লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
দেশ ও প্রযুক্তি
আইসিটির জন্য বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং
সাম্প্রতিককালে আমাদের আইসিটি খাতের জন্য তথাকথিত সবচেয়ে বড় সঙ্কট হিসেবে দেখা দিয়েছে ‘বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং’। বিশেষ করে বিদেশীরা আমাদের ওই একটি পরামর্শই দিচ্ছে যে, আমাদের উন্নতি না হবার সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং ইমেজ নেই। আমি ঠিক জানি না, একটি দেশের এই ব্র্যান্ডিংয়ের নতুন ফর্মুলা ডিজিটাল বাংলাদেশ ব্র্যান্ডকে কেমন করে অতিক্রম করে। গত ৬ অক্টোবর ২০১০ ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিবিসির এক সাংবাদিক আমাদেরকে এই ব্র্যান্ডিং করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, শুধু ব্র্যান্ডিং নয়, একেবারে ‘সেক্সি ব্র্যান্ডিং’ করা দরকার। রেন কেরায়েল নামের এই বিজনেস জার্নালিস্ট ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সাইয়েদা আক্তার ও সুমন সাহাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশে আরও অনেক বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য আমাদের দেশটির ‘সেক্সি ব্র্যান্ডিং’ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সাধারণভাবে শুধু ব্র্যান্ডিংয়ের কথা বললেও আমি তেমন অবাক হতাম না। কিন্তু একেবারে সেক্সি ব্র্যান্ডিং? সেটিও দেশের? আমি ঠিক জানি না তা কেমন করে করা যায়।
তবে বিষয়টি যে আকস্মিক নয়, তা আমি বুঝতে পারি। বাংলাদেশকে সেক্সি বানানোর পরিকল্পনাটার পেছনে অনেক পরিকল্পিত পদক্ষেপ আছে বলে আমার মনে হচ্ছে। এর মাত্র দুদিন আগে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলে বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত এক সেমিনারে ভারতীয় পরামর্শক প্রদীপ বাবুও একই কথা বললেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে জানালেন, বাংলাদেশ যে ‘আইসিটিতে ভালো করছে না’ তার অন্যতম কারণ বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং ইমেজ নেই। এসবের সাথে আমি আমাদের সফটওয়্যার সমিতির কাজেরও মিল খুঁজে পেলাম। বিশ্বব্যাংক তাদের সেমিনারের আয়োজন করার আরও দুদিন আগে ২ অক্টোবর বেসিস বাংলাদেশের আইসিটি খাতের জন্য একটি ব্র্যান্ডের উদ্বোধন করে। বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব) ফারুক খান সেই ব্র্যান্ডিং উদ্বোধন করেন। বেসিস ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ শব্দ দুটি বাংলাদেশের আইসিটি খাতের ব্র্যান্ড হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ব্র্যান্ডকে তারা অন্য খাতকেও গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছে। একই সাথে বেসিস এই ব্র্যান্ডকে জনপ্রিয় করার জন্য উদ্যোগও নিতে শুরু করেছে।
দৈনিক ডেসটিনির খবরে জানা গেছে, ‘বেসিস সভাপতি মাহবুব জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকার ডেনমার্ক রাষ্ট্রদূত সোয়েন্ড অলিং, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ, ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির পক্ষে পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির এবং আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফতাব উল ইসলাম। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এশিয়ান টাইগারসের ম্যানেজিং পার্টনার ইফতি ইসলাম।
প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করছে। অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের পাশাপাশি এ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রতি আহবান জানান। ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ ব্র্যান্ড প্রচলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা সূচিত হলো বলেও মন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি অন্যান্য চেম্বার ও ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনকেও এই ব্র্যান্ড প্রচলনের উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান। অনুষ্ঠানে বেসিস নেতারা বলেন, সম্ভাবনাময় আইটি খাতে ভারত ও চীনের পর উন্নত বিশ্বের জন্য বাংলাদেশের পরবর্তী আউটসোর্সিং গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। খবরে কেনো বাংলাদেশ নেক্সট স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়েছে তারও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে যথার্থ আউটসোর্সিং গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর এ জন্যই বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতে ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেসিস ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ ব্র্যান্ড প্রমোট করার এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’ খবরে বলা হয়, এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক যেকোনো সভা-সেমিনার বা মেলায় অংশ নেয়ার সময় তারা এই ব্র্যান্ড নেম ধারণ করবে। এর ফলে এ খাতে বাংলাদেশের পরিচিতি আরো বাড়বে। এ বিষয়ে বেসিস সভাপতি মাহবুব জামান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ এমনিতেই আমাদের জন্য বড় একটি স্লোগান। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ বললে সব সময় অর্থ পরিষ্কার হয় না। এ কারণে নতুন ব্র্যান্ড নেম নেয়া হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশই যে তথ্যপ্রযুক্তির পরবর্তী ক্ষেত্র সেটি বোঝাতেও এই স্লোগান সাহায্য করবে। তিনি আরো বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির বাইরে প্রয়োজনে অন্য কোনো সেক্টরও এই ব্র্যান্ড নেম নিয়ে কাজ করতে পারে।
