বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ই-বাণিজ্য শব্দটি ব্যাপক আলোচিত হলেও এ সম্পর্কে বাংলাদেশের খুব কম মানুষই সঠিক ধারণা রাখে। ই-বাণিজ্য বা ই-কমার্স হলো ইলেক্ট্রনিক পণ্য বা সার্ভিস ব্যবহারের মাধমে কোনো পণ্য বা সেবার বেচাকেনা। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট যেমন ব্যবহার হতে পারে, আবার তেমনি মোবাইল নেটওয়ার্কও ব্যবহার হতে পারে। সাধারণ পণ্যের বাজারের সাথে ই-বাণিজ্যের পার্থক্য শুধু ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের ব্যবহার। আর এ মাধ্যমের বাণিজ্য বিশ্বব্যাপী খুবই জনপ্রিয়! কারণ, এ প্রক্রিয়ায় কোনো পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতাকে কোনো একিট নির্দিষ্ট বাজারে সশরীরে গিয়ে হাজির হতে হয় না। পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দোকানের পণ্য অনলাইনে ঘোরাঘুরির মাধ্যমে এর সবদিক যাচাই করে নিতে পারে। এতে করে একদিকে পণ্যের বিস্তৃত পরিধির বাজার তৈরি হয়, অন্যদিকে ক্রেতাসাধারণ খুব কম সময়ে তার কেনার কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। ফলে ক্রেতাসাধারণের ভোগামিত্ম অনেকটাই কমে যায়।
মূলত ই-বাণিজ্য প্রক্রিয়াটি একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। এটি একদিকে যেমন বাণিজ্যের সুশাসনকে নিশ্চিত করে, অন্যদিকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সুবাদে পণ্যের গুণগত মান বাড়ায়। ই-বাণিজ্যে সব প্রক্রিয়াই লিপিবদ্ধ হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সঠিক ইনভয়েসিং না করা, মালামাল কম বিক্রি দেখানো, ভ্যাট বা আয়কর ফাঁকি দেয়া ইত্যাদি ব্যাপারগুলো ই-লেনেদেনে সম্ভব হয় না। ফলে এ প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু তদারকি করা সম্ভব হয় এবং সীমিত লোকবল দিয়ে কাজের প্রক্রিয়া সমাধান করা সম্ভব হয়।
এবার দেখা যাক, ই-বাণিজ্য করার জন্য আমাদের দেশ কতটুকু প্রস্ত্তত। প্রথমত যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে আইনী কাঠামো। এদেশের আইনী কাঠামো কতটুকু সমর্থন করছে এ প্রক্রিয়াকে? ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৩ প্রণীত ও কার্যকর হয়েছে। সেখানে ই-লেনদেন করার আইনী গ্রহণযোগ্যতা গৃহীত হয়েছে। ই-লেনদেন করার আইনী গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া গেলেও বেচাকেনার জন্য মূল্য পরিশোধ কতটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ভাবনায় সম্ভব হবে? অনলাইনে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ডিজিটাল স্বাক্ষর এবং ই-পেমেন্ট গেটওয়ের প্রসঙ্গটি আলোচনা দরকার।
ডিজিটাল স্বাক্ষর এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ডিজিটাল দলিল (ই-মেইল) প্রত্যয়ন করা যায়। ডিজিটাল স্বাক্ষরের দুটি অংশ থাকে। একটি পাবলিক কী অন্যটি প্রাইভেট কী। পাবলিক কী হচ্ছে উন্মুক্ত এবং প্রাইভেট কী হচ্ছে ব্যক্তিগত ও গোপনীয়। এই পাবলিক কী রাখার জন্য একটি পাবলিক প্রেস থাকবে এবং পৃথিবীর নানা দেশে এ পাবলিক কী রাখার জন্য যে প্রেস গড়ে উঠেছে, তাকে বলা হয় পাবলিক কী ইনফ্রাস্ট্রাকচার, সংক্ষেপে পিকেআই।
ডিজিটাল স্বাক্ষর প্রত্যয়ন করার জন্য বিভিন্ন দেশে থাকে Controller of Certitying Authority বা নিয়ন্ত্রক। এ নিয়ন্ত্রক মূলত সব ধরনের ডিজিটাল স্বাক্ষর প্রত্যয়ন করে থাকে। ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ১৮ ধারায় এই নিয়ন্ত্রক নিয়োগের বিধান রয়েছে। আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার এ পদক্ষেপ গ্রহণে বেশ কিছুটা এগিয়েছে।
এরপর আসে অনলাইনে বিল পরিশোধের বিষয়। ইন্টারনেটে পণ্যমূল্য পরিশোধের ব্যবস্থাকে বলা হয় অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম। সাধারণত নিম্নোক্ত তিনটি ক্ষেত্রে অনলাইনে বিল পরিশোধ করা যায় :
ক. বিভিন্ন ধরনের সেবা বিল পরিশোধ। যেমন বিদ্যুৎ ও ফোনের বিল।
খ. পণ্যমূল্য পরিশোধ।
গ. নগদ টাকা হস্তান্তর।
