• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > আপাদমস্তক টেক-সই হোক বাংলা
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: ইমদাদুল হক
মোট লেখা:৬২
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৭ - জুলাই
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
আইসিটি
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
আপাদমস্তক টেক-সই হোক বাংলা
ভাষা আর প্রযুক্তি যেন দুই সহোদর। সমান্তরাল এক পথ। এই পথ যতটা সমৃদ্ধ হবে, জাতিসত্তার বিকাশ ততটাই ঋদ্ধ হবে। যোগাযোগের এই সুগম পথ বেয়ে আসে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। উন্নয়নের সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এই বোধটি আগেই উঁকি দিয়ে ছিল আমাদের প্রাগ্রসর প্রযুক্তিবোদ্ধাদের মনে। ফলে তারা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলা ভাষা ও প্রযুক্তি ভাষার মধ্যে মেলবন্ধন রচনায় প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু এই কসরতটি চলছে বিচ্ছিনভাবে। এর ফলে আমরা আজ সহজেই কমপিউটার ও মোবাইল ফোনে একে অপরের মধ্যে বাংলা অক্ষরে ভাব বিনিময় করতে পারছি। অনলাইনে দূর দেশের বন্ধুর কাছেও বাংলায় শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারছি। একেবারেই সীমিত পরিসরে হলেও ডিজিটাল অনুবাদকের মাধ্যমে ভিন ভাষি বন্ধুর মাতৃভাষার হরফগুলো বাংলায় তরজমা করে পাঠোদ্ধার করতে পারছি। প্রাচীন সাহিত্য ও দলিল-দস্তাবেজকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তর করতে পারছি। কিন্তু আমার কথাগুলো সাবলীলভাবে ভিনদেশী বন্ধুর কাছে তার ভাষায় অনুবাদ করে পাঠাতে পারছি না। আমি যদি বিজয় সুতন্বি ফন্টে কিছু লিখে মেইল করি, তবে আমার বাংলা ভাষি বন্ধুটিও তা পাঠ করতে পারছেন না। ইউনিকোড-আসকি কোড, ব্যবহৃত কিবোর্ড ইত্যাদি বিষয়ে বিদ্যমান জটিলতায় অমিত সম্ভাবনা থাকার পরও প্রাণের ভাষা বাংলার সাথে সহোদরের মধ্যে এখনও গাঁটছড়া ভাব জমেনি।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলা ভাষা বিশ্বে আজ একটি সুপরিচিত ভাষা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ৬৯০৯টি ভাষার মধ্যে এর অবস্থান পঞ্চম স্থানে। বাংলা শুধু বাংলাদেশের প্রধানতম ভাষা নয়, এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম দেশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা। পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা রাজ্যের বেশিরভাগই বাংলা ভাষি। বিশ্বায়নের কারণে অন্য সব সভ্য জাতির মাতৃভাষার মতো আমাদের মাতৃভাষাতেও বিভিন্ন ভাষার সংযোজন ঘটে চলেছে নিরন্তর। কারণ, যে জাতি বহির্বিশ্বে যত বেশি কর্মতৎপর, যত বেশি অন্যান্য জাতির সাথে তার সংযোগ সাধন ও ভাবের আদান-প্রদান, তার মাতৃভাষার সাথে, কৃষ্টি-সংস্কৃতির সাথে অন্যের ভাষার, অন্যের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটে যাওয়া তত বেশি স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার আবেগ তাতে কখনও ব্যাহত হয় না। আবহমান কাল থেকেই আমাদের চেতনায় জননীর পরেই জন্মভূমি ও মাতৃভাষার অবস্থান। ফিজিক্যাল ফর্ম যেমন কোনো বস্ত্ত কিংবা ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট অস্তিত্বকে প্রতীয়মান করে, তেমনি ভাষার মাধ্যমেই মানুষ নির্দিষ্ট জাতি আর তার সংস্কৃতির ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। যতকাল একটি জাতির মাতৃভাষা অস্তিত্বমান থাকে, ততকাল বেঁচে থাকে তার নিজস্ব সংস্কৃতি। মাতৃভাষা তাই শুধু মনোভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়। সভ্য পৃথিবীর বুকে জাতির অস্তিত্বমান থাকারও একটি প্রধানতম শর্ত তাই। আর প্রযুক্তি যেখানে জাতিতে জাতিতে মেলবন্ধন রচনা করছে, সেখানে মাতৃভাষায় পিছিয়ে থাকলে আমাদের অস্তিত্বও কিন্তু নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে।
ভাষার প্রযুক্তি
