লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
ডায়মন্ড ব্যাটারি: জীবনকাল ৫ হাজার বছরেরও বেশি
ডায়মন্ড ব্যাটারি: জীবনকাল ৫ হাজার বছরেরও বেশি
মুনীর তৌসিফ
নতুন গবেষণাসূত্রে গবেষকেরা জানিয়েছেন, মানুষের তৈরি ডায়মন্ড থেকে এরা এক ধরনের ব্যাটারি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি একটি রেডিওয়েকটিভ ডায়মন্ড ব্যাটারি, তথা তেজস্ক্রিয় ডায়মন্ড ব্যাটারি, যা বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন পার মাণবিক বর্জ্য থেকে। আসলে পারমাণবিক বর্জ্য রূপান্তরিত করে এই ব্যাটারি তৈরি করা হয়েছে। এই ব্যাটারি ‘ডায়মন্ড ব্যাটারি’ নামে অভিহিত হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, এর বাটারি-লাইফ ৫ হাজার বছরেরও বেশি। সোজা কথায়, এই বাটারি একটানা চলবে এই দীর্ঘ সময় ধরে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি ডায়মন্ড ব্যাটারি যদি আমরা তৈরি করি ২০১৭ সালে, তবে তা কার্যকর থাকবে ৭৭৪৭ সাল পর্যন্ত। আর এই ব্যাটারি হবে সেইসব যন্ত্রের জন্য আদর্শ মানের, যেগুলোতে দরকার দীর্ঘ সময় ধরে আস্থার সাথে শক্তি জোগানোর মতো ব্যাটারি। যেমন- পেসমেকার, ড্রোন, উপগ্রহ, মহাকাশযান ইত্যাদি।
&&বজ্ঞানীরা আরও বলছেন, নতুন এই ব্যাটারি উদ্ভাবনের ফলে আমরা দু’ভাবে উপকৃত হচ্ছি- একদিকে পাচ্ছি সুদীর্ঘ ব্যাটারি-লাইফের ব্যাটারি, অপরদিকে পারমাণবিক বর্জ্য সমসার সমাধানেরও একটি নতুন পথের সন্ধান আমরা পেলাম। এই ব্যাটারির নেই কোনো মুভিং পার্টস। এ থেকে নির্গত হয় না কোনো তেজস্ক্রিয় রশ্মি। এর জন্য প্রয়োজন নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণের।
এটি যেভাবে কাজ করে
মানুষের তৈরি ডায়মন্ড এক ধরনের চার্জ সৃষ্টি করে। আর এর জন্য শুধু প্রয়োজন মানবসৃষ্ট এই ডায়মন্ডকে একটি রেডিওয়েকটিভ সোর্সের কাছে রেখে দেয়া। আগেই বলা হয়েছে, এই ডায়মন্ড ব্যাটারিতে কোনো মুভিং পার্টস নেই। এই ব্যাটারি থেকে কোনো তেজস্ক্রিয় রশ্মিও নির্গত হয় না। এর নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন।
গবেষকেরা এই ডায়মন্ড ব্যাটারি তৈরি করেছেন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ নিকেল-৬৩-কে রেডিয়েশন সোর্স বা বিকিরণ উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। আসলে এই গবেষকেরা এখন কাজ করছেন ব্যাটারির সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয় নিয়ে। এই কাজটি করতে গিয়ে এরা কার্বন-১৪ ব্যবহার করছেন। এটি কার্বনের একটি সংস্করণ, যা সৃষ্টি করা হয় একটি গ্রাফাইট ব্লকে। এই ব্লক ব্যবহার হয় পারমাণমিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাকশন মডারেট করার কাজে। কার্বন-১৪ সংযুক্ত রয়েছে এসব ব্লকের উপরিভাগের সাথে। এর ফলে এটি প্রক্রিয়াজাত করে তেজস্ক্রিয় পদার্থে বেশিরভাগটাই সরিয়ে দেয়। কার্বন-১৪-এর নির্যাস ঢালা হয় ডায়মন্ডে একটি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন ব্যাটারি তৈরি করতে। বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তি থেকে ব্যতিক্রমী মানবসৃষ্ট ডায়মন্ড একটি চার্জ সৃষ্টি করে শুধু এটিকে একটি তেজস্ক্রিয় উৎসের কাছে রেখে দিলে। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা জ্বালানি ব্যবহার করি একটি কয়েলের মধ্য দিয়ে একটি চুম্বককে পরিচালিত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে।
ডায়মন্ড ব্যাটারি ব্যবহার কি নিরাপদ?