এ ধরনের সেবার মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে পারে এটিএম বা পিএস, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট বা ফোনব্যাংকিং, মোবাইল অপারেটর এবং মার্কেট ওয়েবসাইট। মার্কেট ওয়েবসাইট ছাড়া আর সব মাধ্যম বাংলাদেশে এখন কমবেশি ব্যবহার হচ্ছে। মার্কেট ওয়েবসাইটে ই-লেনদেন এখনো আটকে আছে। এখানে এটিএম, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার এবং ফোনব্যাংকিং করা সম্ভব হলেও একই কাজ ইন্টারনেটে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ লেনদেনে সম্মতি দেয়নি। উল্লেখ্য, পিএস অথবা এটিএম মেশিনের সাথে মার্কেট ওয়েবসাইটের কোনো পার্থক্য নেই।
এটিএম কার্ডের মতো একই পদ্ধতিতে দোকানের ওয়েবসাইটের নির্ধারিত স্থানে ক্রেতা যদি তার ক্রেডিট কার্ডের নম্বর ও পিন দিয়ে থাকেন, তখন এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মা্যধমে ক্রেতা ও দোকানদারের হিসাবে লেনদেন হবে। প্রকৃতপক্ষে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের সাথে এ লেনদেনের কোনো পার্থক্য নেই। দেখা যাচ্ছে, ই-লেনদেনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাই প্রধান। কারণ, যেখানে পিএস বা এটিএমের ব্যাপক ব্যবহার এদেশে হচ্ছে সেক্ষেত্রে ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইটে এর অনুমতি দেয়া কেনো সম্ভব হচ্ছে না, এটা একটি বড় প্রশ্নের সম্মুখীন।
অথচ, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যাংকিং চালু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির হিসাব বিবরণী দেখা, প্রিন্ট নেয়া, নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা দেয়া, ইউটিলিটি বিল দেয়া (কপি ইউটিলিটি আর আপনার ব্যাংক একই হয়), সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিল দেয়া ইত্যাদি সম্ভব হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত। বাংলাদেশে খুব সাম্প্রতিক সময়ে অনেক পণ্যের বা দ্রব্যের বেশ আকর্ষণীয় কিছু ওয়েবসাইট আছে। বাংলাদেশের বাইরে যখন পণ্যকে এই ওয়েবসাইট ব্রাউজ করেন এবং পণ্য অনলাইনে কেনার জন্য উৎসাহী হন, তখনই ঘটে বিপত্তি।
পুরো আলোচনায় এটুকু স্পষ্ট, বাংলাদেশে ই-বাণিজ্যের সম্ভাবনা কতটুকু। কাজেই, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে অনেক সচেতন ও তৎপর হতে হবে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ই-কমার্সের বাস্তবায়নে যতটুকু এগিয়েছে, আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই পুরো প্রক্রিয়াটির বাস্তবায়ন অনেক ত্বরিত গতিতে সম্ভব। কন্ট্রোলার অব সার্টিফাই অথরিটিকে সম্প্রতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর সাথে ডিজিটাল স্বাক্ষরের যে প্রস্তাবিত বিধিমালা গেজেট আকারে জারি করা, নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে লাইসেন্স দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় কাজ হচ্ছে একটি অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে তৈরি করা। এ গেটওয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় ব্যাংকই তা ব্যবহার করতে পারবে। অধিকন্তু, মার্চেন্ট ওয়েবসাইটে ক্রেডিট কার্ড লেনদেনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ইন্টারনেট বা অনলাইনে সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কী ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধের অনুমতি দেয়া এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তৃতীয়পক্ষের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠানো (ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ করা ইত্যাদি উদ্যোগ সহসাই নেয়া উচিত।
বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই ই-বাণিজ্যের কাজ খুব সফলভাবে চলছে। আমাদের দেশেও উপরোল্লিখিত কয়েকটি অসমাপ্ত পদক্ষেপ সম্পাদনের মাধ্যমে খুব দ্রুত এ প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব। বর্তমানে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছি তা বাস্তবায়নের জন্য ই-বাণিজ্য কার্যকরভাবে চালুর ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা দরকার। একই সাথে এ প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন এদেশের মানুষকে বিশ্বায়িত দুনিয়ার শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে গড়ে তুলবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumenoy@yahoo.com