লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
বাংলাদেশের আইটি শিল্প : সমস্যা ও সম্ভাবনা
তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আইটি শিল্প একটি নতুন শিল্পখাত। এখনও এ খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে তেমন কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। তবে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবৃদ্ধিশীল খাত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিক থেকে দেশে এ খাতের অবস্থান তৃতীয় স্থানে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই খাত দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল। প্রতিবছর বেশি থেকে বেশিসংখ্যক ব্যক্তি, শিক্ষত-প্রশিক্ষত আইটি তরুণ এবং একই সাথে বাংলাদেশ সরকার কাজ করে চলেছে এ খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। বাংলাদেশে আইটি খাত যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, আর কোনো খাতই সেভাবে বিকশিত হচ্ছে না। তবে এই খাতে বিদ্যমান রয়েছে নানা সমস্যা। এরপরও মোটামুটিভাবে আমরা আমাদের আইটি খাত নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী।
দেশের আইটি খাতের নানা সমস্যার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- আমাদের গ্রামের লোকেরা এখনও আইটি সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখে না; সার্বিকভাবে প্রায়োগিক জ্ঞানের অভাব; ব্যান্ডউইডথের চড়া দাম; আইটি পণ্যের উচ্চমূল্য; গড়ে উঠছে না ভালো হার্ডওয়্যার কারখানা; আছে অবকাঠামোর অভাব এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়া। আইটি শিল্পসংশ্লিষ্ট সমসা্যর মধ্যে আছে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার মতো জমির অভাব, পরিপূর্ণ ব্যান্ডউইডথ ব্যবহারে হার্ডওয়্যার সঙ্কট ও বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণ।
দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের বসবাস গ্রামে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো প্রাযুক্তিক জ্ঞান নেই বললেই চলে। তাদের সমত্মানদেরও রয়েছে প্রাযুক্তিক জ্ঞানের অভাব। সফলতার সাথে আমরা যদি এই জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত করতে পারতাম, তবে তা হতো বড় ধরনের একটি অর্জন। ব্যান্ডউইডথের দাম কমাতে না পারা এ খাতের জন্য একটি বড় সমস্যা। বিশ্বের, অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ব্যান্ডউইডথের দাম সবচেয়ে বেশি। অথচ আমরা জানি, ব্যান্ডউইডথ হচ্ছে আইটি শিল্পের জ্বালানি। আমরা আমাদের আইটি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার কারখানা গড়ে তুলতে পারিনি, যেমনটি গড়ে উঠছে সফটওয়্যার শিল্প। এটি দেশের আইটি শিল্পের জন্য একটি বড় সমস্যা। আইটি শিল্পের অনেক খাতে আমাদের বেশ কিছু অর্জন থাকলেও পিসি, ল্যাপটপ, মোবাইল সেট ও প্রিন্টারসহ অন্যান্য আইটি পণ্যে দাম এখনও থেকে গেছে অনেক বেশি। আমাদের উচিত আইটি পণ্যের দাম একটি সহনীয় ও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা। বিদ্যুতের সমস্যা আইটি খাতের প্রসারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। বিদ্যুতের অভাবে পণ্য উৎপাদন বাধার মুখে পড়ে। শহরের তুলনায় গ্রামে বিদ্যুৎ সমস্যা আরও প্রবল। বিশ্ব উন্নয়ন ব্যাংকের এক গবেষণা রিপোর্ট মতে, বিদ্যুতের অভাবে বাংলাদেশের আইটি খাতের গতি ৬ শতাংশ কমে যায়। আইটি খাতের উন্নয়নের জন্য ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক জ্ঞান অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাযুক্তিক ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাব প্রবল। এর ফলে আমাদের আইটি খাতের গতি ত্বরান্বিত হতে পারছে না। আইটি শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য জায়গা দেয়া আমাদের জন্য বড় সমস্যা। কিছুদিন আগে একটি বিদেশি কোম্পানি আইটি কারখানা করার জন্য জায়গা চাইলে আমরা তা দিতে পারিনি। কারণ, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির দেশগুলোর একটি। প্রতিবছর চড়া দামে আমরা ব্যান্ডউইডথ কিনি। দুর্ভাগ্য, আমরা সে ব্যান্ডউইডথ পুরোটা ব্যবহার করতে পারি না। মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথ আমরা ব্যবহার করি। বাকি ৬০ শতাংশ ব্যবহারের প্রযুক্তি আমাদের নেই। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, যা আইটি শিল্পের অগ্রগমনকে বাধাগ্রস্ত করে।
এসব নানা বাধার মুখেও আমাদের আইটি শিল্প সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষও ক্রমবর্ধমান হারে আইটি সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তুলছে। এটি একটি আশা-জাগানিয়া দিক। সরকারও এগিয়ে এসেছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর মতো নানা পদক্ষেপ নিয়ে। ভিশন-২০২১ এমনি আরেকটি পরিকল্পনা। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের আইটি শিল্প ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ভারতীয় টেলিকমিউনিকেশন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বাংলাদেশ হয়ে উঠছে একটি ভালো আইটির দেশ।
বাংলাদেশে সফটওয়্যার রফতানি বাড়ছে। বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যন্সিং দেশ। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থানটি দখল করতে সক্ষম হবে। সবশেষে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের আইটি শিল্প দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে এও স্বীকার করতে হবে, আমরা প্রত্যাশিত মাত্রায় এগিয়ে যেতে পারছি না। বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূর করার ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সবাই এগিয়ে এলে, তবেই আমরা হতে পারব আইটিসমৃদ্ধ এক জাতি। সেই সাথে সমৃদ্ধ হবে আমাদের অর্থনীতিও।