আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তথা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের রহস্যভেদের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু এই গ্যালাক্সি এত বিশাল এবং এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এত রহস্যের ঘনঘটা যার খুব সামান্যই উন্মোচিত হয়েছে। লুকায়িত রহস্য উন্মোচনে সবচেয়ে প্রথম যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে গোটা গ্যালাক্সির একটি নির্ভুল মানচিত্র তৈরি করা। এই কাজটিই এখনো করা সম্ভব হয়নি। গ্যালাক্সির কিছু নির্দিষ্ট এলাকার চিত্র পাওয়া গেলেও পুরো গ্যালাক্সির চেহারা এখনো অজানা।
তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হাতে নিয়েছেন মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোম প্রকল্প, যার নেতৃত্বে রয়েছেন রেনসেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কমপিউটার বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাদের কাজ হবে মিল্কিওয়ের কাঠামোর পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করা। আফ্রিকা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত মহাকাশ বিজ্ঞানে অত্যুৎসাহী এবং কৌতূহলী হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক তাদের কমপিউটার ক্ষমতা এ কাজে ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন। ওই কমপিউটারের মধ্যে রয়েছে দশক পুরনো ডেস্কটপ থেকে আধুনিক নেটবুক পর্যন্ত। সম্মিলিতভাবে ওই সব কমপিউটারের ক্ষমতা এক পেটাফ্লপের চেয়েও বেশি। এই গতি বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুতগতিসম্পন্ন সুপার কমপিউটারকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোম প্রকল্পে বার্কলে ওপেন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর নেটওয়ার্ক কমপিউটিং তথা বিওআইএনসি প্লাটফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে। মহাজাগতিক প্রাণ খুজেঁ বের করার প্রকল্প এসইটিআই অ্যাটদ্যরেট হোম-এ এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করায় এ বিষয়টি বহুল পরিচিত। গতির দিক দিয়ে ওই বিখ্যাত প্রকল্পকে ছাড়িয়ে গেছে মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোম। বিওআইএনসি প্লাটফর্মের এটিই সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন প্রকল্প এবং জনগণের কাছ থেকে পাওয়া কমপিউটার ক্ষমতার দিক দিয়ে এ প্রকল্প দ্বিতীয়। ফোল্ডিং অ্যাটদ্যরেট হোম প্রকল্পে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোমের পেছনে রয়েছেন অধ্যাপক থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত। বিওআইএনসি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে এ প্রকল্প শুরু হয় ২০০৬ সালের জুলাই মাসে। তখন থেকেই দায়িত্বশীলরা একটি ভলান্টিয়ার বেস তৈরির নিরলস প্রচেষ্টা শুরু করেন, যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় জনগণের কাছ থেকে পাওয়া কমপিউটার ক্ষমতা। প্রতি স্বেচ্ছাসেবক এই প্রকল্পে সাইনআপ করেন এবং তার নিজ কমপিউটারের ক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রকল্পে দান করেন, যা হিসেব নিকেশে সাহায্য করে। গ্যালাক্সির আকৃতি, ঘনত্ব এবং গতির মানচিত্র তৈরিতে ওই প্রতিটি কমপিউটারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিকা রয়েছে। একসাথে এদের ভূমিকা অসাধারণ।
স্বেচ্ছাসেবকদের দান করা কমপিউটার প্রসেসিং ক্ষমতা ব্যবহার করে বিভিন্ন বামন গ্যালাক্সি কিভাবে মিল্কিওয়েতে একীভূত হয়েছে এবং নিজের আকার বাড়িয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে বিরাজমান কৃষ্ণ বস্ত্ত তথা ডার্ক ম্যাটারের সার্বিক আকৃতি ও ঘনত্ব। এই কৃষ্ণ বস্ত্ত সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা এখনো সম্ভব হয়নি।