মানতেই হবে, হালে জীবনের জীয়ন কাঠি হয়ে উঠেছে নানা প্রাযুক্তিক সেবা। দূরত্ব, ব্যবধান, বৈষম্য ঘুচে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের মতো সুকুমার পথকে উন্মুক্ত করেছে। তাই জীবনযাপনকে আরও প্রাণবন্ত এবং সহজতর ও সমৃদ্ধ করতে টেকসই মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে কমপিউটিং প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি শুধু সময় বা স্থান নয়; ঘুচে দিয়েছে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রভাবশালী যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে বিবেচিত বৈচিত্র্যময় ভাষার ব্যবধানও। ভাষার বৈচিত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে মানবজীবনের এই আদিম অনুষঙ্গকে ধারণ করছে কমপিউটার-মোবাইল ফোন। ফলে প্রযুক্তির বিনি সুতায় সহজেই গ্রন্থিত হচ্ছে নানা ভাষি মানুষ। অবশ্য এ জন্য ভাষার প্রযুক্তিকে গণকযন্ত্রের পাঠ, অনুধাবন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে নিয়ত কাজ করতে হয় ভাষা ও প্রযুক্তিবোদ্ধাদের। তাদের নিরলস গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে প্রযুক্তি হয়ে ওঠে ‘ডিজিটাল অনুবাদক; নিকট বন্ধু’। কিন্তু ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতায় এ বন্ধুত্ব সব সময় সার্বজনীন হয়ে ওঠে না। প্রাণের ভাষা বাংলার ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রেও সেই সীমাবদ্ধতা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। আবার বেসরকারি উদ্যোগে প্রকল্পভিত্তিক কিছু কাজ হলেও তা যেন বৃত্ত ভাঙতে গিয়ে হোঁচট খায়। বিচ্ছিন্নভাবে দশকব্যাপী তাই বাংলা ভাষায় ডিজিটাল সমৃদ্ধির কাজ হলেও সামগ্রিকভাবে ততটা সুফল বয়ে আসেনি। অনেকটাই বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্যে চলছে এই কাজ। একই কাজ যেনো সবাই করছে। কিবোর্ড আর ফন্টের পর বাংলা ওসিআর নিয়েও আমরা সেই একই ঘূর্ণিজাদু উপভোগ করছি। গুগলের বাংলাদেশী ডেভেলপারদের (জিডিজি বাংলা) উদ্যোগে দেশের তরুণ প্রাণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বাংলার জন্য চার লাখ আয়োজনে সাত লাখ বাংলা বাক্যাংশ ও শব্দ অন্তর্ভুক্ত করেছে গুগল। কিন্তু সেই উদ্যোগ এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সম্পদে রূপান্তরিত হয়নি। সেই ডাটাবেজটাও আমাদের কাছে নেই। উপরন্তু বাংলা কর্পাস উন্নয়নের এই উদ্যোগ বৈশ্বিকভাবে নেয়া হলেও এ ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করেছে আমাদের বাংলা একাডেমি। ভাষার প্রযুক্তি সংশেস্নষের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার দিকে না তাকিয়ে তারা এখনও মশগুল ‘ঈদ’ বানানকে ‘ইদ’ হিসেবে উপস্থাপনে। এভাবে বড়ই সেল্যুকাস অবস্থায় রয়েছে রক্তে কেনা আমাদের বর্ণমালা। অথচ ইন্দো-ইউরোপিয়ান, ইন্দো-ইরানিয়ান, ইন্দো-আরিয়ান, মগদ এবং অসমী উৎসারিত ৩৫ কোটি বাংলা ভাষির এই বাংলা বর্ণমালার জ্যামিতিক ভিত্তি, ডিজিটাল ফরম্যাটে প্রকাশের ক্ষেত্রে অক্ষর নির্মাণের যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে তা এখনও অনাদরেই বইবন্দি হয়ে আছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়া এবং বিদেশী ভাষার মাধ্যমে নিজেদের মর্যাদা খুঁজে পাওয়ার দুর্বিপাকে ভেসে আমরা ভুলেই গেছি আমাদের ভাষার প্রাযুক্তিক ঋদ্ধতা। ছোট বা বড় হাতের অক্ষর নয়, ধ্বনির ভেলায় ভেসে চলছে বড়ই স্রোতস্বিনী এই ভাষা। এই ভাষাকে একটু যত্ন-আত্তী করলেই তা আমাদের জন্য আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, ইন্টারনেট সুবিধায় বিশ্বগ্রামের এই যুগে ভাষার দূরত্ব আমাদের অনেক অঞ্চলের মানুষের সাথেই সেভাবে হৃদ্যতা স্থাপনে প্রয়াসী হয়নি। অবশ্য দেরিতে হলেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে প্রাণের ভাষা বাংলা সমৃদ্ধ করতে সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পভিত্তিক কাজ শুরু হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে ‘বাংলা ভাষা’ সমৃদ্ধির পরিকল্পিত প্রকল্প
