টার্মিনেটর কিংবা সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যানের মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে যেমন দেখা যায়, প্রধান চরিত্র তার শক্তিশালী চোখ দিয়ে বহু দূরের কিছু নিখুঁতভাবে দেখতে পারছে, তেমনি চোখ বাস্তবে তৈরি করতে যাচ্ছে, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী, চক্ষু চিকিৎসক, অধ্যাপক এবং ছাত্ররা। ইতোমধ্যেই তারা উন্নয়ন ঘটিয়েছেন বিশেষ ধরনের কন্ট্যাক্ট লেন্সের, যাতে যুক্ত করা হয়েছে লাইট ইমিটিং ডায়োড (এলইডি)। বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে এটি বিদ্যুৎ পাবে। মানুষকে অতিমানবে পরিণত করার কাজ প্রযুক্তিবিদরা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরেই। ইতোমধ্যেই বহু যন্ত্র অবিষ্কার করা হয়েছে, যা স্থাপন করা হচ্ছে মানবদেহে। আবার কিছু রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে। এটা সবাই স্বীকার করছেন, মানবজীবনের সাথে যন্ত্র ক্রমেই হয়ে উঠছে অবিচ্ছেদ্য। এ সবকিছুই করা হচ্ছে মানুষের ভালোর জন্য। কিন্তু এর ক্ষতিকর দিককেও অস্বীকার করার উপায় নেই।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাবাক পারভিস ওই কন্ট্যাক্ট লেন্স উদ্ভাবনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, দেহের সব তথ্যই রয়েছে চোখে। দেহে প্রবেশের তথা দেহকে জানতে হলে সেখানে ঢুকতে হয়। আর সেই ঢোকার ক্ষুদ্র দরজাই হলো চোখ। তাই এমন চোখ যদি উদ্ভাবন করা যায় যে নিজেই দেহের সব তথ্য ট্রান্সমিট করবে, তাহলে সেটা হবে অসাধারণ ঘটনা। সেক্ষেত্রে চোখ থেকেই পাওয়া যাবে দেহের তাপমাত্রা এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাসহ নানা তথ্য-উপাত্ত। এগুলো বিশ্লেষণ করে চিকিৎসকরা নিতে পারবেন রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। যেহেতু চোখের উপরিভাগে দেহ সম্পর্কে বহু তথ্য-উপাত্ত থাকে, তাই চোখ হতে পারে দেহ মনিটরের উত্তম স্থান।
প্রযুক্তিশিল্পে নানা ধরনের যন্ত্র ইতোমধ্যেই শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যসেবায় ওই সব বহনযোগ্য এবং শক্তিশালী যন্ত্র বহুলভাবেই ব্যবহার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সেলফোনের কথা। সেলফোনের মাইক্রোস্কোপ ম্যালেরিয়া নিরূপণে ব্যবহার হচ্ছে। আইফোন দিয়ে বের করা যাচ্ছে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা। এমন বহু যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে। প্রযুক্তিবিদরা এই সুবিধা আরো বহু দূর বিস্তৃত করতে চাইছেন। তাই তাদের গবেষণার অন্ত নেই। এরই পথ ধরে আসছে সংবেদনশীল অতিশক্তিশালী চোখ, যা মানবদেহে স্থাপন করা হলে মানুষের দৃষ্টিশক্তি বহুগুণ বেড়ে যাবে এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এটি আবির্ভূত হবে আশীর্বাদ হিসেবে।
বাবাক পারভিস বলেন, তাদের উদ্ভাবিত ডিজিটাল কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো বহুদূর এগিয়ে দেবে। মানবদেহের রোগ নির্ণয়ে কোলেস্টেরল, সোডিয়াম, পটাসিয়াম এবং গ্লুকোজের মাত্রা জানতে প্রচলিত রক্ত পরীক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে চোখের উপরিভাগ থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সেই কাজটি করা সম্ভব। অর্থাৎ চোখ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেই দেহের রোগ সম্পর্কে জানা যাবে এবং চিকিৎসকরা নিতে পারবেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। ডিজিটাল কন্ট্যাক্ট লেন্স প্রকল্পে কর্মরত অধ্যাপক পারভিস বলেন, এটি কেবল সূচনামাত্র। অতীতে এই ধরনের ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের চিন্তা ছিল অসম্ভব। তিনি বলেন, মানুষের চোখে এমন আরো বহু কিছু হয়তো রয়েছে, যা আমরা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি।
বাবাক পারভিস এবং তার সহকর্মীরা ২০০৪ সাল থেকে ওই বহুমুখী লেন্স নিয়ে কাজ করছেন। অপটোইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টের বা উপাদানের সাহায্যে তারা লেন্সের ভেতরে স্থাপন করেছেন ক্ষুদ্রাকৃতির অ্যান্টেনা, কন্ট্রোল সার্কিট, লাইট ইমিটিং ডায়োড (এলইডি) এবং রেডিও চিপ। ওই উপাদানে এক সময় যুক্ত করা হবে শত শত এলইডি, যা চোখের সামনে ছবি ফুটিয়ে তুলবে। হতে পারে সেটি কোনো শব্দাক্ষর, চার্ট কিংবা আলোকচিত্র। তবে বিষয়টি এত সহজ কিছু নয়। সত্যিকার অর্থে চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে হলে তাদেরকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