খবরে বলা হয়েছে, এরই মাঝে ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ স্লোগান নিয়ে বেসিসের ১০টি সদস্য প্রতিষ্ঠান জার্মানির হামবুর্গে ৪ থেকে ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ইফরা এক্সপো ২০১০-এ অশংগ্রহণ করেছে। এছাড়াও ১৩ অক্টোবর সবচেয়ে বড় বিজনেস কনফারেন্স আমেরিকা-বাংলাদেশ টেকনোলজি সামিট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রায় দুই শতাধিক দেশী-বিদেশী তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতা অংশ নেবেন। এতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান অতিথি থাকবেন। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও সজীব ওয়াজেদ জয়। সেখানে ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ ব্র্যান্ড চালু করা হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এটি নিশ্চিত করেছেন যে, এই ব্র্যান্ড তৈরির জন্য সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিশেষত রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো আর্থিক সহায়তাসহ ব্যাপক সহায়তা করবে।
খবরটি থেকে আমরা জেনেছি, আমাদের সফটওয়্যার সমিতি বেসিস বাংলাদেশকে বিশ্বজুড়ে ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ হিসেবে পরিচয় করাতে চায়। কোনো সংগঠন তার নিজের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তবে বেসিস সদস্য হিসেবে আমি খুব দৃঢ়ভাবে মনে করি, এই সিদ্ধান্তটি নেবার আগে বেসিসের সাধারণ সদস্যদের মতামত গ্রহণসহ তাদের দিয়ে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত হওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে বেসিসের পক্ষ থেকে আইসিটি খাত বিষয়ে এমন একটি স্লোগান গ্রহণ করার আগে অবশ্যই এই খাতের সবার সাথেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত ছিল। বিশেষ করে বেসিস যখন জাতীয় পর্যায়ের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তার সাথে যদি বেসিস ছাড়াও অন্য কোনো সংগঠন জড়িত হবার সম্ভাবনা থাকে তবে সেই সংগঠনের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতকে আন্তর্জাতিকভাবে যে সংগঠনটি প্রতিনিধিত্ব করে সেই সংগঠনটি হলো বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি। সঙ্গত কারণেই বিসিএসের জানা উচিত ছিল বাংলাদেশের জন্য এমন একটি ব্র্যান্ড নেম বেসিস তৈরি করতে চায়। স্মরণ করা যেতে পারে, বিসিএস এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আইসিটি সমিতি অ্যাসোসিওতে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। বিসিএস সদস্য ও প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ এইচ কাফি এখন অ্যাসোসিওর ডেপুটি প্রেসিডেন্ট। বিসিএস আনন্দিত যে, অ্যাসোসিও আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ২০১০ সালের আইটি পুরস্কার দিয়েছে এবং সেই পুরস্কার দেয়ার অনুষ্ঠানটিও বিসিএসই করেছে। বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি ফোরাম উইটসাতেও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে বিসিএস। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পরিচিতি হয়ে থাকে প্রকৃতপক্ষে বিসিএসের মাধ্যমেই। বিসিএসের সভাপতি হিসেবে আমি খুব স্পষ্ট করে অনুভব করি, এ ব্যাপারে বেসিস যদি বিসিএসের সাথে আগে আলোচনা করতো, তবে কাজটির মর্যাদা আরও বাড়তো। তারা যদি স্মরণে রাখতো, শুধু বেসিস যে বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রতিনিধিত্ব করে না, তবে সবার জন্য বিষয়টি মঙ্গলজনক হতো। প্রসঙ্গত, বিসিএস আইসিটি খাতে শুধু বাংলাদেশের প্রথম ট্রেড বডি নয়, এটি দেশের একমাত্র সংগঠন যাতে দেশের আইসিটি শিল্পের সব খাতের সদস্য রয়েছেন। এমনকি বিসিএসে সফটওয়্যার ও সেবা খাতের সদস্যসংখ্যাও অনেক। সেজন্যই এই প্রস্তাবনায় বিসিএস শরিক হতে পারলে বিশ্বজুড়ে অ্যাসোসিও ও উইটসা নেটওয়ার্কেও আমরা বাংলাদেশের এমন ব্র্যান্ডিং করতে পারতাম। কিন্তু এখন সেই কাজটি হয়তো আমরা করতে পারবো না। কারণ, আমাদের বোর্ড ও সদস্যদের মতামত না নিয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে সমর্থন করা কঠিন। বেসিস যদি একই সাথে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার সমিতির সাথেও আলোচনা করতো, তবে সেই সংগঠনটিও বাংলাদেশের একটি ব্র্যান্ড তৈরি করার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখতে পারতো। অন্যদিকে কোনো একটি দেশের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং করার সময় আর যাই হোক অন্তত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে অবশ্যই পরামর্শ করা হয় বা কার্যত তাদের মাধ্যমেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে দেখা যায়নি। সম্ভবত তিনি বা তার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছুই জানে না। যদি সেটি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের হয়, তবে সেটিও আইবিপিসির মাধ্যমেই হবার কথা।
সবচেয়ে বড় যে বিস্ময়টি সবার মনে জেগেছে সেটি হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে দেশের একটি বিশাল পরিচিতি গড়ে ওঠার পর নতুন একটি স্লোগান কেনো আমাদের গ্রহণ করতে হলো?
ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বেসিস নেতাদের রিজার্ভেশন অনেক আগে থেকেই ছিল। ২০০৮ সালে যখন আইসিটি নীতিমালা প্রণীত হয়, তখন বেসিসের সভাপতি এইচ এন করিম ছিলেন নীতিমালা ড্রাফটিং কমিটির চেয়ারম্যান। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আমি নীতিমালায় ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি তুলে ধরার প্রস্তাব করেছিলাম। সেই প্রস্তাব তিনি একতরফাভাবে নাকচ করে দিয়েছিলেন। সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হয় শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তবে মাহবুব জামান বেসিসের সভাপতি হবার আগে ও পরে অনেকবার ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। আমার ধারণা, বেসিস তাই এখনও ডিজিটাল বাংলাদেশ অ্যালার্জিতে ভুগে না।
বেসিস সদস্য বা বিসিএস সভাপতির বাইরেও দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার কাছে ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার খবরের অংশবিশেষ বেশ নজর কেড়েছে। যায়যায়দিন পত্রিকায় বেসিস সভাপতি মাহবুব জামান বলেছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ এমনিতেই আমাদের জন্য বড় একটি স্লোগান। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ বললে সব সময় অর্থ পরিষ্কার হয় না। সে কারণে নতুন ব্র্যান্ড নেম নেয়া হয়েছে।’
এই বাক্যগুলো পাঠ করে আমি বড়ই মর্মাহত হয়েছি। আমি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জানতে চাই, একটি বড় স্লোগানের চাইতে একটি ছোট স্লোগান কেমন করে কোনো বিষয়কে অধিকতরভাবে প্রকাশ করে? বড় স্লোগান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে এবং বিশ্বে যেভাবে উচ্চারিত হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্ববাসী পর্যন্ত সবাই যেভাবে এই স্লোগানটি গ্রহণ করেছে তার সাথে ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ নামের স্লোগানটি কি অধিকতর পরিচিত হবে? সরকার বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটির ব্যাপক প্রচার করছে। আইটিইউ-এর মহাসচিব হামাদুন তুরে যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন ব্যাপকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। তুরে নিজেও ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানের প্রশংসা করেছেন। আমি ২০০৮ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে আসছি। গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১০ ব্যাঙ্ককে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও প্রশংসার বাণী শুনেছি। আমি ঠিক জানি না, একটি মানুষ শুধু বাংলাদেশ নেক্সট-এর মানে কি বুঝতে সক্ষম হবে? বাংলাদেশ নেক্সট মানে হলো এরপর বাংলাদেশ। কিসে এরপর বাংলাদেশ, কেনো এরপর বাংলাদেশ; এসব প্রশ্ন খুব সহজেই সবার মনে জাগবে। অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি নিজেই প্রকাশ করে, এর সাথে ডিজিটাল বা তথ্যপ্রযুক্তির সম্পর্ক আছে। প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরের সময় ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছেন। আমাদের জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় মূল শব্দটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। এখন সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ কৌশলপত্র তৈরি করছে। আমি কোনোভাবেই বুঝি না, বাংলাদেশ নেক্সট মানে কি সরাসরি আইসিটি, সফটওয়্যার, আউটসোর্সিং ইত্যাদির কোনো কিছুকে বোঝায়?
আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছে, বেসিস এই নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করে বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক বড় বিভ্রান্তি তৈরি করবে। মানুষ ভাববে, ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি বিষয় এবং বাংলাদেশ নেক্সট আরেকটি বিষয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটিকে তার সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য তার সরকারের সব শাখা-প্রশাখা সক্রিয় করছেন, তখন বেসিস সরকারের কর্মসূচিকে নেতিবাচক করার জন্য কি এমন একটি নতুন স্লোগান উদ্ভাবন করছে? সরকারের পক্ষ থেকে কি বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে? এই স্লোগানের ফলে সরকারের নিজের হাতে তৈরি করা ইমেজ নষ্ট হবে কি না সেটি কি বিবেচনা করা হয়েছে? এমনকি বাণিজ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, তিনি কি এর অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে দেখেছেন? আমি জানি, বাংলাদেশ নেক্সট বলার পর এমন আরও অনেক প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞাসিত হবে।
এটি মনে হতে পারে, বেসিস সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিকে আওয়ামী লীগের দলীয় ও শেখ হাসিনা সরকারের নিজস্ব একটি স্লোগান মনে করে তার বিকল্প হিসেবে দেশের জন্য বাংলাদেশ নেক্সট স্লোগান দিতে চাচ্ছে। তারা মনে করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বলা হলে বেসিস সরকারের সমর্থক বনে যাবে এবং চারদলীয় জোট তাতে অখুশি হবে। এর ফলে দেশের ভেতরে তো বটেই, বাইরেও বারবার ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারিত হবে এবং আমাদেরকে এই বিষয়ে বারবার জবাবদিহি করতে হবে। আমি এটিও মনে করি, এর ফলে বস্ত্তত ডিজিটাল বাংলাদেশকে অস্বীকার করার একটি পথ তৈরি করা হচ্ছে।
আমি জানি না, বেসিসের নামে ডিজিটাল বাংলাদেশকে ম্লান করার বা দুর্বল করার বা এর প্রতিপক্ষ হিসেবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর অর্থ পরিষ্কার নয় বলে বাংলাদেশ নেক্সট স্লোগান তৈরি করা হয়েছে কি না। বিশ্বব্যাংকের ৪০ মিলিয়ন টাকার ঋণের একটি বড় অংশ এই ব্র্যান্ড তৈরি করার জন্য খরচ করার সুযোগ থাকতে পারে। সেই লোভে আমরা নেক্সট-এর ফাঁদে পা দিচ্ছি কি না।
এসব ব্র্যান্ডিংয়ের সুপারিশের কথা শুনে আমি আইসিটি বা বিনিয়োগ কিংবা সার্বিক অগ্রগতির জন্য ভারতের বা চীনের ব্র্যান্ড নেম খুঁজছিলাম। এই দুটি দেশ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আইসিটি বা বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই এদের কোনো তুলনা নেই। কিন্তু আমি এদের কোনো ব্র্যান্ড নেম জানি না। ভিয়েতনাম আমাদের আশপাশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের দেশ। সেই দেশটির ব্র্যান্ড নেম কি, তাও আমি জানি না। বিশ্বব্যাংকের সেমিনারে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক ঘানায় সফলতা পেয়েছে এবং তার ব্র্যান্ড নেম হয়েছে ই-ঘানা। যদি তেমনটিই হয়ে থাকে তবে ব্রিটেনের ডিজিটাল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার ই-লঙ্কা, কোরিয়ার উত্তর কোরিয়া, তাইওয়ানের স্মার্ট তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের আইএন সিঙ্গাপুর ব্র্যান্ড নেম হিসেবে দৃষ্টি কাড়তে পারে। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান তো সেই সমকক্ষ একটি স্লোগান। আমরা একটি পরিচিতি গড়ে ওঠার সাথে সাথেই সেই স্লোগানটিকে হত্যা করতে চাইছি কেনো? স্লোগানটি শেখ হাসিনা দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে এই স্লোগানে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন বলে?
দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জানতে চাই, একটি বড় স্লোগানের চাইতে একটি ছোট স্লোগান কেমন করে কোনো বিষয়কে এবং সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্ববাসী পর্যন্ত সবাই যেভাবে এই স্লোগানটি গ্রহণ করেছে তার সাথে ‘বাংলাদেশ নেক্সট’ নামের স্লোগানটি কি অধিকতর পরিচিত হবে?অধিকতরভাবে প্রকাশ করে? বড় স্লোগান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে এবং বিশ্বে যেভাবে উচ্চারিত হয়েছে ।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com