ব্র্যাক, এটুআই, বিসিসিসহ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্পভিত্তিক প্রযুক্তিবান্ধব বাংলা ভাষা সেবা নিয়ে নানা কাজ হয়েছে। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এবারই প্রথম প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। আশা করা হচ্ছে, এই উদ্যোগের মাধ্যমে আগামী তিন বছরের মধ্যে ইংরেজির বদলে আরও বেশি বাংলায় হবে কমপিউটিং। এ সময়ের মধ্যে কমপিউটারের বেশিরভাগ কাজে বাংলা ব্যবহার করতে পারবে মানুষ। এর মাধ্যমে বাংলাকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে নেতৃস্থানীয় ভাষা হিসেবে স্থান করে নিতে আরও একধাপ এগোবে বাংলাদেশ। গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের আওতায় বাংলা কমপিউটিংয়ের এ উদ্যোগ নিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। ১৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন শেষ হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে প্রকল্প পরিচালক ও সহকারী প্রকল্প পরিচালক ছাড়াও ৮ জন কনসালট্যান্টসহ ১৭ জনের একটি দল কাজ শুরু করেছে। এই কাজে ইতোমধ্যেই ভাষা ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট ১০ জন বিশেষজ্ঞ গবেষককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত জুন মাসে প্রথম প্রস্ত্ততি বৈঠকে প্রণীত হয়েছে প্রকল্প নকশা। নির্ধারিত হয়েছে প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধির ১৬টি টুল বা অনুষজ্ঞ তৈরির কৌশলপত্র। যোগাযোগ করা হচ্ছে দেশী-বিদেশী বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ ও সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের সাথে। সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমেই প্রকল্পটি সফল করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানালেন গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ। বললেন, ইতোমধ্যে দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও কমপিউটার বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগের গবেষকদের এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। ব্যক্তি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত যারাই এ বিষয়ে কাজ করেছেন, তাদের কর্মগুলো আহবান করা হয়েছে। সেখান থেকে সেরা উদ্যোগটি বাছাই করে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এতে সময়ের অপচয় কমার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি দেয়া সহজতর হবে বলে মনে করেন তিনি। আর উপ-পরিচালক রাশেদ ওয়াসিফ মনে করেন, এটি একটি প্রকল্প হলেও ভাষা যেহেতু প্রবহমান একটি বিষয়, তার এর সমৃদ্ধিতে এই কাজ একটি সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর আওতায় আনা গেলে বিষয়টি আরও সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনবে। এরপরও এই প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়নে তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। ওয়াসিফ বলেন, আমরা কৌশলগত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই লক্ষ্য ছুঁতে কাজ করছি। আর সবার অংশগ্রহণ নিশ্চত করতেই প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত কর্মশালা ও সভা আয়োজনের পরিকল্পনার কথা জানালেন প্রকল্প পরিচালক জিয়াউদ্দিন। বললেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ভাষায় রূপান্তরের জন্য জরিপ, গবেষণা ও লাগসই প্রযুক্তিসেবা উন্নয়নের কাজ করতে আমরা আমাদের মেধা ও মননের সর্বোচ্চ ব্যবহার করব। জানা গেছে, কমপিউটার বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জিনাত ইমতিয়াজ আলী, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিনিধি সুশান্ত কুমার সরকার, বুয়েটের প্রতিনিধি মো. মনিরুল ইসলাম, বাংলা একাডেমির প্রতিনিধি অপরেশ কুমার ব্যানার্জী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জববার রয়েছেন প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে। এই কমিটি বাংলা ভাষা উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য ১৬টি টুল উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
