ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজি সম্প্রতি অনলাইন পাইরেসি বন্ধ করার জন্য একটি নতুন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেনে৷ তিনি বলেছেন, যারা অনলাইনে অবৈধভাবে কোনো চলচ্চিত্র, গেমস বা সফটওয়্যার নামান বা কপিরাইট করা কোনো ফাইল নকল করেন, তাদের ইন্টারনেটে প্রবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হবে৷ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০০৭)৷ একই খবরে আরো বলা হয়, একটি সুসভ্য দুনিয়া এবং মার্জিত ইন্টারনেট সিস্টেমের জন্য এমন ব্যবস্থাই থাকা দরকার৷ ফ্রান্স সরকার এজন্য একটি এন্টি পাইরেসি বডি তৈরি করেছে এবং ইন্টারনেট সেবাদানকারীদেরকে ব্যবহারকারীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে ক্ষমতা দিয়েছে৷ এন্টি পাইরেসি বডির পক্ষ থেকে অপরাধীকে প্রথমে বেআইনী কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হবে৷ পরে তাকে ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হবে৷
এই খবরটি অত্যন্ত স্পষ্ট করে দুনিয়াতে পাইরেসি প্রতিরোধ করার প্রবণতা বন্ধ করার জন্য উন্নত দেশের সরকারসমূহের সচেতনতাকে প্রোজ্বল করে প্রকাশ করেছে৷ সাধারণভাবে পাইরেসি বন্ধ করার জন্যও আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ নেই৷ সম্প্রতি পাইরেসির দুটি বড় ঘটনা হচ্ছে : আইআইপিএ নামের একটি আর্ন্তজাতিক এন্টি পাইরেসি প্রতিষ্ঠান ২০০৭ সালে প্রদত্ত তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো ওয়াচ লিস্টে রাখার জন্য মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করা৷ অন্যদিকে সাম্প্রতিককালে সম্পন্ন করা আর্ন্তজাতিক এক জরিপে প্রকাশ পেয়েছে যে, বাংলাদেশ এখন সাধারণ পাইরেসির ক্ষেত্রে বিশ্বের চতুর্থ ও এশিয়ার মাঝে প্রথম স্থান দখল করে আছে৷ এমন একটি ভয়ঙ্কর অবস্থায় খুব সঙ্গতকারণেই বাংলাদেশের পাইরেসি দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক সব মহলের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
সম্প্রতি দেশীয় সংস্থা বেসিস বাংলাদেশ সরকারকে সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছে৷ এরা কপিরাইট আইন ২০০০ এর সঠিক প্রয়োগ করার জন্য সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়, কপিরাইট অফিস, পুলিশের আইজিপি, পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র দিয়েছে৷ বেসিস-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রফিকুল ইসলাম রাউলি এই চিঠি পাঠান৷ তবে পাইরেসি বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি হচ্ছে বিজনেস সফটওয়্যার এলায়েন্সের৷ দুনিয়ার বড় বড় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সংগঠন বিজনেস সফটওয়্যার এলায়েন্স এই প্রথম বাংলাদেশে কোনো কর্মকান্ডে নিয়োজিত হলো৷
প্রথমে তারা একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে যেখানে পাইরেসিতে বাংলাদেশের সর্বশেষ শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে থাকার বিষয়টি অবহিত করে৷ পরে স্থানীয় একটি হোটেলে তারা আয়োজন করে একটি সেমিনারের৷ সেমিনারটির উদ্যোক্তা ছিলো বাংলাদেশে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স৷ এতে বক্তব্য রাখেন ওয়াইপোর পরামর্শক ও বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক মুহম্মদ নুরুল হুদা, কপিরাইট নিবন্ধক শাহ এ এম মাহমুদুল হাসান ও আমেরিকান চেম্বারের আব্দুল গফুর৷ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিজনেস সফটওয়্যার এলায়েন্সের রিচার্ড চান৷
অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে কপিরাইট নিবন্ধক শাহ এ এম এস মাহমুদুল হাসান জানান, দেশের প্রচলিত আইনে সফটওয়্যার পাইরেসির জন্য সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা জরিমানা ও চার বছরের কারাদন্ড প্রদানের বিধান আছে৷ তিনি কপিরাইট আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং এই আইনের আওতায় গ্রহণযোগ্য মেধাস্বত্ব রক্ষার বিষয়গুলোর প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ তিনি জানান, কপিরাইট নিবন্ধন কোনো বাধ্যতামূলক বিষয় নয়, বরং নিবন্ধন করা হলে আইনগতভাবে কপিরাইট প্রমাণ করা সহজ হয়৷ তিনি কমপিউটারের সফটওয়্যার যে সাহিত্যকর্ম হিসেবে কপিরাইট করা যায়, তার কথাও জানান৷ আব্দুল গফুর দেশে কপিরাইট আইন প্রয়োগ করে একটি সৃজনশীল জাতি গঠনের আহ্বান জানান৷
