাদির আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের পাশাপাশি প্রযুক্তিবান্ধব ১৬টি টুলস তৈরি করতে গবেষণা উন্নয়ন শুরু হচ্ছে অল্পদিনের মধ্যেই। জানা গেছে, এই প্রকল্পের অধীনে আন্তর্জাতিক মানের পূর্ণাঙ্গ একটি বাংলা করপাস তৈরি করা হবে। এতে বাংলা শব্দ ও বাক্যের শুদ্ধ উচ্চারণ এবং এর ধরন ও নমুনায়ন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে উন্নয়ন করা হবে বাংলা ওসিআর। তখন হাতের লেখাও সহজে পাঠ করতে পারবে কমপিউটার। তখন সহজেই জমির দলিল, পুঁথির ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি সহজতর হবে।
বাংলা কথাকে লিপিতে রূপান্তর এবং লিপি থেকে কথায় রূপান্তরের জন্য স্পিচ টু টেক্সট সফটওয়্যার উন্নয়ন করা হবে। এটি ডকুমেন্ট টাইপিংয়ের সময় এবং খরচ বাঁচবে। ডিজিটাল লেখনীকে কণ্ঠ ভাষায় অনুবাদ করতে পারবে। এই যেমন যখন প্লে বাটনে ক্লিক করা হবে, তখন লিপিকাটি হাইলাইটেড হবে এবং কমপিউটার তা পড়ে শোনাবে। অর্থাৎ এই টুলসটি নিরক্ষর, দৃষ্টিপ্রতিন্ধীরাও ডিজিটাল ডকুমেন্টে কী লেখা আছে তা ক্লিক করেই জানতে পারবেন।
জাতীয় কিবোর্ডর মানোন্নয়নেও এই প্রকল্পের অধীনে গবেষণা ও উন্নয়ন করা হবে। ২০০৪ সালে জাতীয় বাংলা কিবোর্ড (১৭৩৮:২০০৪) তৈরি করে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল। কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও খোদ সরকারি ১২টি সংস্থায়ও ব্যবহার হয় না কিবোর্ডটি। কিবোর্ডটির সীমাবদ্ধতা দূর করে জনবান্ধব করা হবে।
একইভাবে উন্নয়ন করা হবে বাংলা স্টাইল গাইডের। চলিত ও আঞ্চলিক এবং লিখিত ও কথ্য ভাষার বৈচিত্র্যময়তা কমপিউটারের ভাষায় সহজবোধ্য করতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাভাষার বর্ণমালা ও শব্দভা-ারে ব্যবচ্ছেদ ও বাক্য গঠনের একটি জাতীয় মান তৈরি করা হবে। তখন বৈচিত্র্যময় বাংলা ভাষার উচ্চারণ, শ্রুতি, লিখনে একটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা সম্ভব হবে। একইভাবে তৈরি করা হবে বাংলা ফন্ট পড়তে, লিখতে ও বলতে সক্ষম ইন্টারপোর্টেবল ইঞ্জিন। যে ইঞ্জিনের মাধ্যমে বাংলাতেই ডকুমেন্ট প্রসেসিং, ই-মেইল এবং ক্যালকুলেশন করা যাবে। উন্নয়ন করা হবে বাংলা সিএলডিআর। এই ইউনিকোড কমন লোকাল ডাটা রিপোজিটরি (সিএলডিআর) ডাটা রিসোর্সটি ইউনিকোডে পাঠানো হবে। প্রযুক্তিবিশ্বে উন্মুক্ত করা হবে বাংলা কিবোর্ড লে আউট। কমপিউটিয় প্রক্রিয়ায় সহজেই বাংলা বানান ও ব্যাকরণ সংশোধনের জন্য তৈরি করা হবে ব্যবহারবান্ধব টুলস। উন্নয়ন করা হবে বাংলা মেশিন ট্রানসেস্নটর ও স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার।
প্রকল্পের অধীনে ইংরেজি ভাষার ওয়েবসাইট বা কনটেন্টের চেয়ে মাতৃভাষা-নির্ভরতা বাড়িয়ে প্রামিত্মক মানুষের কাছে প্রযুক্তির সুফল পৌঁছে দিতে বিশেষ টুলস তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা বর্ণমালার প্রতিলিপি তৈরি, অনুবাদ, ব্যাখ্যা প্রদানের টুলস ডেভেলপ করা হবে। তখন আপনি বলবেন বাংলায় আর অপর প্রামেত্ম যে ভাষিই থাকুন না কেনো তিনি আপনার কথা বুঝতে পারবেন। আপনার পাঠানো বাংলা বার্তাটি অনুবাদ হয়ে গ্রাহকের কাছে পৌঁছবে তার নিজের ভাষায়। তৈরি করা হবে উপজাতীদের ভাষার জন্য স্ট্যান্ডার্ড কিবোর্ড। এর ফলে এদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের লিপি উইনিকোডে রূপান্তরের মাধ্যমে একটি কিবোর্ড প্রণয়ন করা হবে। এ ছাড়াও বাংলাভাষার বৈশ্বিক মূল্যায়নে আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্ব তালিকায় বাংলা আইপিএ ফন্ট ও সফটওয়্যার অন্তর্ভুক্ত করা হবে