প্রথম সভা
অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সুব্যবস্থাপনা, হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ এবং ক্রাউড সোর্সিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ জয় করার পরামর্শ দিলেন সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে প্রযুক্তি ভাষার প্রমিতকরণ, কিবোর্ড জাতীয়করণ এবং গবেষণা ও বাণিজ্যিকীকরণে সমন্বয়ের তাগাদা দিয়েছেন তারা। প্রকল্প না ভেবে প্রাণের দাবি মনে করেই সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। গত ২০ জুন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের আইসিটি ভবনের বিসিসি অডিটোরিয়ামে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ করতে ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহার : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালায় এমন পরামর্শ দেয়া হয়। একই সাথে বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি লোক বর্তমানে বাংলা ভাষায় কথা বলে উল্লেখ করে সভায় ‘এখনও ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার ও প্রয়োগ সার্বজনীন নয়। এজন্য সরকার, গবেষক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদদের একযোগে কাজ করা প্রয়োজন’ বলে তারা অভিমত জানান।
কর্মশালায় আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পূর্ণাঙ্গ বাংলা কর্পাস উন্নয়ন, কথা থেকে লেখা ও লেখা থেকে কথায় রূপান্তর সফটওয়্যার উন্নয়ন, বাংলা ফ্রন্ট রূপান্তর ইঞ্জিন, বাংলা যান্ত্রিক অনুবাদক উন্নয়ন, স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার উন্নয়নসহ মোট ১৬টি বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হয়।
সারাদিনের মোট তিনটি সেশনে সারাদেশের গবেষক, ভাষাবিদ ও কমপিউটার প্রকৌশলীরা তাদের বক্তব্য ও পরামর্শ তুলে ধরেন। ওইদিন সকালে সেমিনারের উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য ও কবি কাজী রোজী। এ সময় তিনি তথ্যপ্রযুক্তির জগতে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সবাইকে সমন্বি^তভাবে কাজ করার আহবান জানান। পরবর্তী দুটি কারিগরি সেশন সঞ্চালনা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও বেসিসের সভাপতি মোস্তাফা জববার।
দুই সেশনে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মফিজুর রহমান, বিসিসির সাবেক নির্বাহী পরিচালক এসএম আশরাফুল ইসলাম, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জববার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দানীউল হক এবং শাবিপ্রবির সহকারী অধ্যাপক সামির ইসমাইল তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
প্রবন্ধকারগণ তাদের নিবন্ধে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন টুল ও সিস্টেম উন্নয়নের পথের বাধাগুলো তুলে ধরে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার করণীয় ব্যাখ্যা করেন। জানা যায়, দেশে এরই মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ হলেও সব কাজকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত কার্যক্রম কখনও করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন উদ্যোগ হলেও শেষ পর্যন্ত কাঙিক্ষত ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবে বক্তারা বলেন, যে কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে আলোচ্য প্রকল্প সেখান থেকেই কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা সরকারের এই উদ্যোগের প্রতি সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, যথাযথভাবে সবার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল আয়োজিত এ কর্মশালায় বিশেষ অতিথি শিক্ষাবিদ ও লেখক ড. জাফর ইকবাল বলেন, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায় না। আর যারা এই বিষয়ে গবেষণা করে, তারা শিক্ষাক্ষেত্রে উপযুক্ত বয়সে তা করতে পারে না। আবার অনেকেই শেষ পর্যন্ত দেশে থাকে না। তাই তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