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, পারমাণবিক বর্জ্য থেকে তৈরি ডায়মন্ড ব্যাটারি ব্যবহার কতটুকু নিরাপদ? আসলে এই ব্যাটারিটিতে থাকা ডায়মন্ড চার্জ উৎপাদন করে, যখন এটি একটি পারমাণবিক উৎসের বা রেডিওঅ্যাকটিভ সোর্সের পাশে রেখে দেয়া হয়। যেহেতু রেডিওঅ্যাকটিভ সোর্সটি একটি কেসের মধ্যে একটি নন-রেডিওঅ্যাকটিভ ডায়মন্ডের (অ-তেজস্ক্রিয় হীরার) স্তরের আবরণ দিয়ে নিরাপদে রাখা হয়, তাই এটি সহজেই নিরাপদে ব্যবহার করা যাবে। আর আমরা জানি, তাত্ত্বিকভাবে ডায়মন্ড বা হীরা হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন বস্ত্ত, সে কারণে এই ডায়মন্ডের স্তর বেধ করে তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহারকারীর কোনো ক্ষতি করার সম্ভাবনা নেই। অধিকন্তু এই ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনীয় ডায়মন্ড তৈরি করতে যে রূপান্তরিত পারমাণবিক বর্জ্য দরকার হয়, সে বর্জ্য দীর্ঘ সময় নিরাপদে মজুদ করে রাখা যায়।
বর্তমানে দুই ধরনের ব্যাটারি টেকনোলজি রয়েছে। তুলনামূলকভাবে এই ডায়মন্ড ব্যাটারি টেকলোনজি ব্যবহার করে তৈরি করা ডায়মন্ড ব্যাটারিতে থাকে নিচু মাত্রার বিদ্যুৎ। তা সত্ত্বেও এর সুদীর্ঘ ব্যাটারি লাইফের অর্থ হচ্ছে, এই ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারির চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। গবেষকেরা বলছেন, প্রতিটি ব্যাটারিতে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ কার্বন-১৪ আছে, তা এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে মোটামুটিভাবে একটি ডায়মন্ড ব্যাটারিতে রয়েছে ১ গ্রাম কার্বন-১৪, আর তা প্রতিদিন সরবরাহ করবে ১৫ জৌল। আর এটি একটি আদর্শ মানের অ্যালকেলাইন অঅ বাটারির তুলনায় কম। অ্যালকেলাইন ব্যাটারিগুলো তৈরি করা হয় স্বল্প সময় ব্যবহারের উপযোগী করে। এগুলোর এনার্জি মজুদের হার প্রতি গ্রামে ৭০০ জৌল। এগুলো অব্যাহতভাবে ব্যবহার করলে মাত্র ২৪ ঘণ্টা কার্যকর থাকে। কার্বন-১৪-এর হাফ-লাইফ হচ্ছে ৫ হাজার ৭৩০ বছর। হাফ-লাইফ বলতে আমরা বুঝি সেই সময়কে, যে সময়ের মধ্যে একটি তেজস্ক্রিয় বস্ত্তর তেজস্ক্রিয়তা অর্ধেকে নেমে আসে। সেই হিসেব মাথায় রেখেই বলা হচ্ছে, ২০১৭ সালে তৈরি একটি ডায়মন্ড ব্যাটারি ৭৭৪৭ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। আসলে এই ব্যাটারি রেডিওঅ্যাকটিভ ডিকে রেটে (তেজস্ক্রিয়তা ক্ষয়ের হার) শক্তি হারাতে থাকবে অব্যাহতভাবে। অতএব ৫ হাজার ৭৩০ বছর পর এই ব্যাটারি এর ৫০ শতাংশ শক্তি হারিয়ে ফেলবে। ১১ হাজার বছর পর
