প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শরীফ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ভাইস চ্যান্সেলর৷ চট্টগ্রামের আহলা সাদারপাড়া হাই মাদ্রাসায় তার শিক্ষা জীবনের শুরু৷ এ মাদ্রাসা থেকে তিনি ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক, কানুনগোপাড়া কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৭ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন৷ প্রফেসর শরীফ বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮০ সালে পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এম.এ. এবং ১৯৮৪ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন৷ মেধার স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশের বহু প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক সম্মাননা ও বৃত্তি পেয়েছেন৷ প্রাথমিক বৃত্তি, জুনিয়র বৃত্তি, ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ন্যাশনাল ট্যালেন্ট স্কলারশিপ ও ন্যাশনাল মেরিট স্কলারশিপ, ফোর্ড ফাউন্ডেশনের হায়ার এডুকেশন স্কলারশিপসহ অসংখ্য বিদেশী স্কলারশিপ তিনি পেয়েছেন৷ দেশে-বিদেশে শিক্ষকতায় তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ আমেরিকায় থাকার সময় সে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইসিটি ব্যবহারের চূড়ান্ত মাত্রাটুকু তিনি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ এবং উপভোগ করেছেন৷ সে অভিজ্ঞতাই তিনি বর্ণনা করেছেন মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর কাছে৷ সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুসা ইব্রাহীম৷
? আপনার চোখে কমপিউটারের বিবর্তনটুকু কেমন?
আমি ১৯৭৭ সালে যখন বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শুরু করি, তখন ইনফরমেশন টেকনোলজি খুব একটা প্রসার লাভ করেনি৷ সে সময় আমেরিকার ইউনিভার্সিটিগুলোতে মেইনফ্রেম কমপিউটার ব্যবহার হতো৷ আমি যখন পিএইচডির ডেজার্টেশন করছিলাম, তখন ওই একটাই মেশিন ছিল৷ এর মাধ্যমে প্রিন্ট নেয়া যেত৷ বিশাল কাগজে প্রিন্ট নিয়ে প্রফেসরদের কাছে নিয়ে যেতে হতো৷ কিন্তু আমার নিজের কোনো কমপিউটার ছিল না৷ হাতে লিখেই সব ধরনের গবেষণা করতে হতো৷ সেই কাগজগুলো নিয়ে মেইনফ্রেমে টাইপ করে তবেই প্রিন্ট নিতে হতো৷ এ অবস্থা পিএইচডি শেষ হওয়া পর্যন্ত নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকেও চলেছে৷
ইউনিভার্সিটি অব রোড আইল্যান্ডে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর পার্সোনাল কমপিউটারের ব্যবহার শুরু হয়েছে৷ আমাকেও একটা কমপিউটার দেয়া হলো৷ এর কয়েক বছর পর ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে ইন্টারনেট চালু হলো৷ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব যে বিশ্বে একটা বিপ্লব শুরু করবে, সে সময়ই তা উপলব্ধি করা গিয়েছিল৷
আশির দশকের শেষ দিকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডাটা ব্যাংকগুলোর গড়ে ওঠা শুরু হলো৷ বিভিন্ন জার্নাল অনলাইনে তাদের আর্টিকেল দেয়া শুরু করলো৷ এভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জার্নাল পড়ে গবেষণা করার সুযোগ সৃষ্টি হলো৷
? এখন এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইসিটির উপযুক্ত ব্যবহার করে কিভাবে শিক্ষার মান উন্নত করা যায় বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় পর্যাপ্ত সম্পদ না থাকলেও সে অভাব পরণ করতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন জার্নাল কেনা যাবে৷ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছু জার্নাল কেনার প্রস্তাব দিয়েছি৷
বাংলাদেশে সম্প্রতি আগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে৷ বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের অধীনে একটি সংস্থা এ কাজটা করছে৷ এরা সাবক্রিপশন ও সদস্যপদ বাড়াচ্ছে৷ তাদের টার্গেট হলো বাংলাদেশের অন্তত ৯০-৯৫ শতাংশ ইউনিভার্সিটিকে এর আওতায় নিয়ে আসা৷ এ নেটওয়ার্কে যদি কলেজগুলো নাও আসে, অন্তত ইউনিভার্সিটিগুলো এলেও বিশ্বে এখন জ্ঞানের জগতে কী কী রিসোর্স ডেভেলপ হচ্ছে, তা এরা মুহূর্তে জানতে পারবে৷
আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে শিক্ষকতায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- এখানে যা পড়ানো হয়, সে বিষয়ে কোনো রিসোর্স নেই, বই নেই, জার্নাল নেই৷ এসব সংগ্রহ করতে হলে অনেক টাকা প্রয়োজন৷ বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটিরই এমন সমৃদ্ধ নেই যে এরা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জার্নালগুলো কিনবে৷ কিন্তু প্রতিদিনই প্রচুর বই বের হচ্ছে৷ এসব সর্মžদ একমাত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমেই সংগ্রহ করে ইউনিভার্সিটিগুলোকে আধুনিক করা যেতে পারে৷
? আমেরিকায় থাকার সময় প্রযুক্তির বিবর্তন আপনি দেখেছেন৷ সেখানে আইসিটি শিক্ষাব্যবস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করে চলেছে?