কর্মশালার সঞ্চালক বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জববার আক্ষেপ করে বলেন, বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমে বাংলা ব্যবহারের জন্য সরকার বাংলা ভাষার একটি ফরম্যাট তৈরি করেছে। কিন্তু মাইক্রোসফটসহ কোনো অপারেটিং সিস্টেমই তা গ্রহণ করেনি। এরপরও তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিতে দেশে তাদের অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা সমৃদ্ধ করতে হলে এসব বিষয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ হিসেবে ইতোমধ্যে এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সামনে আছে আরও দুই বছর। কাজটি বিশাল, ব্যাপক। সময়টা খুবই কম। তবে কাজটি শুরু করে সফলতা অর্জন করা গেলে সময় বাড়ানো হয়তো তেমন কঠিন কাজ হবে না। তার মতে, বিশ্বের অন্য ভাষাগুলোর তুলনায় আমাদের ভাষার প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধকরণ আদৌ না হওয়ার ফলে এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র সুযোগ, যার ভিত্তিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সারা বিশ্ব জয় করবে।
অধিবেশনের মুক্ত আলোচনায় অধ্যাপক হাসান সারওয়ার, জামিল আজহার, নুরুন্নবী হাছিব, বৃষ্টি শিকদার প্রমুখ অংশ নেন।
দ্বিতীয় অধিবেশনে বাংলা ওসিআর ও বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর উন্নয়ন সংক্রান্ত উপস্থাপনা তুলে ধরেন ইউনাইটে ইন্টরান্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মফিজুর রহমান। তার উপস্থাপনায় বাংলা মুদ্রিত লেখা, ছাপা দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি ব্যবহারযোগ্য বাংলা টেক্সট হিসেবে রূপান্তরের সফটওয়্যার তৈরির চ্যালেঞ্জ এবং তা নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা ও উন্নয়নের মৌলিক দিকগুলো উপস্থাপন করা হয়। এ বিষয়টিতে বিস্তর কাজ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলা ভাষায় লেখা অসংখ্য ডকুমেন্ট আছে, যেগুলো আমরা কমপিউটারে সংরক্ষণ করতে পারিনি। টাইপ করে এসব তথ্য সংরক্ষণ অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাধ্য ব্যাপার। তাই ডকুমেন্টগুলো স্ক্যান করে কমপিউটারে সংরক্ষণই সহজ উপায়। কিন্তু এই ইমেজ ফাইলটির টেক্সট পরবর্তী সময় এডিট করা যায় না। প্রয়োজনে কিওয়ার্ড সার্চ করে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে প্রয়োজন হবে ইমেজকে টেক্সটে রূপান্তরের সফটওয়্যার। ইংরেজিতে এটা সহজসাধ্য হলেও বাংলায় এখনও দুষ্কর।
মফিজুর রহমান বলেন, এই জটিল বিষয়টিকে সহজ করার পথে আমাদের মূল বাধাটা হচ্ছে বাংলা অক্ষরের বিন্যাস। বাংলায় যে ৫০টি বর্ণ রয়েছে, এর মধ্যে ১১টি স্বরবর্ণ, বাকিগুলো ব্যঞ্জনবর্ণ। বাংলা প্রতিটি অক্ষরের ওপর একটি করে মাত্রা থাকে। বেসিক ক্যারেক্টারের মধ্যে ৮টির রয়েছে অর্ধ-মাত্রা। ১০টিতে কোনো মাত্রা নেই। আছে কম্পাউন্ড ও কন্সোনেন্ট (্য, ্র, র্, ৃ) মডিফায়ার। কম্পাউন্ড ক্যারেক্টারের মধ্যে হরাইজন্টাল টাচিং ক্যারেক্টর ও ভার্টিক্যাল টাচিং। বাকি কিছু আছে ফিউজ ক্যারেক্টার। ফলে এই ক্যারেক্টারগুলো টেক্সটে রূপান্তর খুবই জটিল হয়ে পড়ে। তাই বাংলা ওসিআর সফটওয়্যার তৈরিতে ত্রি-স্তরের জটিল অক্ষরগুলো বাইনারিতে রূপান্তর সত্যি চ্যালেঞ্জের বিষয়।
সভার তৃতীয় অধিবেশনে বাংলা স্টাইল গাইড উন্নয়ন ও বাংলা আইপিএ ফন্ট উন্নয়ন বিষয়ে প্রচলিত স্টাইল তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহম্মদ দানীউল হক। উপস্থাপনায় তিনি বাংলা উচ্চারণ, শব্দভা-ার, বাক্য গঠন, ব্যবহার রীতি ইত্যাদি বিষয় প্রমিতকরণের পাশাপাশি শব্দের উচ্চারণ লিখিত আকারে প্রকাশ করতে আইপিএ ফন্ট ব্যবহারের একটি প্রমিত পদ্ধতি চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