রেনসেলারের ফিজিক্স, অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক হেইডি নিউবার্গ বলেন, গ্যালাক্সি বা ছায়াপথবিষয়ক এই কমপিউটিং প্রকল্প সূচনামাত্র। এতদিন আমি বিশাল কমপিউটেশনাল সমস্যা সমাধানের জন্য আমার অফিসে ক্ষুদ্র কমপিউটার শক্তি ব্যবহার করে গবেষণা চালিয়েছি। কিন্তু এখন সে অবস্থা নেই। মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোম প্লাটফর্মে কাজ করতে গিয়ে আমি এখন বিশাল কমপিউটার ক্ষমতা ব্যবহার করে গবেষণা করতে পারছি।
নিউবার্গ বলেন, বিজ্ঞানীদের সবসময় প্রয়োজন অতিরিক্ত কমপিউটিং ক্ষমতা। কারণ বড় গবেষণাকাজে কমপিউটেশনাল ক্ষমতা বেশি না হলে কাজের গতি ধীর হয় এবং যথাযথ ফল পাওয়া সহজ হয় না। মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোম প্রকল্পে আরো যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রেনসেলারের কমপিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মালিক ম্যাগডন ইসমাইল, অধ্যাপক ক্লেইর, রোল্যান্ড স্কিমিট, সহযোগী অধ্যাপক কার্লোস ভারেলা, পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট ট্রাভিস ডেসেল প্রমুখ।
যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের দান করা কমপিউটার ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে, তাই সব কমপিউটার ক্ষমতাকে এক জায়গায় করার জন্য তৈরি করতে হয়েছে বিশেষ অ্যালগরিদম। কার্লোস ভারেলা বলেছেন, আপনি যখন একটি সুপার কমপিউটার ব্যবহার করবেন, তখন সব প্রসেসর হবে একই ধরনের এবং তাদের অবস্থানও হবে এক। তাই গবেষণা কাজে সেটি ব্যবহার করলে আসবে একই সময়ে একই ফল। কিন্তু মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোম প্রকল্পে কমপিউটিং শক্তি একই ধরনের অপারেটিং সিস্টেম, প্রসেসর এবং একই স্থান থেকে আসছে না। হাজার হাজার ধরনের প্রসেসর এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে ওই শক্তি। এর মধ্যে দ্রুতগতির কমপিউটার যেমন রয়েছে, আবার কম গতিসম্পন্ন কমপিউটারও রয়েছে। তাই এদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে গবেষণা কাজ করা এবং সঠিক ফল বের করে আনা সহজসাধ্য নয়। যদিও এই কাজটিই এখন পর্যন্ত সাফল্যের সাথে করে যাচ্ছেন গবেষকরা। এজন্য তৈরি করতে হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন অ্যালগরিদম, যার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে একটি অভিন্ন সিস্টেমে। তাই কম গতির কমপিউটার ডাটাও প্রকল্পে কার্যকর অবদান রেখে চলেছে।
এখন পর্যন্ত এই বিষয়ক অগ্রগতি ও গবেষণাসংক্রান্ত মোট ৯টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং অনুষ্ঠিত হয়েছে বহু সংলাপ। আরো বহু নিবন্ধ রয়েছে প্রকাশের অপেক্ষায়। ওই সব নিবন্ধ থেকে সম্ভবত জানা যাবে বিজ্ঞানের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে নতুন উদ্ভাবিত অ্যালগরিদম কিভাবে প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া যেতে পারে। মানুষের ভেতরে থাকা ডিএনএ’র বিস্তারিত বের করে আনতে ডিএনও অ্যাটদ্যরেট হোম প্লাটফর্মের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। প্রোটিন সম্পর্কে আরো জানতে এবং নতুন ওষুধের ডিজাইন তৈরি করতে রেনসেলারে আরো দুটি প্রকল্পের কাজ চলছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে যে কেবল কমপিউটার বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করতে চাইছেন তাই নয়। তাদের আরেকটা উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। মিল্কিওয়ে অ্যাটদ্যরেট হোম প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে ১৬৯টি দেশের ৪৫ হাজারেরও বেশি কমপিউটার ব্যবহারকারী তাদের কমপিউটারের ক্ষমতার কিছু অংশ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন। বর্তমানে ১৭ হাজার জন সক্রিয়ভাবে ওই সিস্টেমে যুক্ত রয়েছেন।
ট্রাভিস ডেসেল বলেছেন, এটি সত্যিকার অর্থেই জন বিজ্ঞান অর্থাৎ পাবলিক সায়েন্স। জনগণকে বিজ্ঞানে উৎসাহিত করতে এটি অনবদ্য ভূমিকা রাখবে। এই প্রকল্প বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে http://MilkyWay.cs.rpi.edu/ ওয়েবসাইটে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com