আমেরিকা বা পশ্চিমা দেশগুলোতে আইসিটির কোনো উন্নয়ন হলে তা সাথে সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলে আসে৷ এর একটা উদাহরণ দিই৷ আমার পিএইচডি গবেষণা শেষ হওয়ার আগেই আমার কাজের রেজাল্টগুলো সেখানকার শিক্ষকরা জেনে যান এবং এ বিষয়গুলো এরা তিনটা ক্লাসে পড়াতেন৷ এটা এ কারণেই বললাম কোনো দেশে আইসিটির কোনো নতুন বিষয় উদ্ভাবিত হলে মুহূর্তেই তা ক্লাসে চলে আসে৷ সেখানে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সাথে সাথেই নতুন টেকনোলজি কিনে নিয়ে পুরনোকে বাতিল করে দেয়৷ নতুন প্রযুক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাথে সাথে নিয়ে আসার সুবিধা হলো শিক্ষার্থীরা সহজেই এর সাথে জড়িত হতে পারছে৷ তবে প্রযুক্তি এত দ্রুতই বদলে যায় যে, আজ যা শিখলাম সেটা কয়েকদিন পর বাতিল হয়ে যাচ্ছে৷ এতে করে নতুন প্রযুক্তি শিখতে গিয়ে অবশ্য বেশ কিছু সময় ও সম্পদের অপচয় হয়৷
? অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য আইসিটির ব্যবহার কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
বিজনেস ওয়ার্ল্ডে প্রতিটি ক্ষেক্ষে ইনফরমেশন টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে৷
? শিক্ষা বা অর্থনৈতিক খাতের উন্নয়নে উন্নত দেশগুলোর সাথে আমাদের দেশের আইসিটি ব্যবহারের পার্থক্যগুলো কী ধরনের?
এবার দেশে ফিরে এসে মনে হয়েছে যে পার্থক্য যথেষ্ট আছে৷ তবে ঠিক কোন খাতে কতটুকু পার্থক্য আছে, সে বিষয়ে এ মুহর্তেই কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না৷ কারণ, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট ডাটা আমার কাছে নেই৷ তবে এ পার্থক্য দূর করতে হলে আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন৷ চিন্তার ব্যাপার হলো, যে খাতে এত বেশি দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন, সেখানে কমপিউটার বিজ্ঞান বা কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার কমে গেছে৷ শিক্ষার্থীরা এখন বিবিএ পড়ার জন্য ভিড় করছে৷ এর একটা কারণ চাকরির বাজার বিবিএ পড়ুয়াদের সহায়তা করছে৷ এ অবস্থা বর্তমানে বিশ্বজুড়ে একই রকম৷ কিন্তু একটা সময় ছিল যখন কমপিউটার পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেক্ষে চাকরির বাজার ছিল রমরমা৷ তখন এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী কমপিউটার বিষয়ে লেখাপড়া করেছে যে আইসিটির চাকরির বাজারে দক্ষ মানবসম্পদে সয়লাব হয়ে গেছে৷ আর সেটা আমেরিকাতেও৷ কিন্তু সেখানে গত কিছুদিন কমপিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের চাকরির বাজার ছোট হয়ে এসেছিল৷ কিন্তু বর্তমানে আইসিটির চাকরির বাজার ফের চাঙ্গা হয়েছে৷ আমেরিকার প্রভাব আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের দেশে এসে পৌঁছাবে৷ এ জন্য এদেশের ইউনিভার্সিটিগুলোকে প্রস্তুত থাকতে হবে৷