একক ও বহুভাষি কর্পাসের বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞান তুলে ধরে শাবিপ্রবির সহকারী অধ্যাপক সামির ইসমাইল বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটরের উন্নয়নে মৌখিক ও লিখিত অনুচ্ছেদ যন্ত্রের মাধ্যমে অনুবাদের ক্ষেত্রে স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালাইসিস ও হাইপোথিসিস টেস্টিংয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি জানান, ভারতের সিআইআইএল (সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস) সর্বপ্রথম বাংলা কর্পাস তৈরি করে। এতে তিন লাখ বাংলা শব্দ রয়েছে। আর বাংলাদেশে ১ কোটি ৮০ লাখ শব্দ দিয়ে প্রথম আলো নিউজ কর্পাস প্রণয়ন করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিআরবিএলপি। অপরদিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন করা হয়েছে দুটি কর্পাস। এর মধ্যে ২ কোটি ৭১ লাখ ১৮ হাজার ২৫টি শব্দ নিয়ে মনোলিঙ্গুয়াল কর্পাস ও ২ লাখ শব্দ নিয়ে প্যারালাল (বাংলা থেকে ইংরেজি) কর্পাস তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরে ইউকের ল্যাঙ্কাস্টার ইউনিভার্সিটির ইএমআইএলএলই (Enabling Minority Language Engineering) প্রকল্পে বাংলা ভাষার জন্য তিনটি কর্পাস তৈরি করেছে। এর মধ্যে টেক্সট কর্পাসে ৫৫ লাখ ২০ হাজার, স্পোকেন কর্পাসে ৪ লাখ ৪২ হাজার এবং ২ লাখ বাংলা শব্দের প্যারালাল কর্পাস রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মৌখিক শব্দকে অক্ষরে রূপান্তরটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এই ভাষা বিশেষজ্ঞ। বাংলা স্পিচ টু টেক্সটের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই কুয়েট স্পিচ অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস ব্যবহার করেছে। আর ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এএনএন এবং ভারতের খড়গপুরের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি ব্যবহার করেছে এইচটিকে টুলকিট। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন করেছে অ্যানোটেড স্পিচ করপোরা-ডায়াফোন ও কন্টিনিউয়াস স্পিচ করপোরা। জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাংলা ভাষার ভাব বিশেস্নষণ নিয়েও কাজ করেছে ব্র্যাক, ভারতের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।
এর আগে দ্বিতীয় অধিবেশনে জাতীয় কিবোর্ডের আধুনিকায়ন, বাংলা ফন্টের ইন্টার-অপারেবিলিটি ইঞ্জিন, বাংলা বানান ও ব্যাকরণ পরীক্ষক সংক্রান্ত একটি কর্মপত্র উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এসএম আশরাফুল ইসলাম। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত সুদীপ্ত করের অভিজ্ঞান তুলে ধরেন মুনীর হাসান। এরপর পরামর্শ সভায় প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি, এর গবেষণা ও বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে অমস্ন-মধুর আলোচনায় অংশ নেন অংশগ্রহণকারীরা। তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার করা গবেষণা ও উন্নয়ন কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ওপর জোর দেন। ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বাংলা কর্পাস উন্নয়ন এবং এ ক্ষেত্রে ট্রি ব্যাংক কর্পাস মডেলের দিকে নজর দেয়ার আহবান জানান। মুক্ত আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডাস্ট্রি পর্যায়ে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি যারা এই সেবাটি গ্রহণ করবেন, তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ছাড়া প্রকল্পের অধীনে এবং এ সংশ্লিষ্ট গবেষণা ও তথ্যবহুল প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশের দাবি জানানো হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন করা টুল, ফন্ট ইত্যাদি যেনো উন্মুক্ত লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত হয়, তারও জোরালোভাবে উচ্চারিত হয় এই অধিবেশনে। নবীন গবেষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে নজর দিতে বলা হয়েছে হ্যাকাথনের দিকে।