কপিরাইট আইন প্রয়োগের বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে তীব্র সমালোচনা করে ওয়াইপোর পরামর্শক নুরুল হুদা বলেন, দেশে যে হারে সব প্রকারের পাইরেসি চলছে তা চলতে দেয়া যায় না৷ তিনি বলেন, এর ফলে আমরা সভ্য মানুষের পরিচিতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি৷ হুদা পাইরেসির ফলে জাতীয় ক্ষতির বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং পাইরেসি প্রতিরোধ করার জন্য এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানান৷ তিনি পাইরেসির বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি কপিরাইট আইন প্রয়োগ করার জন্য সরকারকে সচেষ্ট হতে অনুরোধ করেন৷
রিচার্ড চান সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আসল সফটওয়্যার ব্যবহার করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি সংস্থায় কি করে সফটওয়্যার ব্যবহারকে পরিকল্পিত উপায়ে সম্পন্ন করা যায় তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন৷ রিচার্ড চান বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন নেই এমন সফটওয়্যার অকারণে কমপিউটারে ইনস্টল করে থাকে৷ এতে পাইরেসি বাড়ে অথচ সেটি করার কোনো প্রয়োজন নেই৷ তিনি বলেন যে, তার প্রতিষ্ঠানের অনেক সদস্য আছেন যারা ওপেন সোর্স প্রমোট করেন৷ ওপেন সোর্স খারাপ কিছু নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মূল কথাটি হচ্ছে লাইসেন্স করা সফটওয়্যার ব্যবহার করা৷ ওপেন সোর্স সফটওয়্যারও লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহার করতে হয়৷ বাণিজ্যিক সফটওয়্যারেও লাইসেন্স ব্যবহার করতে হয়৷ পার্থক্য হলো, বাণিজ্যিক সফটওয়্যারের লাইসেন্স কিনতে হয়, ওপেন সোর্স অর্থ দিয়ে কেনাটা বাধ্যতামূলক নয়৷ কেউ ইচ্ছে করলে ওপেন সোর্স প্রকল্পে দান করতে পারেন৷ কেউ যদি মনে করেন, বাণিজ্যিক সফটওয়্যার তার প্রয়োজন নেই এবং ওপেন সোর্স সফটওয়্যার দিয়ে তার চাহিদা পূরণ হবে, তবে তিনি নির্দ্বিধায় সেটি ব্যবহার করতে পারেন৷ কিন্তু সেটি না করে বাণিজ্যিক সফটওয়্যারের পাইরেটেড কপি ব্যবহার করা উচিত নয়৷ তিনি পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করার ফলে জাতীয় পর্যায়ের যেসব ক্ষতি হয় তার বিশদ বিবরণ দেন৷ তিনি বলেন, পাইরেসি বন্ধ হলে জাতীয় আয় বাড়বে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে৷ পাইরেসি বন্ধ হবার ফলে ভিয়েতনামের জাতীয় আয় বাড়ানোর কথা জানান৷ তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন, পাইরেসি বন্ধ হলে কেবল আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যিক সফটওয়্যার প্রস্তুতকারক বিদেশী কোম্পানিগুলো লাভবান হয়৷ তিনি বাংলাদেশের বিজয় সফটওয়্যারের কথা উলেখ করে বলেন, পাইরেসি বন্ধ হলে দেশীয় সফটওয়্যার শিল্পেরও বিকাশ হবে৷
অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্তব্য রাখতে গিয়ে দেশের সফটওয়্যার শিল্পের সাথে জড়িত বিজ্ঞজনরা বলেন, বাংলাদেশের জন্য সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধ করা অতি আবশ্যকীয় একটি বিষয়৷ এটি না হলে দেশে সফটওয়্যার শিল্পের বিকাশ হবে না৷ শুধু তাই নয়, দেশে আর্ন্তজাতিক বিনিয়োগও কমে যাবে৷ তারা মন্তব্য করেন, বিদেশীরা তাদের মেধাস্বত্বের সংরক্ষণ চায়৷ বিদ্যমান অবস্থায় দেশে মেধাস্বত্ব নিরাপদ নয়৷ ফলে বিদেশীরা এদেশে বিনিয়োগ করতে নাও আগ্রহী হতে পারে৷ সফটওয়্যারের আউটসোর্সিং খাতেও পাইরেসির ভূমিকা রয়েছে বলে অংশগ্রহণকারীরা মন্তব্য করেন৷ এক প্রশ্নের জবাবে রিচার্ড চান বলেন, বিএসএ তাদের প্রথম কর্মকান্ড দেরিতে শুরু করলেও এখন থেকে পাইরেসি সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করবে৷