প্রথমেই ভাবতে হবে নিরাপত্তা নিয়ে। চোখের সংস্পর্শে যখন কোনো যন্ত্র আসবে তখন সেটি কোনো বিপর্যয় ঘটাবে কি-না তা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত হতেই গবেষকরা ওই লেন্স পরীক্ষা করেছেন একটি খরগোসের চোখে। ওই খরগোসটি ২০ মিনিট ধরে লেন্সটি পরে থাকলেও তার কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। তারপরও মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমোদন পাওয়ার আগে লেন্সটি নিয়ে আরো পরীক্ষা চালাতে হবে।
জর্জিয়া টেক কলেজ অব কমপিউটিংয়ের অগমেন্টেড এনভায়রনমেন্টস ল্যাবের সহযোগী অধ্যাপক এবং পরিচালক ব্লেয়ার ম্যাকেন্টায়ার বলেছেন, ওই কন্ট্যাক্ট লেন্স মানুষের চোখকে ঠিক কতটা অনুসরণ করতে পারবে সেটাই আসলে সবচেয়ে বড় এবং মৌলিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। ম্যাকেন্টায়ার চলতি লেন্স প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট নন। তবে তিনি জুমবি শূটার গেমের ক্ষমতা বাড়াতে অন্য একটি প্রকল্পে সহায়তা করছেন।
তিনি বলেন, ওই ডিজিটাল লেন্স ব্যবহার এখনো বহু দূরের ব্যাপার হলেও উদ্ভাবনটি নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর। যদিও দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর কাজে এগুলো ব্যবহার খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যেহেতু মানুষের চোখ খুব দ্রুত নড়াচড়া করে তাই কোনো একটি জায়গায় সে স্থির থাকে না। ওই লেন্সকে যদি গ্রাফিক্স বা চিত্রে হাজির করতে হয় তাহলে চোখের দৃষ্টি কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থির হতে হবে। তাই সর্বক্ষণিক চোখকে অনুসরণ করা ওই লেন্সের পক্ষে সহজ কাজ নয়। দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যেই বহুলভাবে ব্যবহার হচ্ছে চশমা, যা ব্যবহার করছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। চশমার একটা বড় অংশজুড়ে শক্তিশালী লেন্স লাগানো থাকে, ফলে চোখের দৃষ্টি ওই লেন্স ভেদ করেই এগিয়ে যায়। কন্ট্যাক্ট লেন্সের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু জটিল। এই প্রতিবন্ধকতাসমূহ অতিক্রম করেই সাফল্য পেতে হবে।
অধ্যাপক পারভিস অবশ্য তাদের উদ্ভাবিত ডিজিটাল কন্ট্যাক্ট লেন্সের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিবন্ধকতার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কন্ট্যাক্ট লেন্স আকৃতিতে খুবই ছোট হওয়ায় সেখানে অতিমাত্রায় কমপিউটেশনাল শক্তি প্রয়োগ জটিল হয়ে দাঁড়ায়। তাই এখনই অনেক কিছু যুক্ত করা সম্ভব নয়। লেন্সের ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম বহু অগ্রসর সেন্সর রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেগুলোকে সমন্বয় করা। আর এ কারণেই পারভিস এবং তার সহকর্মীরা লেন্স তৈরির উপাদানটি নিজেরাই তৈরি করেছেন।
দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন এমন আমস্টারডামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লেয়ার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় সহায়তা করছে। প্রতিষ্ঠানের সিইও রাইমো ভ্যান ডার ক্লেইন বলেছেন, এ ধরনের যন্ত্রে দৃষ্টিশক্তি সীমিত হয়ে যাবে, যদি না সেখানে ওয়েব সংযোগের মাধ্যমে তথ্য পাওয়ার সুযোগ থাকে। তিনি আশা করেন অদূর ভবিষ্যতে অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তিসমৃদ্ধ লেন্স বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎপাদন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, কেবল দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্যই নয়, ওই লেন্সের মতো যন্ত্র দেশের অন্যান্য অংশের ক্ষমতা বাড়ানোর কাজেও ব্যবহার হতে পারে। ওই লেন্স কেবল সূচনামাত্র। ভবিষ্যতে এমন চমক জাগানো বহু যন্ত্রই হয়তো এসে যাবে, যা আপনাকে অতিমানব পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com