সক্ষমতার চ্যালেঞ্জ
এতদিন তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার উন্নয়নে অর্থসংস্থানের শঙ্কা থাকলেও এখন সবাই ভাবছেন এই কাজগুলো সম্পন্ন হবে কেমন করে। আলোচিত হচ্ছে প্রক্রিয়াগত বিষয় নিয়ে। প্রকল্পটির ধারক-বাহক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকার একজন ডেভেলপার ও গবেষণ সুদীপ্ত কর বলেন, এই প্রকল্পের কিছু প্রায়োগিক ব্যাপারে আমি উদ্বিগ্ন। আমি আরও উদ্বিগ্ন এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে আসলেই কোনো লাভ হবে কি না সেই ব্যাপারেও। তিন বছরে এই কাজগুলোর শতকরা ২০ ভাগও পূর্ণাঙ্গভাবে হওয়া সম্ভব নয়। ১৫৯ কোটি টাকার প্রজেক্টের চ্যালেঞ্জগুলো আসলে কী কী- এ প্রশ্নের উত্তরও অনেক বড়।
তার ভাষায়, সত্যিকার অর্থে যদি আমরা মানসম্মত সমাধান চাই, তাহলে প্রথমে যেটা বুঝতে হবে, সেটা হচ্ছে ‘তাড়াহুড়া করে তিন বছরে বানিয়ে ফেলব’- এই ধারণাটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। গুগল ট্রান্সলেটে বাংলা যুক্ত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। সেটার মান কিন্তু এখনও খুব খারাপ। অথচ গুগলের টাকা, মেধা, ডাটা কোনো কিছুরই অভাব নেই। অতএব আমাদেরকে প্র্যাকটিক্যাল চিস্তা করতে হবে। আজকে এক বস্তা টাকা নিয়ে কাজ শুরু করলে তিন বছর পরে প্রোডাক্ট পেয়ে যাব- এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। একই সাথে প্ল্যানিংয়ের বড় অংশে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। যদি প্ল্যানটা এরকম হয়ে থাকে যে, একটা ইনস্টিটিউটের বা কোম্পানির অধীনে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিলে, কয়েকজন সফটওয়্যার ডেভেলপার নিয়োগ করলেই হয়ে যাবে- তাহলে এটা ভুল ধারণা। এই প্রাথমিক কাজগুলো কখনও কোনো দেশে ইন্ডাস্ট্রিতে হয়নি, হওয়া সম্ভবও নয়। তার দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা কমপিউট্যাশনাল লিঙ্গুইস্টিক্স গবেষণার জন্য ফান্ড দিতে হবে। হার্ডওয়্যার ইনফ্রাস্ট্রাকচার বানাতে হবে। শুধু টাকা দিয়ে হবে না। দক্ষ লোকবল লাগবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যারা পিএইচডি করেছে বা বড় ইন্ডাস্ট্রিতে সত্যিকারের গবেষণা করেছে বা করছে, তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে। প্রজেক্টগুলো যাতে উপযুক্ত মানুষের হাতে থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের ১৬টি প্রজেক্টের মধ্যে একটি হচ্ছে কর্পাস ডেভেলপ করা। কর্পাস মানেই কিন্তু ডাটার কালেকশন নয়। ওসিআরের জন্য এক রকম কর্পাস হবে, সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিসের জন্য এক রকম কর্পাস হবে, পার্টস অব স্পিচ ট্যাগিংয়ের জন্য আরেক রকম কর্পাস হবে। এ কাজগুলো কোনো ছোটখাটো কাজ নয়। ভালো ডাটাসেট বানাতে বছরের পর বছর লেগে যায়।
অবশ্য বাংলা ভাষার বিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তি বিজ্ঞানী উভয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায় প্রকল্পের সফলতার দৃঢ় আশাবাদ জানিয়ে এই প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশগ্রহণকারী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জববার বলেন, ভাষার জন্য রক্ত দেয়া জাতি হিসেবে আমরা কোনোভাবেই এটিকে ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলা ভাষার এই টুলগুলো উন্নয়ন করার জন্য সক্ষমতা অনুসন্ধানের তথ্য দিয়ে এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জানান, বাংলা নিয়ে কাজ শুধু আমাদেরই করার বিষয় নয়। এরই মাঝে অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগল ও ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলা নিয়ে কাজ করছে। তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সন্দেহাতীত