এর শক্তি অবশিষ্ট থাকবে ২৫ শতাংশ। এভাবেই এর শক্তি কমতে কমতে এক সময় শেষ হয়ে গেলে ব্যাটারিটির কার্যকারিতা একদম শূন্যের কোটায় নামবে। এর অর্থ, ৫ হাজার ৭৩০ বছর পর ব্যাটারিটি চালু থাকবে কম শক্তি নিয়ে। অতএব ৫ হাজার ৭৩০ বছর পর ব্যাটারিটি একটি উপগ্রহ কিংবা মহাকাশযানের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর মতো উপযোগী থাকবে কি না, তা নির্ভর করে ওই উপগ্রহ বা মহাকাশযান-বিশেষের বিদ্যুৎ চাহিদা কতটুকু তার ওপর।
বিজ্ঞানিরা ভাবছেন, নতুন এই ডায়মন্ড ব্যাটারি ব্যবহার হবে সেইসব ক্ষেত্রে, যেখানে প্রচলিত ব্যাটারি চার্জ করা বা বদলে ফেলা সহজ হবে না। এই ব্যাটারি ব্যবহার হবে কম বিদ্যুৎ লাগে এমন ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসে, যেখানে দীর্ঘদিন জ্বালানির প্রয়োজন রয়েছে, যেমন- পেসমেকার, অতি উঁচু দিয়ে চলা ড্রোন, এমনকি মহাকাশযানেও। গবেষকদেরকে এ ব্যাপারে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে একটি প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য ইতোমধ্যেই তহবিল সরবরাহ করা হয়েছে।
ডায়মন্ড সমাধান দেবে ডাটা সঙ্কটের
আমরা যতবার একটি পিকচার ইনস্টাগ্রাম করি অথবা ইউটিউবে একটি মন্তব্য প্রকাশ করি, তা থেকে প্রতিদিন আমরা সৃষ্টি করি ১০০ কোটি গিগাবাইটেরও বেশি নতুন ডাটা। যেহেতু এই সংখ্যা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলে, তাই আমরা ফুরিয়ে ফেলছি ডাটা স্টোর করার মতো স্পেস; এমনকি সবচেয়ে ছোট যে ডাটা, সেটির স্টোর এলিমেন্টও এক টুকরা ইনফরমেশন স্টোর করতে ব্যবহার করে হাজার হাজার অ্যাটম। এখন গবেষকেরা জানতে পেরেছেন, এই ডাটা স্টোরিং সমস্যার একটি সমাধান হচ্ছে একটি থ্রিডি ডায়মন্ড চিপ, যা আজকের ডাটা স্টোরিং টেকনোলজির তুলনায় বিপুল পরিমাণ বেশি ডাটা স্টোর করতে সক্ষম।
একটি সাধারণ হোম-কমপিউটারের হার্ডডিস্ক ড্রাইভে খরচ হয় প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ। আর প্রতি ড্রাইভে সামান্য কয়েক টেরাবাইট ডাটা স্টোর করা যেতে পারে। অপরদিকে ডিভিডি ও বস্নু-রের মতো অপটিক্যাল স্টোরেজ মিডিয়া সস্তা ও এনার্জি ইফিশিয়েন্ট হলেও বেশি পরিমাণে ডাটা স্টোর করতে পারে না। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ডায়মন্ডে কাঠামোগত ক্রুটি সারিয়ে তুলতে সৃষ্টি করেন কার্যকর এক স্টোরেজ টেকনোলজি। তারা দাবি করছেন, ডায়মন্ডভিত্তিক স্টোরেজ একটি ডিভিডির তুলনায় শতগুণ বেশি স্টোরেজ ক্যাপাসিটি সৃষ্টি করতে পারে