বলেই তাদের উন্নয়ন করা প্রযুক্তিগুলো যদি সরকার সংগ্রহ করতে পারে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রকল্পটিতে সহায়তা পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, একুশ শতকের প্রথম প্রান্তে যদিও আমরা তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের বহু ভাষার সমকক্ষতা অর্জন করেছি, তথাপি বাংলার জন্য আমাদের করণীয় রয়েছে অনেক। বিশেষ করে রোমান হরফ ও তার সাথে সম্পৃক্ত ভাষাগুলো যেসব সক্ষমতা অর্জন করেছে, সেগুলো বাংলা ভাষা ও বাংলা হরফ এখনও অর্জন করতে পারেনি। বাংলা বানান ও ব্যাকরণ শুদ্ধ করা, কথাকে লিখিত রূপদান ও লিখিত বিষয়কে কথায় রূপান্তর, ইন্টারনেটের স্ক্রিন রিড করা, প্রমিত বাংলা কিবোর্ড তৈরি করা, বাংলার কর্পাস তৈরি করা, অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিডার তৈরি করাসহ অনেক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা বাংলা ভাষা ও বর্ণমালায় যুক্ত করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার এতদিন পরেও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা লেখার কাজটি ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেই আমরা তেমন সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এমনকি আমরা সম্ভবত তেমন আন্তরিকভাবে চেষ্টাও করিনি। যেসব ছোটখাটো চেষ্টা করা হয়েছে, সেগুলোও অপ্রতুল, সমন্বয়হীন ও যথাযথ ছিল না। আমাদের জানা যেসব প্রচেষ্টা তেমন ফলদায়ক হয়নি, তার মাঝে রয়েছে প্রমিত কিবোর্ড ও ফন্ট উন্নয়নের প্রচেষ্টা, বাংলা ওসিআর উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাংলা ভাষাবিষয়ক গবেষণা কর্মকা-। এসব প্রচেষ্টার প্রকৃত সফলতা পাইনি বলেই প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় বড় কিছুর আয়োজন করার

বাংলা ভাষা সমৃদ্ধির ১৬ টুল
বাংলা ভাষাকে টেকসই করতে হলে এটিকে আরও প্রযুক্তিবান্ধব হতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও কাঠামোগতভাবে অনেক সমৃদ্ধ হওয়ায় বাংলা ভাষায় কথা বলা বা লেখা অনেক সহজ। কিন্তু এই সমৃদ্ধ কাঠামোই বাংলা ন্যাচরাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংকে অনেক কঠিন করে দিয়েছে। সেই কঠিন কাজকে সহজ করতে ১৬টি টুল নিয়ে কাজ শুরু করেছেন আমাদের বিশেষজ্ঞেরা। আর এই অগ্রসরমান উদ্যোগটির বাস্তবায়নে অংশীজনের অংশগ্রহণ আর সুপরিকল্পনার দাবি থেকেই যাচ্ছে।
০১. আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বাংলা কর্পাস বা ভাষাংশ উন্নয়ন।
০২. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক তৈরি বাংলা ওসিআর উন্নয়ন এবং এতে হাতের লেখা শনাক্তকরণ পদ্ধতি একীভূত করা।
০৩. কথা থেকে লেখা এবং লেখা থেকে কথায় রূপান্তর সফটওয়্যার উন্নয়ন।
০৪. জাতীয় কিবোর্ডের আধুনিকায়ন।
০৫. বাংলা ভাষাশৈলীর নীতি প্রমিতকরণ।
০৬. বাংলা ফন্টের আন্তক্রিয়া রূপান্তর ইঞ্জিন প্রস্ত্ততকরণ।
০৭. বাংলা ভাষার জন্য কমন লোকাল ডাটা রিপোজিটরি (সিএলডিআর) উন্নয়ন এবং ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে জমা প্রদান।
০৮. বাংলা বানান ও ব্যাকরণ পরীক্ষণ।
০৯. বাংলা যান্ত্রিক অনুবাদক উন্নয়ন।
১০. স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার।
১১. প্রতিবন্ধীদের ভাষিক যোগাযোগের জন্য সফটওয়্যার, ডিজিটাল ইশারা ভাষা।
১২. বাংলা অনুভূতি বিশেস্নষণের জন্য সফটওয়্যার উন্নয়ন।
১৩. বাংলার জন্য বহুভাষিক কনটেন্ট রূপান্তর প্লাটফর্ম উন্নয়ন।
১৪. জনপ্রিয় বাংলা ওয়েবসাইট আন্তর্জাতিক ভাষায় অনুবাদকরণ ও মাল্টিলিঙ্গুয়াল কনটেন্ট প্রসেসিং টুল উন্নয়ন।
১৫. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাভাষিদের জন্য প্রমীত কিবোর্ড।
১৬. বাংলা ভাষা সহায়ক আইপিএ (আন্তর্জাতিক ফোনেটিক অ্যালফাবেট) ফন্ট ও সফটওয়্যার উন্নয়ন।


পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৭ - জুলাই সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস
অনুরূপ লেখা